বাংলাদেশই প্রথম না, মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হিসেবে প্রথম কুয়েতে মিল্ক ব্যাংক হয়। তুরস্কেও পাইলট প্রকল্প হয়েছিল। মালয়েশিয়ায় মিল্ক ডোনেশনের সিস্টেম আছে যা হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক আইডিয়া থেকে একটু ভিন্ন।

বাংলাদেশে প্রতি লাখে প্রায় ২০০ জন মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। এই ২০০ জনের মৃত্যুকে একটু নাটকীয় ভঙ্গিমায় 'খুন'ও বলতে পারি চাইলে। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষরা এই মৃত্যুগুলোর জন্য দায়ী৷ এই প্রসঙ্গে কিছু বলব না আপাতত। প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। ২০০ জন মা যখন নবজাতক বাচ্চা রেখে মারা যান, তাদের সদ্যজাত শিশুকে কে বুকের দুধ পান করাবে? আচ্ছা, ডাস্টবিনে আজকাল যে নবজাতক পাওয়া যায় কাঁথায় মোড়ানো তাদের দুধ পান কে করাবে? যেসব পরিবার শিশু দত্তক নেয় তারা কিভাবে বাচ্চাকে দুধ পান করানোর ব্যবস্থা করবে?

এদিক ওদিক নানান দিগ্বিদিক করে ম্যানেজ হয়তো হয়, পৃথিবীকে কোনো কিছু আটকায় না জানি। কিন্তু, এই নবজাতকদের নিয়ে হ্যাঁচড়া-হ্যাঁচড়ি না করে সহজে যদি তাদের দুধ পানের ব্যবস্থা করা যায়? এই চিন্তা থেকে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে 'হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক'। মারাত্মক সুন্দর একটা ইনিশিয়েটিভ, পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে এরকম ব্যবস্থা।

নবজাতকের দুধ পান 

কিন্তু, দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি, এই ইনিশিয়েটিভটা টিকবে না। কিছু মানুষ(!) ইতিমধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিবাদ শুরু করছেন। মিল্ক ব্যাংক আইডিয়াকে হারাম ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন। তারা হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক আইডিয়াকে ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক বলে প্রমাণ করতে চাইছেন।

তাদের যুক্তি হলো, মিল্ক ব্যাংক থেকে আনা দুধ পান করবে যারা তাদের মধ্যে তৈরি হবে দুধভাই, দুধবোনের সম্পর্ক। এরকম সম্পর্ক হলে এদের মধ্যে বিয়ে হবে না। বিয়ে হলে সেটা হবে হারাম। সুতরাং, মিল্ক ব্যাংকই হারাম। তারা বলছে, কোনো মুসলিম দেশে মিল্ক ব্যাংক নেই। কবে সৌদি আরবের কোথায় কনফারেন্স করে বলা হয়েছে মিল্ক ব্যাংক হারাম, সুতরাং মিল্ক ব্যাংক চলবে না বাংলাদেশে।

তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, এ ধরণের মিল্ক ব্যাংক চালু হলে দেশে কেউ আর গরুর দুধ পান করবে না, দেশে মিল্কভিটার প্রোডাকশন অফ হয়ে যাবে, সবাই হান্ডি পাতিল নিয়ে মিল্ক ব্যাংকে গিয়ে দুধ পান করে দুধ-ভাইবোন হয়ে যাবে! পাগল হয়ে যাবো এদের দুধ গবেষণা দেখে!

হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক 


যাই হোক প্রথম কথা, বাংলাদেশই প্রথম না৷ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হিসেবে প্রথম কুয়েতে মিল্ক ব্যাংক হয়। তুরস্কেও পাইলট প্রকল্প হয়েছিল। মালয়েশিয়ায় মিল্ক ডোনেশনের সিস্টেম আছে যা হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক আইডিয়া থেকে একটু ভিন্ন। এখানে যিনি ডোনেট করবেন এবং যিনি প্রাপক তাদের সাক্ষাৎ হবে। তারা জানবেন, কে কাকে দান করছে। ব্ল্যাড ডোনেশন সিস্টেম কাইন্ড অফ। বাংলাদেশে যে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক হচ্ছে, এখানকার কর্তাব্যক্তিরাও জানে এটা 'নব্বুই পার্সেন্ট মুসলমান'দের দেশ। তাই তারা ইসলামিক বিধি নিষেধ মাথায় রেখেই কাজ করার প্রক্রিয়া বের করছেন। অন্য কোন কোন মুসলিম দেশে দেশে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক বা সিমিলার আইডিয়া আছে সেসব খোঁজ নেয়া হচ্ছে। তারা সেভাবেই এগুবেন।

কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখে যাচ্ছি কিছু লোক হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের নামটাই সহ্য করতে পারছে না। তারা এর উদ্দেশ্যকে একদম এড়িয়ে গিয়ে দুধ - ভাইবোন, বিয়ে শাদী ওই লাইনের আলাপে ব্যস্ত। একটা নবজাতক বাঁচবে, একজন অসুস্থ মায়ের সন্তান বুকের দুধ পান করতে পারবে, একটা এতিম বাচ্চা মায়ের দুধ পাবে -- এতো বড় বিষয়কে তারা তুচ্ছ করে কেন দেখছে? কেন তারা মিল্ক ব্যাংক টার্মকে হারাম বলে প্রচার করে দিচ্ছে? বরং প্রশ্ন আসতে পারতো, মিল্ক ডোনার যিনি হবেন তার থেকে ডোনেশন কি বেসিসে নেয়া হবে? স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্যে স্ক্রিনিং করে নেয়া হবে কিনা? ডোনেশন প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছতা, পরিচ্ছন্নতার মধ্য দিয়ে করা হবে?

বাংলাদেশে চালু হওয়া হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক    

কিংবা তারা বলতে পারত, এরকম দারুণ উদ্যোগ যদি ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে সেই সংঘর্ষ এড়িয়ে কি করে এই আইডিয়া আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি। কিভাবে জীবন বাঁচানোর চেষ্টায় আমরা সাহায্য করতে পারি, তা নিয়ে কথা আসতে পারত। কিন্তু কথা আসে না।

তুরস্কে একটা প্রস্তাব এসেছিল এরকম। তিনজন মিল্ক ডোনারের একটা পুল হবে। সেই তিনজন ডোনারের পুল থেকে তিনজন গ্রহীতা ঘুরে ফিরে মিল্ক ডোনেশন নিবেন। এর বাইরে আর কেউ না। এভাবে প্রত্যেকটা পুলে তিনজন ডোনার থাকবে। কোনো পুল থেকে অন্য পুলের কেউ ডোনেশন নিতে পারবে না।

সমাধান নিয়ে ভাবতে চাইলে কিছু না কিছু সমাধান আসবে। কিন্তু, জানি না কেনো যেন কোনো ফতোয়া এলেই সেটা একদল লোকের কাছে ট্যাবু হয়ে ওঠে। তারা আর সে বিষয়ে কথা বলতে চান না। সমাধান খুঁজতে চান না। প্রশ্ন শুনতে চান না। থামিয়ে দিতে চান। জীবন বাঁচানোর চেয়ে ফতোয়াবাজিটাই বড় হয় কেন তাদের কাছে? 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা