![](https://media.egiyecholo.com/contents/posts/images/2020/2/2/ul4aoyUKujMBxIWbRFL00iK9y9uZsq9rvt1fyOcB.jpeg)
হরতালে একটা সময়ে গোটা দেশ অচল হয়ে যেত, ছেলেপেলে রাস্তাঘাটে ক্রিকেট খেলতো। এখন কেউ জানেও না যে হরতাল হচ্ছে।
হরতাল কোন দেশি শব্দ? নৈর্ব্যক্তিক দাগিয়ে মাধ্যমিক পাশ করা প্রজন্মের জন্য এটি বেশ জনপ্রিয় একটি প্রশ্ন। তাবৎ দুনিয়াতে যতো আপদ বিপদ আছে তন্মোধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হচ্ছে মানবসৃস্ট দূর্যোগসমূহ। এই হরতাল অনেকটা সেই ঘরানার। নব্বই দশকের নষ্টালজিয়াতে ভোগা প্রজন্মের কাছে হরতাল শুধুমাত্র একটি গুজিরাটি শব্দ নয়।
১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালের মধ্যে মোট ২৬৬ দিন, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের এর মধ্যে মোট ২১৫ দিন হরতাল ছিলো। অর্থাৎ সেই দশ বছরে হরতালই ছিলো দেড় বছর। এই দীর্ঘ সময়ে নব্বইয়ের উত্তাল রাজনীতিতে হরতালের অবদান ছিলো বাংলা সিনেমায় শাবানার সেলাই মেশিনের মতোই। তবে ফ্রাংকেস্টাইনের দানবকে দিয়ে হাল চাষ করালেও সেটি কখনো নিরীহ প্রাণীতে পরিণত হবে না, দানবই থেকে যাবে। হরতালের অবস্থাও হয়েছিলো তাই। ঐ সময়ে হরতালের কিছু নস্টালজিক এলিমেন্ট ছিলো। বর্তমান প্রজন্মের নস্টালজিয়া এবং নব্বইয়ের দশকের নস্টালজিয়া মধ্যে সবচেয়ে বড় যে পার্থক্য সেটা হচ্ছে আবেগ। আমাদের শৈশবের সাথে যে পরিমাণ ইমোশোনাল এটাচমেন্ট আমরা অনুভব করি সেটা অন্য যেকোনো প্রজন্মের সাথে কখনোই মিলবে না।
তেমনই এক নস্টালজিয়া হচ্ছে গলি ক্রিকেট। অদ্ভুত কিছু নিয়মে বানানো সে খেলা ছিলো আমাদের ছেলেবেলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। আর হরতাল হলে তো কথাই ছিলো না। গলি থেকে বেরিয়ে মহাসড়কে চলে আসতো আমাদের বোলিং ব্যাটিং। ২২ গজের বাইরেও যে সেই উত্তেজনা ধরে রাখা যায় তার অন্যতম উদাহরণ ছিলো হরতালে ক্রিকেট খেলা। পিচ ঢালাই করা রাস্তায় ব্যাট বলের ঠোকাঠুকির অদ্ভূত এক আওয়াজ হতো। তার সাথে সবাই মিলে হাউওয়াজ দ্যাট বলে চিৎকার করা ওঠার আনন্দই ছিলো অন্যরকম। অন্য কোনো শব্দেই এই অনুভূতির সঠিক ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব না। সবাই মিলে টাকা দিয়ে বল টেপ কেনা, জুতা কিংবা ইট দিয়ে স্ট্যাম্প বানানো, ব্যাট দিয়ে অমায়িক টসের সিস্টেম, সবকিছুতেই ছিলো শিল্পের ছোঁয়া।
![](https://media.egiyecholo.com/contents/posts/images/2020/2/2/dnkERZQExOjneUh7SWAkAuP78Q62OWL2j080Dbog.jpeg)
সেসময় হরতাল মানেই বিগ ম্যাচ, লিটারে লিটারে কোক বাজি। টিম সিলেকশনের প্রক্রিয়াও ছিলো বেশ মজার। কাঁধে কাঁধ রেখে দুইজন করে আসতো অদ্ভূত সব নাম নিয়ে, সেই নাম থেকেই বেছে নেয়া লাগতো টিম মেম্বার। আর এভাবেই একজন করে বেছে নিতে নিতেই দুই দল গড়ে উঠতো। শুধু মাত্র এক পায়ে প্যাড পড়ে খেলার একটা ট্রেন্ডও ছিলো সেসময়। স্ট্রোক বাড়ানোর জন্য ব্যাট বাঁধানো হতো তখন। রঙ উঠে যাওয়া গ্লাভস হাতে পাওয়া ছিলো যেন আকাশের চাঁদ। সাথে রাস্তার মোড়ে মোড়ে দোকানগুলোতে বাজানো হতো দেশি ব্যান্ড মিউজিক। এলআরবি, নগল বাউল, আর্ক, মাইলস, ওয়ারফেজ, প্রমিথিউসের সুর ভেসে আসতো কানে। সাথে চলতো ক্রিকেট। উফ! সে এক অসাধারণ ফিলিংস। কোনো ভাষাতেই, কোনো আবেগেই সেটা বোঝানো সম্ভব না আসলে।
অতঃপর সেই নস্টালজিয়া থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলাম পেট্রোল বোমার ঘ্রাণে। হরতাল যেন রুপ নিলো লাশের মিছিলে। নব্বই থেকে ত্রিশ বছরের হিসেব করলে, প্রথম দশকে হরতালের অবদান ছিলো অসীম। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন করে দিয়েছিলো সেসব হরতাল। মাঝের দশকে হরতাল ছিলো বিভীষিকাময়, লাশের গন্ধে মোড়ানো। এমন ভয়ানক এবং উত্তেজনাকর সময়চিত্র শিল্পীর তুলিতেও আঁকা কষ্টসাধ্য ছিলো। অথচ গত দশকে এসে হরতাল হয়ে গেছে কমেডি শো।
আরেকটা খবর পড়ে হাসি আটকে রাখা গেল না, পত্রিকা থেকেই কোট করে দিচ্ছি- আজকের হরতাল সফল করতে দলের নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের ফুটপাতে রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে দলটির শতাধিক নেতাকর্মী রবিবার সকাল থেকে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছিলো। বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে দলের নেতাকর্মীদের আধা ঘণ্টার মধ্যে সেখান থেকে সরে যেতে নির্দেশ দেন মতিঝিল জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার জাহিদুল ইসলাম। তখন রিজভী পুলিশের কাছ থেকে ১০ মিনিট সময় চান। কিন্তু দুপুরে খাবার ও নামাজের কথা বলে ৭ মিনিটের মধ্যে কর্মসূচি শেষ করেন তিনি। রিজভীর এমন আচরণে দলের নেতাকর্মী, উপস্থিত পুলিশ ও সাংবাদিকদের মধ্যে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। চড়ুই পাখির কলিজা নিয়ে লোকজন কী করে হরতালের ডাক দেয়, সেটা মাথায় ঢোকে না।
সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন প্রত্যাখান করে প্রায় পাঁচ বছর পর বিএনপি যখন গতকাল ডাকলো, মনের অজান্তেই অনেক স্মৃতি উঁকি দিয়ে গেলো। হরতালে একটা সময়ে গোটা দেশ অচল হয়ে যেত, ছেলেপেলে রাস্তাঘাটে ক্রিকেট খেলতো। এখন কেউ জানেও না যে হরতাল হচ্ছে। কোনোরকম অপ্রীতিকর রাজনৈতিক অবস্থা কখনোই কাম্য নয়। এতে জনগণের ক্ষতিই সবচেয়ে বেশি হয়। তবে তখনকার হরতাল নস্টালজিক, আর এখনকার হরতাল প্যাথেটিক।