হাতিরঝিল থেকে গত সপ্তাহে পাওয়া গিয়েছিল এক অজ্ঞাত যুবকের অর্ধগলিত লাশ। কোনো পরিচয়ই পাওয়া যাচ্ছিলো না ছেলেটির। 'আনসলড কেস' হিসেবে ট্যাগ পাওয়ার উপক্রম যখন, ঠিক তখনই ঘটনাস্থলে পাওয়া গেল এক টুকরো কাগজ, পাল্টে গেল সব হিসেব!

ঢাকার হাতিরঝিলে সপ্তাহখানেক আগে পাওয়া যায় এক যুবকের অর্ধগলিত লাশ। লাশের হাত-পা দড়ি দিয়ে বেধে রাখা ছিলো।  বিছানার চাদর, মশারি আর পলিথিন দিয়ে পেচিয়ে মোড়ানো ছিলো আগাগোড়া দেহ। লাশের চেহারা দেখে যাতে চেহারা শনাক্ত করা না যায়, সেজন্যে লাশের চেহারা ও হাতের আঙ্গুল থেতলে বিকৃত করে রাখা হয়েছিলো। বোঝাই যাচ্ছিলো, রীতিমতো পরিকল্পনা করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলো হত্যাকারীরা। পুলিশও লাশ পাওয়ার পরে ধন্দে পড়ে যায়। কোনো ক্লু নেই, কিছু নেই, লাশের চেহারাও বোঝা যাচ্ছে না। কীভাবে উন্মোচন করা যাবে এই খুনের রহস্য? বলে রাখি, রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। তাও আবার একটুকরো কাগজের মাধ্যমে। কীভাবে? তা নিয়েই গল্প।

হাতিরঝিল থানা পুলিশ যখন সূত্রের সন্ধানে চষে বেড়াচ্ছে ঘটনাস্থলের আশপাশ, তখনই তারা দেখতে পায় একটি ছেঁড়া কাগজ। সেই ছেঁড়া কাগজে ছিলো একটি মোবাইল নাম্বার। এই মোবাইল নাম্বারই ত্রাতা হয়ে এসে জানিয়ে দেয় সব রহস্য। মূল ঘটনা যা জানা যায়, মৃত ওই যুবকের নাম আজিজুল ইসলাম মেহেদী। চট্টগ্রামের ইসলামী ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। তার ইচ্ছে ছিলো, কানাডা যাবেন পড়াশোনা করতে। সেজন্যে বিদেশে যোগাযোগ রাখতেন তিনি নিয়মিত। পাসপোর্ট ও ভিসা নিয়ে ধারণা রাখতেন স্পষ্ট।  এলাকায় পরিচিত মুখ হওয়ায় এবং পাসপোর্ট, ভিসা নিয়ে বেশ ভালো জ্ঞান থাকায়, মানুষজন মাঝেমধ্যেই মেহেদীর কাছে আসতো, পাসপোর্ট সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্যে। পাসপোর্টে কোনো ভুল বা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস মিসিং থাকলে, মেহেদী তা ধরিয়ে দিতো। এই কাজের বিনিময়ে টাকাও নিতো সে।

এখন প্রেক্ষাপটে আসবে আরেক চরিত্র। মেহেদীর এক বন্ধু, যে থাকতো ঢাকায়। ঢাকার এক রেস্টুরেন্টে কাজ করতো সেই বন্ধু। করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার পর সেই বন্ধুকে রেস্টুরেন্ট থেকে ছাঁটাই করে দেয়া হয়। বন্ধুটি চাকরি হারিয়ে পড়েন বিপাকে। তিনি তখন তার আরেক বন্ধুর সাথে পার্টনারশিপে পাসপোর্ট ঠিক করার কাজ শুরু করেন। মেহেদীর বন্ধুর সেই পার্টনার পেশায় ছিলো পাসপোর্ট অফিসের দালাল!

মেহেদী এরমধ্যেই জানতে পারে, তার বন্ধু পাসপোর্ট ঠিক করার ব্যবসা শুরু করেছে। সে তখন তার কাছে আসা তিনটি পাসপোর্ট পাঠিয়ে দেয় ঢাকায়, বন্ধুর কাছে, ঠিক করার জন্যে। অগ্রিম টাকাও পাঠিয়ে দেয় মেহেদী।ঢাকার এই বন্ধুটি মেহেদীর দেওয়া পাসপোর্টের কাজ তো করেইনা, বরং অগ্রিম দেওয়া টাকাটাও খরচ করে ফেলে। যথারীতি মেহেদী পরে পাসপোর্ট ও টাকা ফেরত চায়। কিন্তু মেহেদীকে কিছুই ফেরত দেয়া হয় না। আঁটা হয় পরিকল্পনা। মেহেদীকে চিরতরে শেষ করে দেয়ার পরিকল্পনা।

এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মেহেদীকে নতুন একটি মোবাইল নাম্বার চালু করতে বলা হয়, নতুন মোবাইল কিনতে বলা হয় এবং ঢাকায় আসতে বলা হয়। মেহেদী ঢাকায় আসার পর খাবারে বিষ মিশিয়ে তাকে হত্যা করে মেহেদীর বন্ধু ও পাসপোর্টের দালাল। হত্যার পর লাশটিকে তারা ফেলে দেয় হাতিরঝিলে। এরমধ্যে এক হত্যাকারী কোনো কারণে হয়তো কাগজে লিখে রেখেছিলো মেহেদীর নতুন নাম্বার। এই কাগজটিই পরে হয়ে যায় তুরুপের তাস!

ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া কাগজের টুকরোই পালটে দেয় ঘটনার গতিপথ!  

মেহেদীকে লাশকে হাতিরঝিলে ফেলে দেওয়ার পর তার নতুন মোবাইলটিকে সেই নাম্বার লেখা কাগজ সমেত ঝিলে ছুড়ে দেয় একজন আততায়ী। চমকের বিষয় হলো, মোবাইলটি পানিতে পড়ে ডুবে গেলেও সেই কাগজটি পানিতে না পড়ে ঝিলের এক পাশে ডাঙ্গায় পড়ে থাকে। পরে পুলিশের হাতে আসে সেই কাগজ। ঐ কাগজের নাম্বারকে ট্রেস করেই ধরা সম্ভব হয় হত্যাকারীদের। হত্যাকারীরা এরমধ্যে স্বীকারও করেছে তাদের অপরাধ।

এভাবেই সেমি হিচকক স্টাইলের এক খুনের রহস্য উদঘাটিত হয়, পরিসমাপ্তি হয় যাপিত জল্পনাকল্পনার। এক টুকরো কাগজ খণ্ডই তৈরী করে দেয় ব্যবধান!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা