আচ্ছা, ব্রেক ফেল করা একটা গাড়ির মতো অপ্রতিরোধ্য ভারতীয় টেকটোনিক প্লেট যদি জগদ্দল ইউরেশিয়ান প্লেটে জোরে ধাক্কা মারে, তাহলে কী ঘটতে পারে বলুন তো?
ছোটোখাটো কোন ঘটনা হলেতো কথাই ছিলো না, কিন্তু এর ফলে ঘটে গেছে মহাপ্রলয়, চিরতরে বদলে গেছে পুরো পৃথিবী। পৃথিবীর বুক চিরে উঠে এসেছে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। সেই সংঘর্ষের কারনেই আজো ঘটে চলেছে নেপালের সেই ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পের মত ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলা।
আইসবার্গের সাথে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যাওয়া সেই টাইটানিকের গল্প তো অনেক শুনেছেন। এখন আস্ত একটা উপমহাদেশের বিশাল জাহাজের মতো করে ভেসে এসে এক ধাক্কায়, গোটা দুনিয়ার চেহারাটা বদলে দেয়ার গল্পটা শুনতে চান? চলুন, তাহলে শুরু করা যাক।
প্লেট টেকটনিকসের কারণেই ভারত মহাদেশীয় পাতটা সেই অস্ট্রেলিয়া পার হয়ে দক্ষিণ মেরুর কাছ থেকে, মহাসাগরে ভাসতে ভাসতে এসে, ৫ কোটি বছর আগে, ইউরেশীয় পাতের সাথে ধাক্কা খেতে শুরু করেছিল। আর কোটি কোটি বছর ধরে সেই দুনিয়া কাঁপানো সংঘর্ষে দেড় হাজার মাইল জুড়ে গজিয়ে উঠছে হিমালয় পর্বতমালা।
পৃথিবীর ওপরিভাগটা যে অনেকগুলো ভূতাত্ত্বিক পাত বা প্লেট দিয়ে তৈরী, সেটা তো সবাই জানেন। এই প্লেটগুলো সর্বক্ষণই একে অন্যকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে চলেছে, ধাক্কার পরিমাণ বেড়ে গেলে ভূপৃষ্ঠের ওপরিভাগে ভূকম্পন অনুভূত হয়, এগুলো সবই জানা কথা। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংঘর্ষটা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে। আর সেই সংঘর্ষের ফলেই উৎপত্তি হয়েছিল আজকের এই সুবিশাল হিমালয় পর্বতমালার। আমরা যে বঙ্গীয় বদ্বীপে বাস করছি, সেটাও কিন্ত সেই সংঘর্ষেরই ফল!
প্রায় পঞ্চান্ন কোটি বছর আগে পৃথিবীর প্রায় পুরোটা স্থলভাগ ছিল একসঙ্গে, সেটার নাম বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন গন্ডোয়ানাল্যান্ড। ইউরেশিয়া (ইউরোপের অনেকটা অংশ+এশিয়ার বেশ খানিকটা অংশ যে প্লেটের ওপর দাঁড়িয়ে) প্লেটটাও পরে এসে যুক্ত হয়েছিল এই স্থলভাগের সঙ্গে, তখন সেই অতি-মহাদেশটির নাম হয় প্যানজিয়া। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ কোটি বছর আগের কথা বলছি। প্লেট টেকটোনিক্সের কারণে আবার তারা একসময় ভাঙতে শুরু করলো, হয়ে গেল আলাদা আলাদা। আঠারো কোটি বছর আগে ভারত মহাদেশীয় প্লেটটিও ভেঙে যায় গন্ডোয়ানাল্যান্ড থেকে। তখন আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থান ছিল দক্ষিণ মেরুতে, এন্টার্কটিকা মহাদেশ এখন যেখানে, সেই জায়গায়।
সেখান থেকে শুরু হয়েছিল ভারতীয় মহাদেশীয় প্লেটের উত্তরমুখী একটা যাত্রা। সাত কোটি বছর ধরে চলেছে সেই যাত্রা, এই সময়ে ভারতীয় প্লেটটি অতিক্রম করেছে নয় হাজার কিলোমিটার দূরত্ব! স্বাভাবিকের চেয়ে চার গুণ বেশি গতিতে উত্তরের পথে এগিয়েছে ভারতীয় প্লেটটি, যাত্রা শুরুর সাত কোটি বছর পরে প্রায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ইউরেশিয়া প্লেটকে সেটি ধাক্কা দিয়েছে ভীষণ জোরে। আর সেই মহা সংঘর্ষের কারণে জন্ম হয়েছে এভারেস্ট, অন্নপূর্ণা আর কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো বিশাল সব পর্বতশৃঙ্গের।
সাত কোটি বছর ধরে ভেসে এসেছে ভারতীয় প্লেটটি, তাতে চড়ে ভেসে এসেছে কোটি কোটি প্রাণী, তাদের একেকটা একেক রকমের, একেক গোত্রের। বিবর্তনের শিকার হয়েছে তারাও, ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ আর পরিস্থিতির মোকাবেলা করে কেউ টিকে থেকেছে, কেউবা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ডাঙায় ঘুরে বেড়ানো চারপেয়ে একটা স্তন্যপায়ী প্রাণী তিমি যেমন বিবর্তনের অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে পরিণত হয়েছে জলজ প্রাণীতে। সংঘর্ষের পরে দুটো স্থলভাগ যখন এক হয়ে গেল, তখন এই প্রাণীগুলো ছড়িয়ে পড়লো দুই প্লেটের ওপরিভাগে, ইউরেশিয়ার কিছু প্রাণী চলে এলো ভারতীয় প্লেটের ওপরে, ভারতীয় প্লেটের অনেক প্রাণী চলে গেল ইউরেশিয়ায়। প্রাকৃতিক পরিবেশের এমন বিচিত্র মিশ্রণ এর আগে-পরে আর কখনও বোধহয় ঘটেনি।
এই একটা সংঘর্ষ পুরো পৃথিবীর জলবায়ুকেও বদলে দিয়েছে। বাংলাদেশের মৌসুমি বৃষ্টিপাতের কারণ কিন্ত হিমালয় আর পামীর মালভূমির কারণে জমা মেঘগুলো। আড়াই কোটি বছর ধরে হিমালয় ক্ষয় হচ্ছে ধীরে ধীরে, সেখান থেকে পানির স্রোতে ভেসে আসা পাথর আর পলিগুলো জমাট বেঁধে তৈরি হয়েছে বঙ্গীয় বদ্বীপ, যেখানে বাস করছি আমরা এখন। এই সংঘর্ষের কারণে কমেছে পৃথিবীর তাপমাত্রাও, হিমালয়ের মাথা তুলে দাঁড়ানোর ফলেই উত্তর আর দক্ষিণ মেরুতে জমেছে বরফ, পৃথিবী হয়েছে মানুষের বসবাসের উপযোগী।
এতক্ষণ যে সংঘর্ষের গল্পটা পড়লেন, এই বিজ্ঞানভিত্তিক গল্পটা শুনিয়েছে থিংক বাংলা নামের একটা ইউটিউব চ্যানেল। 'থিংক বাংলা' মূলত শিক্ষামূলক ভিডিও নির্মাণকারী চ্যারিটি সংগঠন, অথবা এর চেয়েও বেশি কিছু। বিজ্ঞান নিয়ে ইউটিউবের বাংলা প্ল্যাটফর্মে বলার মতো কোন কাজ হয়নি এখনও, সহজ ভাষায় বিজ্ঞান, দর্শন, ক্যারিয়ার কিংবা আরও নানা বিষয়কে ব্যাখ্যা করার মতো প্ল্যাটফর্ম নেই বললেই চলে। এমন পরিচ্ছন্ন, গোছানো এবং মানসম্মত কাজ বাংলা ভাষায় ইউটিউবে কখনও চোখে পড়েনি। বন্যা আহমেদ হেসে হেসে কেউ একদম ঝরঝরে বাংলায় পৃথিবীর বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করছেন, আর পর্দায় ভেসে উঠছে ভিজ্যুয়াল গ্রাফিক্সগুলো- এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম।
ইংরেজী এবং বাংলা, দুই ভাষাতেই রয়েছে থিংকের চ্যানেল। পেছনে আছে একদল উদ্যমী আর প্রানচঞ্চল তরুণ, যারা দর্শকের অনুসন্ধিৎসু মনের সহযাত্রী হতে চায়, চায় তাদের বানানো কন্টেন্টের মাধ্যমে আপনার মনে নতুন চিন্তার খোরাক যোগাতে, আরও একটু ভাবাতে, জ্ঞানচর্চার সহজাত কৌতুহলে আনন্দের রঙ মেশাতে। থিংকের এই যাত্রায় চাইলে সহযাত্রী হতে পারেন আপনিও, এই লিংকে গেলেই পাওয়া যাবে তাদের ইউটিউব চ্যানেলটি, সাবস্ক্রাইব করে আজই হয়ে যান থিংক পরিবারের একজন।
থিংকের 'হিমালয় কীভাবে বদলে দিলো পৃথিবী?' শিরোনামের ভিডিওটি দেখতে হলে ক্লিক করুন এই লিংকে- https://www.youtube.com/watch?v=b-oFBSJJCik
বাংলা ইউটিউব চ্যানেলঃ www.youtube.com/ThinkBangla
ইংরেজি ইউটিউব চ্যানেলঃ www.facebook.com/ThinkEnglishVideos/
বাংলা ওয়েবসাইটঃ www.thinkschool.org/bangla
ইংরেজি ওয়েবসাইটঃ www.thinkschool.org