মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী আজ বলেছেন, রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তির ব্যাপারে নাকি তিনি জানতেন না! চলুন জেনে নেই, একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়েও আর কী কী তিনি জানতেন না!
করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পরেই বিভিন্ন সব মানুষজনের বিচিত্র সব কর্মকাণ্ড চোখের সামনে এঁটুলির মত সেঁটে যাচ্ছে। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিষয়টি যেমন। একটা ঘটনার পরে তাকে বেশ মনে ধরে যায় আমার। বেসরকারি এক টিভি চ্যানেলের প্রোগ্রামে তিনি ভিডিও কলে যুক্ত হয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক যখন শক্তপোক্ত কিছু প্রশ্ন করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককে চেপে ধরেছেন, আমি তখন বেশ উৎকন্ঠায়- স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রশ্নের এই বাউন্সার আটকাবেন কীভাবে! এরপর আমার দূরতম কল্পনাতেও যেটা আশা করিনি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী সেটাই করে বসলেন। হুট করে ভিডিও কলের সংযোগ কেটে দিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। এখন প্রশ্ন কমন পড়েনি দেখে এই টেকনিকটা তিনি এ্যাপ্লাই করেছেন, নাকি আসলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো, সে আলোচনায় যাচ্ছি না। গেলেও খুব একটা ফল আসবেনা। তবে বিষয়টিতে মজা পেয়েছিলাম বেশ। তাছাড়া ছেলেমেয়ে তো ট্রল করে এই ক্লিপটিকে "The Greatest Escape of the History" বলে ভাইরালও করে দিলো সোশ্যাল মিডিয়াতে।
যাক, স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ভালো লাগার পেছনে আরেকটি কারণ হলো, উনি অনেক কিছুই জানেন না। সেটাও সমস্যা না। সবাইকে শমজান্তা শমসের হতেই হবে এমন মাথার দিব্যিও তো কেউ দেয়নি। তবে যেসব বিষয়ে ওনার জানা উচিত ছিলো, সেসব বিষয়েও ওনার অজ্ঞতা একটু অবাক করে বৈ কী। যাই হোক, বেশি কথা না বলে, কী কী উনি জানতেন না, সেটার একটা তালিকা দেখি বরং আমরা-
১. রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের চুক্তির বিষয়ে কিছু জানতেন না স্বাস্থ্যমন্ত্রী
রিজেন্ট হাসপাতাল এবং তার পরিচালক সাহেদ করিমকে নিয়ে মিডিয়ায় তোলপাড় হচ্ছে বেশ কদিন ধরেই। মিডিয়ার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, রিজেন্ট হাসপাতালের সাথে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের একটি সমঝোতা চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিলো। যে চুক্তিতে বলা হয়, রিজেন্ট হাসপাতালের দুটি শাখাকে "কোভিড হাসপাতাল" হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখন বলেন তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না, তখন আমরাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই, উনি না জানলে, আসলে জানেটা কে?
২. ন্যাশনাল কমিটি ফর্ম করা হয়েছে এবং সেই কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে, সে বিষয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে তিনি কিছু জানতেন না
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভাষ্যেই শোনা যাক নাহয়,
একটা ন্যাশনাল কমিটি ফর্ম করা হয়েছে। সেই ন্যাশনাল কমিটির চেয়ারম্যান আমাকে করা হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে। কিন্তু ন্যাশনাল কমিটিতে যে সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে। সেগুলো আমাদের নলেজে নেই।
একজন মানুষকে "জাতীয় সমন্বয় কমিটির" চেয়ারম্যান করা হয়েছে, অথচ তিনি জানেনই না কমিটির কাজগুলো হচ্ছে কী না, কমিটি কী কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আর সে সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়ন হচ্ছে কী না। আমরা আবারও দোটানায় পড়ে যায়।
৩. কখন ফ্যাক্টরী খোলা হবে কী হবে না, সেটা স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানতেন না
পুরো দেশজুড়ে লকডাউন চলছিলো। সেসময়ে হুট করে পোষাক-কারখানাগুলো খুলে দেয় কারখানার মালিকেরা। শ্রমিকেরা গন-পরিবহন না পেয়ে পায়ে হেঁটে, কিছুপথ সিএনজি, কিছুপথ নৌকায়, চার-পাঁচদিন এবং হাজার হাজার টাকা খরচ করে ঢাকায় আসেন। অথচ স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তিনি এটা জানতেন না। যে তথ্যটা বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি মানুষ জানতো, সেটা তিনি কেন জানতেন না, তাও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
৪. কখন মসজিদে নামাজ হবে এবং কীভাবে হবে, সেই বিষয়েও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানতেন না
তিনি এমন একটি দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, যেদেশে ঘনবসতির কারণে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা আসলেই দুরূহ একটি কাজ৷ আবার এ দেশের মানুষও যথেষ্ট উদাসীন নিয়মকানুন মেনে চলার ব্যাপারে। সেরকম উসাদীন দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে যতটুকু সচেতনতা বা তৎপরতা আমরা আশা করি, তা আমরা পাই না তার থেকে। তিনি জানেনই না মসজিদে নামাজ হবে কী না, মানুষ উপাসনালয়ে আসবে কী না, গনজমায়েত হবে কী না। এটা যখন প্রথম শুনি, ওনার মুখেই শুনি, হাসতেও ভুলে গিয়েছিলাম। এতটাই চমকে গিয়েছিলাম।
৫. রাস্তাঘাট কখন খুলে দেয়া হবে, তা তিনি জানতেন না
কবে লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে, কবে আবার লকডাউন দেয়া হচ্ছে, কোন কোন এরিয়াকে রেড জোন করা হচ্ছে- সেগুলোর কিছুই তিনি জানতেন না। বিষয়টি নিজেই তিনি স্বীকার করেছেন সংবাদ সম্মেলনে এসে। এরপর করেছেন অভিমানও। তাকে কেউ কিছু জানায় না, বিদেশের সাংবাদিকেরা তাকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে তিনি উত্তর দিতে পারেন না, এটাই তার মনোবেদনার কারণ। অথচ স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে এগুলো শুধু জানা না, এগুলো নিয়ে সুচিন্তিত মতামত দেয়ারও কথা ছিলো তার।
৬. করোনায় মৃতের সংখ্যাও তিনি জানতেন না
করোনায় রেকর্ড মৃত্যুর দিন (জুন ৩০, চব্বিশ ঘন্টায় ৬৪ জন মারা গিয়েছিলেন) সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এসে বলেন, বাংলাদেশে মৃত্যুহার নাকি কম। এজন্যে তিনি বেশ উৎফুল্লও হন। অথচ তিনি জানতেনও না, সেদিনই সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ মারা গিয়েছেন করোনায়। কয়জন আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিদিন, করোনায় মৃত্যুর সমীকরণটা কীভাবে দিনদিন উর্ধ্বমুখী হচ্ছে, কীভাবে শোচনীয় হচ্ছে মানুষের জীবন, সে নিয়ে কোনো ধারণাই রাখেননি তিনি।
৭. দেশে কয়টি পিপিই আছে জানতেন না স্বাস্থ্যমন্ত্রী
মার্চের শুরুর দিকে যখন আস্তে আস্তে করোনা বিস্তৃত হচ্ছে ক্রমশ, তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, আগেই নাকি দেশে ছিলো ৪০০ টি আইসিইউ। এরপর আরো ২৫০ টি আইসিইউ আনেন তারা বিদেশ থেকে। অথচ জানা যায়, তখন সরকারি- বেসরকারি মিলিয়ে আইসিইউ ছিলোই মাত্র ১১২ টি!
৮. জনসমাগম কীভাবে এড়াতে হয়, জানতেন না স্বাস্থ্যমন্ত্রী
সবাইকে জনসমাগম এড়াতে বলে নিজেই লটবহর নিয়ে চলে গিয়েছিলেন শিশু হাসপাতালে। শতাধিক মানুষ নিয়ে হাসপাতালের "ডায়াবেটিস টাইপ- ওয়ান শিশুদের জন্যে ৬ সীটের একটা কর্ণার" উদ্বোধন করতে যান তিনি। অর্ধশতাধিক শিশুর এই ওয়ার্ডে দেড়শো মানুষ নিয়ে হল্লা করা কতটুকু যৌক্তিক, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অনেকে। তাছাড়া ৩৭ জন মানুষকে নিয়ে একত্রে সংবাদ-সম্মেলন করা এবং তা নিয়ে পরবর্তীতে তীব্র বিতর্কিত হওয়া তো আছেই।
৯. অফিসে নিয়মিত আসা উচিত, এটা জানতেন না স্বাস্থ্যমন্ত্রী
নিজের মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত আসতেন না স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সাংবাদিক এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে বলেন, আমি যেখানে বসবো, সেটাই অফিস। অর্থাৎ নিয়মিত যে অফিসে আসা উচিত, সেটাও জানতেন না তিনি।
এছাড়া আরো বিচিত্র সব কাণ্ড আছে তাকে নিয়ে। পিপিই কে "পিপিপি" বলা, দেশে যখন ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে সপরিবারে তখন মালয়েশিয়া চলে যাওয়াসহ বেশ মুখরোচক ঘটনা আছে তাকে নিয়ে। সেগুলো নিয়ে হয়তো বিস্তারিত লেখা যাবে কোনো একদিন। শেষ করা যাক, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে নিয়ে করা সুনামগঞ্জ- ০৪ আসনের সাংসদ পীর ফজলুর রহমানের উক্তিতে, উক্তিটি তিনি বাজেট পাশের দিন সংসদে করেন-
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মিনা কার্টুনে পরিণত হয়েছে, টিয়া পাখি দিয়ে চলছে সব কিছু
এরপরে আর কিছু বোধহয় না বললেও চলে। সমঝদারের জন্যে ইশারাই তো যথেষ্ট।
_
* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে