এম এ হাশেম: বাংলাদেশের শিল্পোদ্যোক্তাদের আইকন ছিলেন যিনি!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
খুব অল্প বয়সেই ইনোভেটিভ আইডিয়া নিয়ে ব্যবসা করা শুরু করেন তিনি। এমন সব কনসেপ্ট আনা শুরু করেন, যেগুলো নিয়ে হয়তো আগে কেউ ভাবেওনি। এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের অন্যতম মেধাবী শিল্পোদ্যোক্তা...
মানুষের আইডিয়া হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয়। আইডিয়া বা সুদূরপ্রসারী চিন্তা অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতনই মানুষের কাছে চলে আসে। এবং ঠিকঠাক আইডিয়া পেলে এবং সেগুলো যদি ভালোভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, অসাধ্যসাধন হতে বাধ্য। মস্তিষ্কের 'গ্রে ম্যাটার সেল' এ কারণেই চমৎকার, অদ্ভুত, সৃষ্টিশীল।
বেশ কিছুদিন আগে চীনের ব্যবসায়ী জং শানশান কে নিয়ে পড়াশোনা করছিলাম। তিনি মুকেশ আম্বানির পরে এশিয়ার দ্বিতীয় ধনী হয়েছিলেন। আলিবাবার 'জ্যাক মা'কে টপকে হয়েছিলেন চায়নার সেরা ধনী। যদিও সাময়িক সময়ের জন্যেই জ্যাক মা'কে টপকাতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু তিনি পেরেছিলেন। অথচ মানুষটির শুরু কিন্তু মিনারেল ওয়াটার এর বিজনেস দিয়ে!
না, চমকে যাবেন না। তিনি এমন এক সময়ে বোতলজাত পানির কথা ভেবেছিলেন, যে সময়ে মানুষ ভাবতেই পারেনি, এরকম বর্ণহীন-স্বাদহীন-গন্ধহীন তরলও টাকা দিয়ে কেউ কিনতে পারে কিংবা সাদা পানি দিয়েও ব্যবসা করা যায়। ঐ যে বললাম, আইডিয়া! ভিশন! জং শানশান, শুধু মিনারেল ওয়াটারের ব্যবসা করেই গড়ে দিয়েছিলেন ব্যবধান। আরেকটা তথ্য জানাই, জাপানে বেশ কিছু বছর ধরে প্যাকেটজাত বিশুদ্ধ বাতাস বিক্রি করা হচ্ছে! এই অভিনব বিক্রির কথা যখন প্রথমবার শুনি, চমকে গিয়েছিলাম। কিন্তু বর্তমান পরিবেশের দিকে তাকালে, এটা মোটেও অবাক লাগে না আর। একটা সময়ে গিয়ে হয়তো এরকম বিশুদ্ধ বাতাসের চাহিদা হবে আমাদের সবার। পকেটের টাকা খরচ করে আমাদের মুখ ঢুকিয়ে দিতে হবে প্যাকেটের বাতাসে। বুকভরে শ্বাস নেয়ার আশায়!
ধান ভানতে শীবের গীত গাইছি। জং শানশান অথবা জাপানের অভিনব বিজনেস আইডিয়া আজকে মূল আলোচনা না। আজকের কথাবার্তার মূল প্রসঙ্গ, সদ্য প্রয়াত পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এম এ হাশেম কে নিয়ে। যিনি তার জীবনকালে বহু শিল্প-প্রতিষ্ঠানে অর্থলগ্নি করেছেন, বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং এমন কিছু আইডিয়া নিয়ে এসেছেন মানুুুুুষের সামনে, যা নিয়ে কেউ কখনো ভাবেনি আগে।
জং শানশানকে দিয়ে এ লেখা শুরু করার পেছনে কারণ আছে। এম এ হাশেম এর সাথে জং শানশানের আছে তীব্র মিল। দুইজনই যুক্ত ছিলেন বোতলজাত পানির ব্যবসার সাথে। এম এ হাশেম যখন বাংলাদেশে বোতলজাত পানি 'মাম' নিয়ে আসেন, তখন হয়তো তার নিজের মনেও শঙ্কা ছিলো, এ পণ্যের ভবিষ্যৎ কতটুকু উজ্জ্বল! আদৌ এ পণ্য ব্যবসা করবে কী না! বাংলাদেশের মানুষ এখনো স্বাস্থ্য নিয়ে অতটা সতর্ক হয়ে ওঠেনি। রাস্তার পাশের দোকানের একই গ্লাসে হাজার মানুষ ঠোঁট ডুবিয়ে এই করোনাকালেও পানি খাচ্ছে নিয়মিত। সেরকম এক দেশে তিনি যখন বোতলজাত পানির এই আইডিয়া আনেন, সেটা ব্যাকফায়ার করবার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিলো। কিন্তু আইডিয়াটি শেষপর্যন্ত মার্কেট পেয়ে যায়। বাকিটা সবাই জানি আমরা। 'মাম' এর দেখাদেখি বোতলজাত মিনারেল ওয়াটারের অনেক কোম্পানিই এসেছে দেশে, চটকদার বিজ্ঞাপন ও মোড়ক এসেছে, কিন্তু স্ট্যান্ডার্ড বলতে এখনো আমরা 'মাম'কেই বুঝি৷
এম এ হাশেম বোধহয় বাংলাদেশের গুটিকয়েক শিল্পোদ্যোক্তার মধ্যে অন্যতম যিনি ব্যবসার এত এত বিচিত্র, বিস্তৃত ক্ষেত্রে অর্থলগ্নি করেছেন। মার্কেট স্টাডি করে, অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং এ না গিয়ে খুব ধীরেসুস্থে এগোতেন তিনি। ঠাণ্ডামাথায় নিতেন সিদ্ধান্ত। অনেক প্রতিষ্ঠানের সাথেই যুক্ত ছিলেন, এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দুই একটি বাদ দিয়ে প্রায় প্রত্যেকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকেই পেয়েছেন সফলতা।
ব্যবসাজীবন শুরু করেছিলেন তামাক পণ্যের ব্যবসা দিয়ে৷ এরপর ক্রমশ যুক্ত হয়েছেন নানারকম পণ্যের উৎপাদন ও বিপননের সাথে। সিমেন্ট, ইস্পাত আমদানি করেছেন। খাদ্যপণ্যের সাথেও যুক্ত হয়েছেন। প্লাস্টিক, পার্টিকেল বোর্ড, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট, মিনারেল ওয়াটার, পারটেক্স জুট, পারটেক্স পেপার, আরসি কোলা... এগুলো তো আছেই। এগুলোর পাশাপাশি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন তিনি। যুক্ত ছিলেন অজস্র ব্যাংকেরও পরিচালনা পর্ষদের সাথে।
ব্যবসায়ীরের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এমনিতেই বেশি হয়। একই পেশার একজন আরেকজনের সুনাম কোনোদিনই করতে চায় না৷ এটাই নিয়ম। কিন্তু এম এ হাশেমের ক্ষেত্রে সেটারই ব্যত্যয় হয় যেন। সবাই একবাক্যে তাকেই অনুকরণীয় আদর্শ মানে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন নতুন কনসেপ্ট নিয়ে আসা, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্যে উদয়াস্ত পরিশ্রম করা, অজস্র মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা... এগুলো মোটেও সোজা কথা নয়। সেগুলো করার পাশাপাশি মানুষের শ্রদ্ধা ও সম্মান আদায় করে নেওয়া... এই মানুষকে নিয়ে অনেকদিন গবেষণা হবে এদেশের বিজনেস রিসার্চে, তা বলা বাহুল্য।
সমরেশ মজুমদারকে একবার শিবরাম চক্রবর্তী বলেছিলেন-
তোমার বই যখন বাজারে এডিশনের পর এডিশন আসবে, তখন তুমি বড় লেখক না। যখন তোমার লেখা অনুসরণ করে মানুষ লিখবে এবং তোমার বইয়ের পাইরেটেড কপি বিক্রি হবে ফুটপাতে, তখনই তুমি বড় লেখক।
এম এ হাশেমেরও কৃতিত্ব ওখানেই। 'মাম' এর দেখাদেখি বহু বোতলজাত পানি আজ বাজারে। পারটেক্স গ্রুপের পণ্যের দেখাদেখি কপি হয়ে বাজারে আসে অনেক পণ্য৷ এই শিল্পোদ্যোক্তার মূল সাফল্য এখানে। এদেশের ব্যবসাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূলস্রোতে ঢুকিয়ে দেয়ার জন্যে যে কয়জন মানুষকে নিয়ে কথাবার্তা হবে নিয়মিত, তিনি হয়ে থাকবেন তাদের মধ্যে একজন। এখানেই তার উৎকর্ষ। সার্থকতা। অমরত্ব।
তথ্যসূত্রঃ.প্রথম আলো
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন