ছোট সাইজের ট্রলারের ভাড়া হাঁকালেন ১২ হাজার, সবশেষ সাড়ে সাত! অথচ আগে যারা ঘুরে এসেছেন, এমন সাইজের ট্রলারের ভাড়া দিয়েছেন সাড়ে সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চারের বেশী না। হাওরে যাবার মত ট্রলার নেই, এমন সুযোগ বুঝেই যে তিনি এমন দাম হাঁকিয়েছেন সেটুকুও বোঝা হয়ে গেলো। হরি তালুকদারই শেষ ভরসা।

সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে যারা গিয়েছেন, তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়- হাওরের কিংবা গোটা ট্রিপের কোন ব্যাপারটি সবচেয়ে বেশী আন্দদায়ক কিংবা মনে রাখার মত? নিঃসন্দেহে উত্তরটি আসবে, ট্রলারে ভেসে হাওরে চড়া ও হাওরে রাত কাটানো। আর টাঙ্গুয়ার হাওরে যারা যাবেন। তাদের সবারই প্রথম চিন্তাজুড়ে থাকে, ট্রলার পাওয়া যাবে তো? ট্রলার কেমন হবে? ভাড়া কত নিবে? ঠকাবে নাতো? নিয়মিতই যারা দেশ চষে বেড়ান, দেশের পর্যটন এরিয়ায় যাদের নিয়মিত আনাগোনা- তারা জেনে থাকবেন অপরিচিত স্থান বলে কতটা ভোগান্তি পোহাতে হয়। কাঁধে ব্যাগ দেখলে, কিংবা একটু সুযোগ পেলেই সেখানে ‘ঠকানো’র প্রবণতা কেমন! তবে আজকের গল্পটা উলটো, গল্পটা ‘ঠকানো’র বদলে প্রচন্ড মানবিক ও সহায়ক একজন মানুষের। যিনি হাওরে ট্রলার চালান, সে ট্রলারে করে পর্যটক নিয়ে ঘুরেন। ‘ট্রাভেলার্স অফ বাংলাদেশ’ গ্রুপ ঘুরেফিরে হাওরের প্রতি কেমন একটা অদ্ভুত টান পড়েছে বছর দুয়েক হবে। যাওয়া হচ্ছিলো না নানান জটিলতায়, বার কয়েক প্ল্যানও ক্যান্সেল হয়েছে। এবারও ক্যান্সেল হয়েছে, প্রচন্ড হতাশা! শেষ অব্দি পিড়াপীড়িতে একজনকে তো জ্বর সহই ঘর থেকে বের করে হাওর ঘুরে এসেছি। আমি প্রতিবারই ফেরার সময় কিছু গল্প নিয়ে ফিরি, কারণ আমি জীবন দেখি। মানুষ দেখে শিখি। এবার যাকে দেখে শিখেছি, তার নাম হরি তালুকদার।

হরি তালুকদার হাওরে ট্রলারে করে পর্যটক বয়ে বেড়ান, ঘুরিয়ে দেখান নিলাভ জলরাশির টাঙ্গুয়ার হাওর। হরির নাম্বার আমরা পেয়েছি ট্রেনে। হাওর এক্সপ্রেসে চেপে আমাদের প্ল্যান মোহনগঞ্জ হয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর। ট্রেনেই একজন জানতে চাইলো আমাদের গন্তব্য সম্পর্কে। গন্তব্য জানানোর পর বললো, তার কাছে ভালো একটি ট্রলারের নাম্বার আছে। ঘাটে প্রচুর ট্রলার থাকে তেমনটাই আমাদের জানা ছিলো, তাই কিঞ্চিৎ অবহেলায়ই আমরা টুকে নিলাম সে নাম্বার। উদ্দেশ্য, যদি কাজে লেগে যায়! মোহনগঞ্জ থেকে বাইকে চেপে মধ্যনগর নেমে কপালে হাত, গোটা হাওরঞ্চল জুড়েই নাকি লেগেছে বিয়ের ধুম! হাওরের একমাত্র যান ট্রলার। বিয়েতে বরযাত্রী কিংবা বৌ-ভাত খেতে যারা যাবেন, তারা নাকি ১৭০ এর বেশী ট্রলার ভাড়া করে রেখেছেন। তাই ঘাটে নেই কোন ট্রলার। ঘড়িতে তখন ৮ টা। ফোন করা হলো অবহেলায় নাম্বার নেয়া হরিকে। তিনি তখন পর্যটক নিয়ে হাওরে, ফিরতে সন্ধ্যা হবে। ঢাকা থেকে যদিও আমরা দুইদিন সময় নিয়েই বের হয়েছি, তবুও হাওরের এত কাছে এসে অপেক্ষা করতে কার মন চায় বলুন! স্থানীয় দালাল গোছের কয়েকজন জানালেন, তাদের পরিচিত একটি ট্রলার আছে সেটিতে চড়তে। তাকে ডাকা হলো, তিনি আসলেন সেও প্রায় দেড়-দুইঘন্টা দেড়িতে। ছোট সাইজের ট্রলারের ভাড়া হাঁকালেন ১২ হাজার, সবশেষ সাড়ে সাত! অথচ আগে যারা ঘুরে এসেছেন, এমন সাইজের ট্রলারের ভাড়া দিয়েছেন সাড়ে সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চারের বেশী না। হাওরে যাবার মত ট্রলার নেই, এমন সুযোগ বুঝেই যে তিনি এমন দাম হাঁকিয়েছেন সেটুকুও বোঝা হয়ে গেলো।

হরি তালুকদারই শেষ ভরসা। ফোন করে জানানো হলো ঘাটের অবস্থা। ট্রলার পাওয়া যাচ্ছে না জেনেও ভাড়া নিয়ে কিঞ্চিৎ দামাদামিতেই রাজি হয়ে গেলেন, আসবেন বিকেলে। বিকেল পর্যন্ত থাকার জন্য নিজেই মধ্যনগরে থাকার মত একটা রুম কয়েক ঘণ্টার জন্য ব্যবস্থা করে দিলেন, অবশ্যই কম দামে। যেখানে জিরিয়ে বিকেলে হরির সাথে আমাদের প্রথম দেখা, সঙ্গে তার হরেক রঙে রাঙানো-সাজানো ট্রলার। বাজার হলো, রান্না আমরা নিজেরাই করবো। হরির সাথে পরিচয় শেষে আমরা ৯ জন চেপে বসলাম ট্রলারের ছাদে, শুরু হলো যাত্রা। কয়েকটা দিন ট্রলারে কাটিয়ে দেয়ার জন্য যা কিছু লাগে তার সবকিছুই আছে এই ট্রলারে। রান্নার জন্য চুলা, হাড়ি-পাতিল, খাবারের প্লেট। মোবাইল চার্জ করার জন্য সোলার চার্জার। ট্রলারের ছাউনির নিচে ফ্যান, আলোর ব্যবস্থা। ট্রলারের পিছনে টয়লেট, সবই আছে এতে।

হাওরের পানি কেটে ট্রলার যেতে যেতে গল্প হচ্ছিলো হরির সাথে। জিজ্ঞেস করলাম কিভাবে এলেন ট্রলারে? জানালেন, পাঁচ বছর ধরে চালাচ্ছেন ট্রলার। আমরা যেটিতে চড়েছি, এটি কিনেছেন পুরাতন। দুই লাখ মতন টাকায় কেনা ট্রলার নিজে নতুন করে রঙ করে সাজিয়েছেন পর্যটকদের ভ্রমণে প্রশান্তির জন্য। থাকেন মধ্যনগরে। সকালে বেড়িয়ে পড়েন কখনো মধ্যনগর ঘাট, কখনও তাহিরপুর ঘাটের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে আমাদের মত যাদের পান, তাদের নিয়ে ছুটে যান হাওরে। পরিবার রেখে হাওরেই রাত কাটান পর্যটকদের সাথে। পরিবারের কথা জানতে চাইলাম। বললেন, বিয়ে করেছেন, একটি বাচ্চা আছে। বাবা মারা গেছেন এক বছর আগে, মা সহ থাকেন এক সাথেই। মজার ছলেই জিজ্ঞেস করলাম, এভাবে দিনের পর দিন ঘর ছেড়ে থাকেন বউ চলে যায় না? শুনে হাসলেন। আমাদের নিয়ে যে রাত থেকেছেন, তার আগেও দুই রাত বাড়ি ফিরেননি। হাসি যেন বলছে, জীবিকা যখন ঘরের বাইরে থাকার, তখন বাইরে যে আমার থাকতেই হবে! টাঙ্গুয়ার হাওর না থেমে আমরা সোজা চলে যাবো টেকেরঘাট, সেখানেই রাত্রি হবে যাপন। হাওরে তখন রাত নেমেছে, নিচে রান্নার প্রস্তুতি চলছে আমাদের। বাউলি নদীর এক তীরে ট্রলার ভেড়ানো হলো, রান্নায় আমাদের সাথে হাত লাগালো হরিও। ট্রলারের মাঝি ও আমরা যে আলাদা, এই তফাৎটুকু না চাইতেই ঘুচে গেল। ট্রলার চলছে টেকেরঘাটের উদ্দেশ্যে, ভিতরে রান্না চলছে। রাত আটটায় পৌছালাম সেখানে। খানিকটা গান-বাজনা করে খেতে বসলাম রাত দশটায়। হরি নিজেই এগিয়ে এসে প্লেটে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। যেন তার ঘর, বেড়াতে আসা মেহমান আমরা।

ট্রলারে শুয়ে শুয়ে বাইরের এমন চমৎকার ভিউ দেখা যাবে।[/caption] সকালে বাইক ঠিক করে দিলেন, নিলাদ্রী লেক-শিমুল বন-জাদুকাটা নদী-বারেক টিলা-লাকমাছড়া ঘুরে দেখার জন্য। একা তাকে ট্রলারে রেখে যেতে মন চাইলো না, সঙ্গে নিয়ে নিলাম আমাদের। যদিও তার সব চেনা, তবুও আমাদের সাথে ঘুরলো সবকিছু। হরিসহই যেন আমাদের দল! ঘুরা শেষে ফেরা পথে জানার ইচ্ছে হলো, হাওরের এই বর্ষা মৌসুম শেষে কি করেন হরি। জানালেন, জ্যৈষ্ঠ থেকে কার্তিক অব্দি চালান এই ট্রলার। আছে জমি চাষ করা দুটি পাওয়ার টিলার, আছে ধান ভানার মেশিন। সেগুলো ভাড়ায় খাটান, নিজেও কাজ করেন সাথে। মধ্যনগর বাজারের কাছাকাছি তখন ট্রলার, এমন বিস্মৃত শান্ত জলের হাওর ছেড়ে ফিরতে হচ্ছে ভেবেই মন খারাপ করছিলো। হরির তখন ট্রলারের পিছনে বসা, ট্রলারের গতিপথ সামলাচ্ছিলেন। আচমকা বলে উঠলেন, “কত মানুষই তো উঠে ট্রলারে, এমন আন্তরিকতা খুব কম দেখেছি মানুষের।” তাকে বুঝালাম, এটিই স্বাভাবিক হওয়া উচিত ছিলো। এমনটা সচরাচর হয়নি বলে, পেলে মনে হয় এটি বুঝি বিশাল কোন কিছু! হরি বুঝলো কিনা কে জানে।

প্রাইমারিও শেষ না করা হরিকে বলছিলাম, “তাকে ট্রলারের নামে ফেসবুকে পেজ খুলে দিলে সেখান থেকে মানুষ তার নাম্বার পাবে, ফোনে ঢাকা থেকেই ট্রলার ভাড়া পেয়ে যাবে।” রাস্তা টাঙানো সাইনবোর্ডে যেমন বিজ্ঞাপন দেয়, ফেসবুক পেজটাও তেমন বিজ্ঞাপন- এসব শুনে, এভাবেও ট্রলার ভাড়া হতে পারে জেনে অন্ধকারেই হরির মুখটা কেমন চকচকে হয়ে গেল। হরি অভাবী না, তবে প্রযুক্তি থেকে দূরে। তাই এভাবেও ট্রলার ভাড়া হতে পারে বিষয়টা তার জন্য নতুন কিছুই বটে। ট্রলার ছেড়ে ঘাটে উঠার সময় হরিকে বলছিলাম, এখানে বিয়ে করে বেড়াতে আসার উছিলায় অনেকদিন থাকতে আসা যাবে। শুনেই হরির ঝটপট উত্তর, “আরেকদিন থেকে যান না। আর বিয়ে করতে হবে কেনো? এদিকে এলে আমাদের বাড়িতে থাকবেন, যতদিন মন চায় ততদিন।” হরির কথা শুনে অবাক হইনি, মুগ্ধ হয়েছি। আমি শুনেছি, হাওরাঞ্চলের মানুষ এটেল মাটি আর পানি মিশ্রিত নরম কাদার মত মনের, তাকে দেখে সেটুকুও নিশ্চিত হলাম। এরপর ট্রেন ছেড়েছে কিনা, কিংবা তার ঠিক করে দেয়া মাহেন্দ্রা ঠিকঠাক মত ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছে কিনা জানার জন্য একজন ‘ট্রলারের মাঝি’ যখন ফোন দিয়ে জানতে চায়- নতুন কোথাও থেকে ফেরার পথে কিংবা তার অনেক দিন বাদেও আমাকে কেবল সেখানকার এইসব মানুষ নিয়েই ভাবায়। ভাড়া চুকিয়ে দেয়ার পরই কার্যত তার সাথে আমাদের হাওরে সম্পর্ক শেষ, তবুও “ঢাকায় ঠিকঠাক নেমেছি?” কিনা এমন খোঁজ নেয়ার ব্যাপারগুলো নতুন করে শেখায়- কিছু সম্পর্ক এমনও হয়, কয়েকটা ঘণ্টায়ও টান পড়ে যায়।

হরির ‘শান্তা নৌ পরিবহন’- এ বছরই নতুন আরেকটি ট্রলার বানাবেন, খরচ করবেন ১০ লাখ টাকা। আগামী বর্ষায়ই নাকি সেটি হাওরে নামাবেন, ঘুরবেন পর্যটক নিয়ে। বর্ষাকালীন হাওর ভ্রমনের সময় প্রায় ফুড়িয়ে এসেছে, পানি কমে গেছে অনেকটুকুই! এই সিজনের হাওর ভ্রমণ চলবে আর হয়তো মাসখানেক।  হারি তালুকদারের ট্রলারে চেপে হাওর ঘুরতে চাইলে, এই নাম্বার দুটি (০১৬১১৭১৬৯১৩, ০১৭২১৭১৬৯১৩) টুকে রাখতে পারেন। ঢাকা থেকেই ফোন করে নিশ্চিত করে রাখতে পারেন আগে থেকেই। আপনার নিরাপদ হাওর ভ্রমণে সঙ্গী করতে পারেন হাওরের মাটি-পানির নরম মানুষ হরিকে। আপনার ভ্রমণ হোক আনন্দময়, আপনার স্মৃতেতে টইটুম্বুর থাকুক টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ।

হরি তালুকদারের ট্রলারের ফেসবুক পেজ- শান্তা নৌ পরিবহন- Houseboat, Tanguar Haor

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা