সবাইকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা! এই নারী দিবস উপলক্ষে আমার 'নারী' থেকে মানুষ হবার গল্পটা বলি...

আমি আমাদের পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান, ছোট মেয়ে- আমার আগে আরো দুইজন বোন আর একজন ভাই আছে। সবার ছোট হবার কারণে আমি যে 'ওল্লে গুল্লু গুল্লু' টাইপ আদরের ছিলাম, বিষয়টা তা ছিল না। বরং উল্টোটা ছিল। কারণ আমার জন্মটা হয়েছিল একটা 'মেয়ে' হিসেবে। এই তথ্যের মানে আমি যদিও জন্মের পর পর বুঝতে পারিনি, কিন্তু আমার জন্মদাত্রীসহ আশে-পাশের সবাই বুঝে যায়।

'তিন নম্বরটাও মাইয়া?' এই স্পেসিফিক রিঅ্যাকশন আমার ঠিক মনে নেই, কিন্তু এই গল্প ছিল আমার ছোটবেলার একমাত্র গল্প, কেউ আসলেই আয়েশ করে আমার সাথে গল্প করতো- '...বুঝছোস? সবাই ভাবছিলো এইবার পোলা হইবো, কিন্তু তোরে দেইখা তোর মা চেইত্তা শেষ। তার উপর তুই হইছিলি দুনিয়ার কালা'

এই 'চেইত্তা শেষ' হয়ে যাওয়ার গল্প, আর 'দুনিয়ার কালা' হবার বিশ্রী ফিলিং মনের মধ্যে নিয়ে আমার কৈশোর কাটে।

তারপর বয়সন্ধিকালে আরেক ক্যাচাল,  পিরিয়ড হওয়ার মতন একটা বিশ্রী ব্যাপার শুরু হয়। এই জিনিস যখন শুরু হয়, আমার পাগলাটে টাইপ মা বিষয়টাকে সহজভাবে নেয়না। যেহেতু আমার বয়স তখন ১১, এই অল্প বয়সে এই বিশ্রী ব্যাপারটার জন্য আমি কঠিন মার খাই, জ্বর চলে আসে আমার সেই রাতে।

তারপর প্রতি মাসে ওই সময়টায় আমি নিয়ম করে মার খাই। এই বিশ্রী ব্যাপারটা থেকে যেহেতু কোনো রক্ষা নাই, তাই আমি একটা উপায় বের করি। ঠিক করি- এই সময়টা আমি খুব সাবধানে থাকবো। কাউকে জানাবো না, কেউ যেন ঘুণাক্ষরে টের না পায় আমার এই জঘন্য অসুখটার কথা।

লেখিকা ও তার কন্যা

অবশ্য খুব বেশিদিন এই লুকোচুরি আমাকে করতে হয়নি, এর মাঝেই আমাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

আহা! কী শান্তি! এখানে সবাই আমার মতন, তাই কারো কাছ থেকে আমাকে কিছু লুকাতে হয় না। তার উপর আমার মতন এই অসুখটা নাকি এখানে সবারই হয়। হোস্টেলে এসে দেখলাম অনেকেই কাঁদে, বাসায় চলে যেতে চায়, থাকতে চায় না। আর আমি তার উল্টো, দাঁত বের করে হাসি। তখন থেকেই আমি অনেক হাসি।

বাসায় গিয়ে কী হবে? এখানে আমি একটা মানুষ আর বাসায় আমি একটা 'মেয়ে'...

আমি আসলে ছোটবেলা থেকে মানুষই হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু মানুষ হওয়া এত সহজ না!

হোস্টেল থেকে বের হলেই যে আমি আবার 'মেয়ে' হয়ে যাবো, সেই আতঙ্কে ব্যাপক পড়াশুনা শুরু করলাম। পড়তে পড়তে একটা অদ্ভুত ব্যাপার জানতে পারলাম, আমার হোস্টেলের বাইরে যে পৃথিবীটা, সেটা নাকি পুরো পৃথিবী না! তার বাইরেও নাকি পৃথিবী আছে, সেখানে মেয়েদেরকে মানুষ ভাবা হয়। ঠিকভাবে পড়াশুনা করলেই নাকি আমি সেখানে যেতে পারবো।

আমি ঠিকভাবে পড়াশুনা শুরু করি। শুধু ক্লাসের বই না, হাতের সামনে যা পাই, তাই পড়ি। সব পড়ি, সব জানতে হবে আমাকে। কারণ- আমি মানুষ হব।

একসময়, আমার কাঙ্খিত পৃথিবীতে আমি মানুষ হয়ে আসি। এসে দেখি, ঘটনা অন্য। এখানে মেয়ে হয়ে ঘুরে বেড়ানোটা তেমন যন্ত্রণার না, আমাকে এত কষ্ট করে মানুষ না হলেও চলতো। আমি আরো বুঝতে পারি মেয়ে হয়ে জন্মানোটা কোনো 'চেইত্তা' যাবার বিষয়ই না বরং সুস্থ হয়ে জন্মানোটাই আশীর্বাদ। আমি জানতে পারি পিরিয়ড কোনো অসুখ না, এজন্য ১০/১১ বছরের মেয়েগুলোকে অমানুষিক মার খেয়ে ঘুমাতে যেতে হয় না। এখানে পিরিয়ড আসলে কোনো ঘটনাই না।

মেয়ে হয়ে জন্মানোটা 'চেইত্তা' যাওয়ার মতো কোন বিষয় নয়

আমার মেয়ে হবার পর আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। যাক! এবার আরেকজনকে 'মেয়ে' থেকে মানুষ বানাবো। আমি যা পাইনি, তার সবটুকু ঢেলে দিব। কিন্তু হায় আল্লাহ! আমি যে দেশে থাকি, সেটা পুরোটাইতো মানুষ বানানোর কারখানা, আমাকে আলাদা করে কিছু করতে হবে না। এটা জেনে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যাই প্রতিদিন।

কিন্তু প্রতি মাসের সেই মার খাবার ট্রমাতে, আজও আমার মাসের সেই বিশ্রী (!) সময়টাতে ঘুম ভেঙে যায় মধ্যরাতে। ব্যথায় আর অভিমানে আমি ছটফট করে উঠি।

আর তখন মানুষ হয়ে জন্মানো আমার মেয়েটা, আমার হাত ধরে ঘুম ঘুম চোখে বলে, 'ইটস ওকে মাম্মা, আমি আছি না?'


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা