আমরা খাব-দাব ফুর্তি করবো, কে বাঁচলো, কে মরলো তাতে আমাদের কী? গার্ডিয়ান অফ দ্যা গ্যালাক্সী সিনেমায় ঠিক এভাবেই রকেট রেকুন প্রশ্ন করে, তুমি এই বিশ্বব্রহ্মান্ডকে বাঁচাতে চাও কেন? জবাবে স্টার লর্ড পিটার কুইল বলে, কারণ আমি সেই নির্বোধদের একজন যারা এই বিশ্বব্রহ্মান্ডেই বসবাস করে।
মানবতা। ছোট্ট একটি শব্দ। অথচ কী বিশাল তার ব্যাপকতা। মায়া, মমতা, স্নেহ অথবা ভালোবাসা; হতে পারে নিজ বাড়ির মানুষটার জন্য, কিংবা হাজার মাইল দূরে বনজঙ্গলের কোনো ক্যাঙ্গারুর জন্য। একটি গাছ কাটলেও অনুভব করতে পারেন রিক্তের বেদন। এই বিশ্বব্রহ্মান্ড এবং তার প্রাণের অস্তিত্বের জন্য যে সহমর্মিতা আপনি অনুভব করেন, সেটিই মানবতা। এর চেয়ে বড় মানবিক গুণ আর হতে পারে না।
আপনারা ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন অস্ট্রেলিয়ার দাবানলের কথা। হয়তো তার ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারেননি এখনো। ৫০ কোটি প্রাণী মারা গেছে ইতিমধ্যেই, একটি নয় দুইটি নয়। ৫০ তাও আবার কোটি! তাহলে এবার চিন্তা করুন কয় কোটি গাছপালা পুড়ে ছাই হয়েছে! এই ক্ষতিপূরণ কি আদৌ সম্ভব হবে? এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে আমরা কি পারবো আমাদের ধরণীকে রক্ষা করতে? পরিস্থতি কিন্তু ভয়াবহ হয়ে উঠছে দিনকে দিন। তাপমাত্রা বাড়ার পাশাপাশি, তীব্র বাতাসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। বাড়ছে হতাহতের সংখ্যাও।
দেশটির ৬ অঙ্গরাজ্যের ৩টিই দাবানলের কবলে পড়েছে ইতিমধ্যে। নিউ সাউথ ওয়েলস অঙ্গরাজ্যে যত দূর চোখ যায়, শুধুই দাবানলের তাণ্ডব। সামনে যা পড়ছে সবই গ্রাস করে নিচ্ছে আগুন। বাতাসের গতি বাড়তে থাকায় পরিস্থিতির কোনো উন্নতি নেই। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলাতে পারছে না দেশটির সরকার। নতুন নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে আগুন। পুড়ছে বাড়ি-ঘর। দাবানল থেকে বাঁচতে নিজ এলাকা ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছেন নিউ সাউথ ওয়েলস, কুইন্সল্যান্ড ও ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দারা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বন্যপ্রাণী। নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যে ৩৬ লাখ হেক্টর জমি পুড়ে গেছে যা ইউরোপের দেশ বেলজিয়ামের থেকেও বড়। কুইন্সল্যান্ডে ২ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমি পুড়ে গেছে। এছাড়া ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যে ৮ লাখ ২০ হাজার হেক্টর বনাঞ্চল পুড়ে গেছে। চারিদিক থেকে আগুন বণ্যপ্রাণীদের এমনভাবে ঘিরে ধরছে যে, নিরাপদে পালানোর সুযোগটাও পাচ্ছে না! মানুষের তো যাবার জায়গা রয়েছে, ওদের তো নেই। অসহায় বণ্যপ্রাণীগুলো কোথায় যাবে বলতে পারেন? ওদের জন্য নিরাপদ অভয়ারান্য কি আমরা তৈরি করতে পেরেছি। এই পৃথিবীটা তো শুধুই আমাদের একার সম্পত্তি না, তাই না?
দাবানলে আক্রান্ত অসংখ্য বণ্যপ্রাণী ইতিমধ্যেই জনবসতিতে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার মানুষজন এই দূর্গত প্রাণীদের আশ্রয় দিয়েছে। তাদের চিকিৎসা এবং খাবারের ব্যবস্থাও করে দিচ্ছে মানুষ। সেই ভয়ার্ত প্রাণীগুলো মানুষ দেখলেই এখন জড়িয়ে ধরছে! বোবা মুখে ভাষা ফোটে না, কিন্তু কাতর আর্তিতে চাইছে সাহায্য। দগ্ধ-অর্ধদগ্ধ অসহায় প্রাণীগুলোর ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ব মিডিয়াজুড়ে। সেই দৃশ্যগুলো দেখে চোখের জল ধরে রাখা দায়। কিন্তু সেই জলে তো আর দাবানল নেভানো যাবে না। এমতাবস্থায় প্রার্থনা করা ছাড়াও সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আমাদের উপরেই মূল দায় এবং দায়িত্ব বর্তায়।
হয়তো এমন দায়িত্ববোধ থেকেই এগিয়ে এসেছিলেন স্টিভ আরউইন। মনে আছে তার কথা? একজন অস্টেলীয় প্রকৃতিবাদী, বণ্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও টিভি ব্যক্তিত্ব। বিশ্বব্যাপী প্রচারিত ক্রোকোডাইল হান্টার নামের টেলিভিশন প্রামাণ্যচিত্রের জন্য বিশ্ববিখ্যাত তিনি। বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণে তার অবদান অনস্বীকার্য। ২০০৬ সালে তার মৃত্যুর পর সেই দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে তার পরিবার। স্টিভের স্ত্রী টেরী আরউইন, মেয়ে বিন্দি আরউইন, ছেলে রবার্ট আরউইন ও পরিবারের অন্যরা মিলে এখন পর্যন্ত ৯০ হাজারেরও বেশি বন্যপ্রাণীকে উদ্ধার ও চিকিৎসা দিয়েছেন। কুইন্সল্যান্ড অঙ্গরাজ্যে ‘অস্ট্রেলিয়া জু’ নামে একটি চিড়িয়াখানা পরিচালনা করে থাকে আরউইন পরিবার। দেশটির সাম্প্রতিক ভয়াবহ দাবানলের সময় আক্রান্ত বহু বন্যপ্রাণীকে এই চিড়িয়াখানায় চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। আরউইন পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এক হাজার একরেরও বেশি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই চিড়িয়াখানাটি দাবানলে আক্রান্ত হয়নি তাই বন্যপ্রাণীদের উদ্ধার ও সুরক্ষা দিয়ে যেতে পারছেন তারা।
আরউইন পরিবার পরিচালিত ওয়াইল্ডলাইফ হাসপাতালের ৯০ হাজারতম রোগী ছিল ওলি নামের একটি প্লাটিপাস। স্টিভ আরউইনের সন্তান রবার্ট আরউইন গত বৃহস্পতিবার তার ইন্সট্রাগ্রাম পোস্টে লিখেছেন, অস্ট্রেলিয়ার ভয়াবহ দাবানলে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ ও বণ্যপ্রাণীদের জন্য তার হৃদয় কাঁদছে। বিন্দি আরউইন জানিয়েছেন, অন্য যেকোনও সময়ের চেয়ে তাদের বণ্যপ্রাণী হাসপাতালটি দাবানলের সময়ে বেশি ব্যস্ত রয়েছে। বিন্দি আরো বলেন, 'আমাদের বাবা-মা আমাদের অস্ট্রেলিয়া জু ওয়াইল্ডলাইফ হাসপাতালটি আমার দাদীকে উৎসর্গ করেছেন। বন্যপ্রাণের সেবা ও যতো সম্ভব ততো প্রাণের জীবন বাঁচানোর মধ্য দিয়ে তাকে সম্মান জানানো চালিয়ে যাবো।'
শুধুমাত্র একটি পরিবারই বাঁচিয়েছে প্রায় ১ লক্ষ প্রাণ। কতটুকু মমত্যবোধ থাকলে এটি সম্ভব! মানবিক দিক থেকে একটিবার চিন্তা করুন, যে যার অবস্থান থেকে সবাই এগিয়ে আসলে সংখ্যাটা লক্ষ থেকে কোটি ছাড়িয়ে যেতো। অথচ, আমাদের আশেপাশে ধর্ষিত হয়ে মরে পরে থাকলেও আমাদের টনক নড়ে না। বণ্যপ্রানী তো বহু পরের ব্যাপার। গোল্লায় যাক বিশ্বব্রহ্মান্ড। আমরা খাবো-দাবো, ফুর্তি করবো, কে বাঁচলো, কে মরলো তাতে আমাদের কী? গার্ডিয়ান অফ দ্যা গ্যালাক্সী সিনেমায় ঠিক এভাবেই রকেট রেকুন প্রশ্ন করে, তুমি এই বিশ্বব্রহ্মান্ডকে বাঁচাতে চাও কেন? জবাবে স্টার লর্ড পিটার কুইল বলে, কারণ আমি সেই নির্বোধদের একজন, যারা এই বিশ্বব্রহ্মান্ডেই বসবাস করে।