মাস্ক পরুন, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন- ইত্যাদি ইত্যাদি জনসচেতনতা মূলক বাক্যে আসলে আর কাজ হয় না। হলে এই ভদ্রলোকের মত কোটি কোটি ভদ্রলোকের দেখা মিলত না...

একবার থাইল্যান্ডে সিগারেট বিরোধী একটা ক্যাম্পেইন চালানো হল। ক্যাম্পেইনটা এরকম। রাস্তা ঘাটে মানুষ দাঁড়িয়ে ধূমপান করছে। এর মধ্যে একটা দশ-বারো বছরের বাচ্চা যেয়ে ঐ ধূমপায়ীর কাছে লাইটার চায়। বাচ্চার হাতে সিগারেট। কোন ধূমপায়ীই লাইটার দেয় না। উল্টো উপদেশ দিয়ে দেয়। কেউ রেগেও যায়। কেউ বোঝায়, কেন এই বয়সে সিগারেট খাওয়া উচিত না। তখন বাচ্চাটা ঐ ভদ্রলোকের হাতে একটা চিরকুট গুজে দিয়ে চলে আসে। চিরকুটে লেখা, আপনি আমার মত একজন অপরিচিতকে নিয়ে চিন্তিত, আপনাকে নিয়ে আপনি চিন্তিত নন? এরকমই একটা বাক্য। আমার ঠিকঠিক মনে নেই। জাস্ট একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হল শুধু।

মাস্ক না পরায় জরিমানা করা হয় ভদ্রলোককে

এবং থাই ঐ বিজ্ঞাপনটা গোপন ক্যামেরায় শুট করা হয়েছিল। রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে সত্যিকারের ধূমপানরতদের কাছেই লাইটার চাওয়া হয়েছিল। শেষে একটা হেল্প লাইন নাম্বার দিয়ে দেয়া হল। ক্যাম্পেইনটার পরে আগের চেয়ে ষাট শতাংশ বেশি মানুষ হেল্প লাইনে ফোন দিয়েছিল। কিভাবে ধূমপান ছেড়ে দিতে হবে জানার জন্যে। এটাই তাঁদের সবচেয়ে সাকসেসফুল ক্যাম্পেইন।

কোন লেখকের লেখায় পড়েছিলাম। আমাদের সবার মধ্যে একটা উপদেশ-গ্রহণ-বিরোধী রাডার আছে। যখন মানুষ আমাদেরকে কিছু করতে বলে সাথে সাথে আমাদের ঐ রাডার একটিভ হয়ে যায়। এটা রিফ্লেক্সের মত। একধরণের ডিফেন্স ম্যাকানিজম। আমরা স্বভাবগতভাবে অন্যদের উপদেশ কানে তুলি না। মাস্ক পরুন। হাত ধৌত করুন। এই টাইপের ডিরেক্ট মেসেজ এক ধরণের উপদেশ। এগুলো আমরা কানে তুলি না। চিন্তাও করি না। ব্রেইন জাস্ট পাস করে দেয়।

মানুষকে কখনও উপদেশ দিতে হয় না। মানুষের চিন্তাটাকে একটু উস্কে দিতে হয় শুধু। এমনভাবে যেন, মানুষ নিজেকে নিজেই উপদেশ দেয়। চিন্তা উসকে দেয়ার একটা সহজ উপায় হচ্ছে প্রশ্ন করা। থাই বিজ্ঞাপনটাতে এটাই করা হয়েছে। একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হয়েছে। ধূমপায়ীকে বলে দেয়া হয়নি, ধূমপান ছেড়ে দাও। ধূমপায়ী নিজেই ভেবেচিন্তে নিজেকে পরামর্শ দিয়েছে, ধূমপান ছেড়ে দেয়া উচিত এখনই। মানুষকে এমন এমন প্রশ্ন করুন, যা মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে।

যেমন, শুরু করা যায় একটা তথ্য দিয়ে। করোনা মানুষের দেহে সুপ্ত অবস্থায় থাকে দুই সপ্তাহ। এরপর প্রশ্ন করা যেতে পারে, আপনার অজান্তেই আপনি কাউকে করোনা আক্রান্ত করছেন না তো? এভাবে চিন্তা করলে এরকম অসংখ্য ক্রিয়েটিভ প্রশ্ন আপনারাই বের করতে পারবেন।

যেখানে প্রশ্ন করার উপায় নেই, সেখানে আরেকটা উপায় আছে। সোশ্যাল প্রুফ। মানুষকে সোশ্যাল প্রুফ দেখাতে হবে। মানুষকে দেখাতে হবে অসংখ্য মানুষ এই কাজ করে। মানুষ ঐটা দেখেই ওরকম করা শুরু করে দিবে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ ফ্যাশন। ফ্যাশনের চক্করে পড়ে আমরা না চাইলেও অনেক কিছু করি। আমরা নিজেরা যাচাই করি না। দেখি সবাই কি পরে। আমরাও সেরকম জামা-কাপড় পরি।

যেমন সোশ্যাল প্রুফ হতে পারে একটা পরিসংখ্যান। শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে ৭৮ শতাংশ মানুষ নিয়মিত মাস্ক পরেন? আপনি পরছেন তো? আমি আবার বিনয়ের সাথে বলছি, উদাহরণটা আমি অন দ্য স্পট ভেবে বলছি। ভাল করে ভাবলে আপনারা আরও ভাল ভাল উপায় বের করতে পারবেন।

করোনার আগের একটা ক্যাম্পেইনের কথা বলি। একবার এক হাসপাতালের মালিকরা খেয়াল করল, নার্সরা একটা রুগী দেখে আরেকটা রুগীকে দেখতে যায়। এরমধ্যে হাতও ধোয় না। অথবা সেনিটাইজারও ব্যবহার করে না। নার্সদের বারবার হাত ধুতে বলেও কাজ হল না। তখন একটা এক্সপেরিমেন্ট চালানো হল। হাসপাতালটা অনেক বড় ছিল। হাসপাতালের এক অংশে একটা মেসেজ পোস্টারিং করে দেয়া হল, যেটাতে বলা - আপনি নিয়মিত হাত ধুলে আপনি রোগ-জীবাণু থেকে সুস্থ থাকবেন। আরেক অংশে পোস্টারিং করা হল, আপনি যদি হাত ধোন, অন্য রুগীরা সংক্রমিত না হয়ে সুস্থ থাকবে। আরেক অংশে রঙবেরঙের একটা মার্কেটিং মেসেজ দিয়ে পোস্টারিং করা হল, লেখা জেল আপ, ওয়াশ আপ টাইপ কিছু স্লোগান। আর সিসি ক্যামেরা দিয়ে দেখা হল, হাসপাতালের এই তিন অংশের মধ্যে কোন অংশের নার্সরা বেশি হাত ধোয়।

উত্তরটা সবাই বলবে, যে অংশে লেখা আছে, আপনি হাত ধুলে আপনি সুস্থ থাকবেন। সেখানে। কিন্তু না। সবচেয়ে বেশি হাত ধোয়া হয়েছে, যে অংশে পোস্টারিং করা ছিল যে, আপনি হাত ধুলে, আপনার রুগীরা সুস্থ থাকবে। মানুষ অবিশ্বাস্য রকমের সামাজিক প্রাণী। সোশ্যাল প্রুফ ম্যাজিকের মত কাজ করে। ও হ্যাঁ, এটা বলতে ভুলে গেছি, সবচেয়ে কম কাজ করেছে, মার্কেটিং মেসেজওয়ালা পোস্টারটা। মোটের উপর পাত্তাই পায়নি।

আগে যখন যোগাযোগ মাধ্যম স্বল্প ছিল, তখন এগুলো একটু একটু কাজ করত। এখন আরও কাজ করে না, কারণ মানুষ সেকেন্ডে সেকেন্ডে বিজ্ঞাপন দেখে। মানুষের এত বিজ্ঞাপন মনে রাখার সুযোগ নেই। মানুষকে এমন কিছু মেসেজ দিতে হবে, যে অংকের সমাধানের মত মানুষ নিজে নিজেই আবিষ্কার করবে। তখন মানুষ চিন্তা করবে। আপনার ব্র্যান্ডের কথা মনে রাখবে। মেসেজটা মেনে নিবে। কারণ, শত শত মেসেজের মধ্যে কাস্টমার আপনার মেসেজটা নিয়েই একটু ভেবেছে। যাই হোক বাংলাদেশেও এখন এরকম আধুনিক বিজ্ঞাপন হচ্ছে। মানুষও এসব বিজ্ঞাপনের মর্ম বুঝছে। এটাই আশার কথা।

আর সবশেষে ছবিটার ভদ্রলোকের এক্সপ্রেশন আরেকবার মনোযোগ দিয়ে দেখুন। আপনি কি নিশ্চিত না, এই ভদ্রলোক দিনে অন্তত এক হাজার বার এই বাক্যটা বিভিন্ন জায়গায় পড়েছেন যে, মাস্ক পরুন।

ফিচার্ড ছবি- প্রথম আলো

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা