মৃত্যুর প্রায় এক যুগ পরেও জীবন্ত, জলজ্যান্ত যিনি!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মানুষটি নেই আজ পুরো ১১ বছর। কিন্তু ‘দ্যা ডার্ক নাইট’ খুলে দেখুন, হিথ জীবন্ত, হেসে হেসে বলছে, ‘why so serious?’
সাদিয়া ইসলাম রোজাঃ মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মে, তার সৃষ্টির মাধ্যমে। তবে কিছু মানুষ বেঁচে থাকে ‘কর্ম’ হয়ে। কেউ একজন বড়ই ভেবে বলেছিলেন, ‘some people create arts, some are arts themselves’। এই ভদ্রলোক তার নিজের ঘরে ড্রাগ ওভারডোজে মরে গেছেন আজকে পুরো ১১ বছর হলো। অথচ তিনি ঠিক একইভাবে বেঁচে আছেন, রাজত্ব করছেন। বেঁচে থাকলে হিথ লেজারের ভুল-ত্রুটি হয়তো আরো কিছু ধরা পড়তো। তিনিও মানুষই ছিলেন আমাদের সবার মতোই। খানিকটা জেদী, একরোখা এবং খুবই অস্থির প্রকৃতির শান্ত চরিত্রের মানুষটি জীবনের শুরুর দিকে চেয়ে ছিলেন বিখ্যাত হতে। হিথ যখন সত্যি দারুণ বিখ্যাত হয়ে উঠতে থাকেন, তখন থেকেই এই শব্দ, এই খ্যাতি থেকে তিনি পালিয়ে বেড়াতে চেয়েছেন। খুব বন্ধুপ্রিয় মানুষটি কখনই সহজে মিশে যেতে পারতেন না। তবে যখন পারতেন তখন সেই মানুষগুলোর জন্য নিজের ভেতরের বিশাল এক আলোর জগৎ খুলে দিতেন। হলিউডপাড়ার সবাই প্রথম দিকে ভেবেছিলো যে আরো নতুন একজন ‘হার্ট থ্রব’ যুক্ত হয়েছে হাজার ছাড়িয়ে যাওয়া তালিকায়।
অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম, বেড়ে ওঠা আর মেল গিবসনের সাথে কাজ করার স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে ওঠা হিথ নিজের জন্ম স্থানে সামান্য পরিচিতি পেয়েছিলো খুবই অল্প বয়সে, একটি টেলিভিশন সিরিজে কাজ করে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে ‘Ten Things I Hate About You’ সিনেমাতে অভিনয় করে তিনি হলিউডের রমণীদের দৃষ্টি এবং মন কাড়েন, সাথে কিছু পরিচালকও দেখেন যে খুবই সুদর্শন, বয়সের তুলনায় বেশ ম্যাচিউর এবং অসম্ভব সুন্দর হাসির অধিকারী এক বালক সদ্য অস্ট্রেলিয়া থেকে আমেরিকা পাড়ি জমিয়েছে। তবে সিনেমাটিতে অভিনয় করে হিথের সেই স্বপ্নটি পূরন হয়, যেটি তিনি জন্ম থেকে দেখে উনিশে পা রেখেছেন। ‘মেল গিবসন’, তার হিরো এবং হলিউডপাড়ায় অস্ট্রেলিয়াকে রিপ্রেজেন্ট করা প্রথম সুপারস্টারের সাথে হিথ কাজ করেন বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে ২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত The Patriot সিনেমাটিতে। এরপরে আর ঘুরে তাকাতে হয়নি।
মাত্র ২১ বছর বয়সে এই ধরনের খ্যাতি এক ধরনের উন্মাদনা এনে দেয় তার মধ্যে। কাজের প্রতি, নিজের নতুন একটি জীবনের প্রতি। যে ছেলেটি কিছুদিন আগেও পরিবারের গণ্ডির বাহিরে কারো সাথে মিশতে চাইতো না, সে মাত্র ২১ বছর বয়সে অন্য একটি দেশে, নিজের একটি জগৎ গড়ে সেখানে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। প্রেম হচ্ছে, ছাড়াছাড়ি হচ্ছে। যে মডেলদের ছবি হিথের বন্ধুরা ঘরে টানিয়ে ঘুমাতো, তাদেরকে বন্ধুর বাহুডোরে দেখে নিজেরাই অবাক হতো, হিংসে করতো। তবে বন্ধুদের জন্য হিথের বাড়ির ধরজা খোলা থাকতো ২৪ ঘন্টা। তবে হিথের ভেতরের নির্মাতা স্বত্বাটি একদম জন্মগত। ক্যামেরা নিয়ে তার নেশা ছিল মারাত্মক। তার দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘটনা একটি হ্যান্ডিক্যাম দিয়ে তখন থেকেই তিনিই ধরে রাখা শুরু করেন। একটা সময় ক্যামেরাটিই হয়ে ওঠে ডায়েরির মতো।
২০০১ সালে মুক্তি পায় হিথের প্রথম একক সিনেমা A Knight's Tale। নিজের চেহারা পোস্টার হয়ে শহরে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে জিনিসটাতে তিনি জীবনে প্রথম রোমাঞ্চিত বোধ করেন তখন। এর পরে ধীরে ধীরে হিথ হতে থাকেন হলিউডের ‘হার্টথ্রব’। তাকে শতাব্দীর সেরা সুদর্শন পুরুষদের মধ্যে একজন হিসেবেও বিবেচনা শুরু হয়। তবে জীবনের বাঁকে বিশাল মোড়ে পৌছান ২০০৫ সালে। একই বছর প্রায় ৪টি সিনেমা মুক্তি পায় তার অভিনীত। Lords of Dogtown সিনেমাতে অভিনয় করেন নেতিবাচক একটি চরিত্রে। যদিও নির্মাতা প্রথমে তার কাছে ‘হিরো’র ভূমিকায় অভিনয়ের প্রস্তাব নিয়েই এসেছিলেন তবে এই তথাকথিত পর্দার ভালো মানুষ সাজার ইচ্ছাটা আর ছিলো না হিথের। সব থেকে চ্যালেঞ্জিং চরিত্রটা বেছে নেন চিত্রনাট্য পড়ে এবং প্রমাণ করেন তিনি আসলে অভিনেতা হতে এসেছেন, হিরো নয়।
তবে ২০০৫ সাল হিথ লেজারের জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যে সিনেমাটির কারনে সেটির নাম ‘Brokeback Mountain’। হিথ যতদিন জীবিত ছিলেন, এই সিনেমাটিকেই তার সেরা কাজ হিসাবে বিবেচনা করা হতো। দুইজন সমকামী রাখালের জীবনের ভালবাসা, বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়ে এই সিনেমাটি নির্মান করেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম অস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক ‘অ্যাং লি’। সিনেমাটি সে বছর সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে অস্কার জেতে, হিথ লেজার অস্কারের নোমিনেশন থেকে শুরু করে নানা অ্যাওয়ার্ড জিতে নেন। ২০০৫ সালেই তার জীবনে আসেন সহ-অভিনেত্রী মিশ্যাল উইলিয়ামস।
সব কিছুতেই নিজেকে মিডিয়া থেকে আলাদা রাখা মানুষটি সব যায়গায় তার নতুন এই প্রেমিকার প্রতি ভালবাসা জানান মন খুলে। Brokeback Mountain সিনেমাটি তাকে জীবনের সব থেকে বড় দুটি পুরষ্কার দিয়েছে বলে জানান প্রতি মুহুর্তে। একজন হচ্ছে মিশ্যাল এবং অন্যজন তাদের মেয়ে মাতিলদা লেজার। ক্যামেরার পিছনে কাজ করার তৃষ্ণা হিথের ফুরায় না একদমই। নতুন কিছুর জন্য তাঁর ক্ষুধা বাড়তে থাকে প্রতিনিয়ত। তবে দারুণ অশান্ত এই মানুষটি হুট করেই শান্ত হয়ে যান তাঁর মেয়ের জন্মের পরে। হিথের জীবনের সব কিছু ঘিরে জড়িয়ে যায় মাতিলদা। মৃত্যুর ঠিক এক বছর আগে কোন একটি অজ্ঞাত কারনে হিথের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় মিশ্যালের সাথে। I'm Not There সিনেমাটি মুক্তিপায় সে বছর অর্থাৎ ২০০৭ সালে। বিখ্যাত গায়ক বব ডিলানের জীবনের চারটি অধ্যায় নিয়ে নির্মিত সিনেমাটির একটি অধ্যায়ে বব ডিলানের ভূমিকায় অভিনয় করেন হিথ। এর পরপরই নিজের একটি প্রোডাকশন হাউজ খোলার কথা চিন্তা করেন তিনি। নতুন শিল্পীদের সুযোগ দেওয়ার জন্য তিনি নানা ধরনের মিউজিক নিয়ে এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করেন। অভিনয়ের পাশাপাশি তাঁর এই নতুন কোম্পানি তাকে ব্যস্ত রেখেছে বেশ।
ঠিক এই পরিস্থিতিতেই ঘোষনা আসে ক্রিস্টোফার নোলান তার ব্যাটম্যানের দ্বিতীয় খন্ডের কাজ শুরু করবেন খুবই শীঘ্রই আর এই খন্ডে ব্যাটম্যান মোকাবেলা করবে তার চিরশত্রু, ইতিহাসের সেরা ভিলেন দ্য জোকার-কে। ২০০৮ সাল নিয়ে আসে নোলান আর পুরো পৃথিবীর জন্যে কমিকভিত্তিক চলচ্চিত্রের সব থেকে বড় সফলতা। মুক্তি পায় এখন পর্যন্ত কমিক চরিত্র নিয়ে নির্মিত ইতিহাসের সব থেকে সেরা সিনেমা 'The Dark Knight (দ্য ডার্ক নাইট)'। পর্দায় মানুষ দেখতে পায় শতাব্দীর সেরা ভিলেন, ব্যাটম্যানের আজীবন শত্রু 'জোকার'-এর এক অনবদ্য অভিনয়। সব সফলতাই কারও না কারও জীবনের বিশাল স্যাক্রিফাইজ- এমনটা যেমন নোলান তার আগের নানা সিনেমায় বর্ণনা করেছেন, ঠিক তেমনিভাবে ডার্ক নাইটেও নির্মাণ কৌশলে এক বিরল উদাহরণ সৃষ্টি হয়।
জোকারের মতো একটি জটিল, সাইকোপ্যাথ আর হিংস্র চরিত্রে অভিনয় করার জন্যে হিথ নিজেকে গৃহবন্দী করে ফেলেন। শুটিং চলাকালীন সময়ে মাত্র ২ ঘন্টা ঘুমানোর কারণে আর চরিত্রে ঢোকার চেষ্টায় হিথ নানা ধরনের ড্রাগ আর মেডিসিনের আশ্রয় নেন। মাত্র ২৮ বছর বয়সী হিথের সাথে নোলানের সম্পর্ক ছিল অন্যরকম। এমনকি সিনেমাটির বেশ কয়েকটি অংশের পরিচালনা হিথ নিজে করেছেন। সিনেমার শুটিং শুরু হওয়ার আগে নোলান যখন জোকারের চরিত্রে হিথকে নেওয়ার কথা ঘোষণা দেন তখন ব্যাটম্যান ভক্তরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। কিন্তু সিনেমাটির মুক্তির পর ইতিহাস বদলে যায় আর বদলে যায় নোলানের ভাগ্যও। সিনেমাটি বক্স অফিসে আয় করে ১ বিলিয়ন ডলারের উপরে। সর্বকালের সর্বোচ্চ আয়ের তালিকায় স্থান করে নেয় দ্যা ডার্ক নাইট। সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার ঠিক মাস তিন আগে, ২২শে জানুয়ারি, ২০০৮ সালে মারা যান হিথ, একা। নিজের ঘরে, নিজের বিছানায়। ময়নাতদন্ত বলে, নানা ধরনের ঔষধের ওভারডোজ আর ক্যামিক্যাল রিয়েকশন তার মৃত্যুর কারণ।
প্রথমবারের মতো কোন কমিক চরিত্রে অভিনয় করার জন্যে কেউ অস্কার লাভ করে সেই বছর। এমনকি সেই বছরের যাবতীয় পুরস্কারে একটা নাম বারবার উঠে আসে, 'হিথ লেজার'। মিডিয়ার নানা ক্ষেত্র দাবী করে হিথের মৃত্যুর জন্যে কোন না কোন অংশে জোকার চরিত্রটি দায়ী। ক্রিস্টোফার নোলানকেও পড়তে হয় নানা প্রশ্নের সম্মুখে। যদিও হিথের পরিবার বারবারই বলেছে, তাদের ছেলের মৃত্যুর সাথে নোলান বা জোকারের কোন সম্পর্ক নেই। পুরো ব্যাপারটিই দুর্ঘটনা। বন্ধুর প্রতি সম্মানের কারণেই নোলার তার পরবর্তী ব্যাটম্যান সিকুয়াল 'The Dark Knight Rises (দ্যা ডার্ক নাইট রাইজেস)-এ জোকার চরিত্রটির কোন ব্যবহার করেননি।
ধারণা করা হয় মাত্র ৩টি সিনেমার পরেই নোলান এই থ্রিলোজি ছেড়ে দেওয়ার পিছনে হিথের মৃত্যু একটি বড় কারণ। অথচ এই বিশ্বখ্যাতির ছোঁয়া মানুষটি অনুভব করতে পারেননি, তিনি সম্ভবত সেটি কোনদিন চেয়ে দেখেননি। জোকারের চরিত্রে হিথের অভিনয়কে শুধু অভিনয় বললে পৃথিবীর সেরা একটি ‘সৃষ্টি’-কে অসম্মান করা হবে। নিজের সৃজনশীলতা, পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে পুরো চরিত্রটিই হিথের সৃষ্টি। জোকার মানুষ হিসাবে একজন আনপ্রেডিক্টেবল রাক্ষস তবে কোথাও না কোথাও পর্দার ঐ আড়ালে, সাদা মেকাপ আর ভয়ংকর হাসির আড়ালে হিথ একদম জলজ্যান্তভাবে জীবিত। এর থেকে বড় সৃষ্টি আর কি হতে পারে? এর থেকে জলজ্যান্ত হয়ে বেঁচে থাকার উপায় আর কেই বা জানে? মানুষটি নেই আজ পুরো ১১ বছর। কিন্তু ‘দ্যা ডার্ক নাইট’ খুলে দেখুন, হিথ জীবন্ত, হেসে হেসে বলছে, ‘why so serious?’