হুমায়ূন আহমেদ তখন আমেরিকার নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটিতে থিসিসের কাজ করছেন। থাকেন ফারগো নামক শহরে। প্রচন্ড ঠান্ডা সেই এলাকায় সহজে কেউ যেতে চায় না। আশেপাশে সাতশো মাইল এলাকায় উনি ছাড়া মাত্র আর একজন বাংলাদেশী আছেন, তাঁর নাম মিজান। সেই ছেলে গভীর রাতে হূমায়ূন আহমেদকে ফোন দিয়ে ঘুম থেকে তুললেন।

- হুমায়ূন ভাই, আপনি খিচুড়ি রান্নার রেসিপি জানেন?

হুমায়ূন আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মোরহেড ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিকসে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট করতে থাকা এই ছেলেটার মাথা মোটামোটি ক্র্যাক। মোরহেড ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক উৎসবে 'বাংলাদেশ নাইট' সে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আয়োজন করার প্ল্যান করছে। 

এর আগে সে একাই 'বাংলাদেশ এসোসিয়েশন' খুলতে চেয়েছিলো। তখন স্টুডেন্ট এডভাইজার তাকে পাকিস্তানি ছাত্রদের সাথে খুলতে বলায় সে এডভাইজারকে ধরে মার লাগায় আরকি। এতদিন পর বাংলাদেশ নাইট আয়োজন করার সুযোগ পেয়ে সে ভয়ানক উত্তেজিত, "শালারা বাংলাদেশের নাম শুনলে হা করে থাকে। এবার শালাদের দেখিয়ে দিবো বাংলাদেশ কী! হুমায়ূন ভাই আমি আপনার এখানে চলে আসছি, যে আয়োজন করবো শালাদের চোখ টেরা হয়ে যাবে!"

আয়োজনের মধ্যে হলো বিশাল #রংচঙ্গে একটা বাংলাদেশের ম্যাপ বানানো হয়েছে, বিশাল ডেকচিতে খিচুড়ি রান্না হবে, শিকাগোর এক ইন্ডিয়ান দোকান থেকে পান-সুপুরির অর্ডার দেয়া হয়েছে, আর অনুষ্ঠানের শেষে থাকবে জাতীয় সঙ্গীত। হুমায়ূন আহমেদ আঁতকে উঠলেন। 

অনুষ্ঠানের দিন সকাল বেলা খিচুড়ি চরানো হলো। চাল-ডাল-গরম মশলা-মুরগী-কিমা যা আছে সব ঢেলে দুজনে মিলে ঘুটা দেয়া শুরু করলেন। ফলাফল হলো ভয়াবহ। খিঁচুড়ির বদলে কালচে টাইপের এক প্রকার ঘন তরল টাইপের জিনিস তৈরী হলো। শিকাগো থেকে পান-সুপারিও আর আসলো না। গান গাবার ট্রাই করতে দেখা গেলো মিজানের অবস্থা হুমায়ূন আহমেদের চেয়েও খারাপ, গলা দিয়ে পাতিহাঁসের মতো আওয়াজ বেরুচ্ছে। সে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো।

এর মধ্যে হঠাৎ অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটতে শুরু করলো। তারা দুজন অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন দূর দুরান্ত থেকে বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা আসা শুরু করেছে। মিজান আশেপাশে যত ইউনিভার্সিটি আছে সব কয়টাতে 'বাংলাদেশ নাইটের' আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিলো। 

দেড় হাজার মাইল দুরের মন্টানা ইউনিভার্সিটি থেকে একটা মেয়ে একা একা বাসে করে চলে এসেছে। মিনোসোটা থেকে দশজনের একটা দল চলে এসেছে পিঠা নিয়ে। গ্র্যান্ড ফোকস থেকে করিম সাহেব সস্ত্রীক চলে এসেছেন, অসম্ভব কর্মঠ সেই মহিলা কালচে খিচুড়ি ফেলে দিয়ে নতুন করে খিচুড়ি বসালেন। মিজান আনন্দে লাফাবে না চেঁচাবে কিছু বুঝতে না পেরে চুপচাপ বসে আছে আর গম্ভীর ভাবে বলছে - দেখ শালা বাংলাদেশ কী জিনিস। দেখে যা।

অনুষ্ঠান শুরু হলো দেশাত্মবোধক গান দিয়ে, 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি..' মেয়েগুলো এত মায়া নিয়ে গাইছে। বিদেশ বিভুঁইয়ে দেশের গান শুনে হুমায়ূন আহমেদের বুকটা হু হু করে উঠলো, তিনি চোখের পানি আড়াল করতে মাথা নিচু করে রইলেন। 

পরদিন স্থানীয় পত্রিকায় এই অনুষ্ঠান নিয়ে একটা খবর ছাপা হয়। যার অংশবিশেষ- 'আজ একটি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ জাতির অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। অনুষ্ঠান শুরু হয় দেশের গান দিয়ে। আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম গান শুরু হবার সাথে সাথে বাংলাদেশী ছেলেমেয়েরা কাঁদতে শুরু করলো। আমি আমার দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতা জীবনে এরচেয়ে মধুর কোন দৃশ্য দেখিনি...'

হুমায়ূন আহমেদের 'হোটেল গ্রেভার ইন' বইটায় 'বাংলাদেশ নাইট' নামক গল্পটা নিজের ভাষায় লিখবার সময় শেষের দিকে এসে চোখের পানি নাকের পানি এক হয়ে, কী বোর্ড ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো বারবার। হুমায়ূন আহমেদ এরকম অসংখ্যবার আমাকে হাউমাউ করে কাঁদিয়েছেন, কখনো তার লেখা পড়ে মাঝরাতে হেসে উঠে বাপের মার খেয়েছি। 

উনার লেখার সাহিত্যমান নিয়ে আলোচনা করা আমার কাছে অনর্থক, উনার লেখাগুলো আমার কাছে নিজের একটা অংশ মনে হয়। সত্যি ব্যাপারটা হলো, উনার সমালোচক-নিন্দুকেরাই একদিন মরে যাবে, হুমায়ূন আহমেদ অনন্তকাল বেঁচে রইবেন আমার মতো এরকম হাজার নিযুত পাঠকের ভেতরের একটা অংশ হয়ে।

-

* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা