হুমায়ুন আজাদ: চাপাতির বিরুদ্ধে যিনি কলমকে অস্ত্র বানিয়ে লড়েছিলেন!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
হুমকিকে অগ্রাহ্য করে তিনি লিখে গেছেন, কলমকে তিনি অস্ত্র বানিয়েছিলেন চাপাতির বিরুদ্ধে। শারীরিকভাবে হুমায়ুন আজাদকে হয়তো নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে মৌলবাদীরা, কিন্ত তার চেতনাকে তো দাবিয়ে রাখতে পারেনি, ছাইভস্ম থেকে আগুন হয়ে জ্বলেছে সেই চেতনার স্ফুলিঙ্গ...
তিনি লিখতেন, কলম ছিল তার অস্ত্র, বারুদের গোলা হয়ে বের হতো সেই লেখনী। অকপটে তিনি কথা বলতেন সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি আর নানা অসঙ্গতি নিয়ে। এদেশের জন্মের সময় যারা বিরোধিতা করেছে, ধর্মের নামে যারা লোক ঠকানোর ব্যবসা খুলে বসেছে, তাদের বিরুদ্ধাচরণ তিনি করেছেন সবসময়। জাতীয় পত্রিকায় লেখা কলামে পাকিস্তানের বিরোধিতা করে বলেছেন, পাকিস্তানীদের আমি অবিশ্বাস করি, এমনকি যখন তারা ফুল নিয়ে আসে তখনও! তিনি সমালোচনা করেছেন এদেশের সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবীদের নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার, বঙ্গদেশে স্রোতের বিপরীতে হেঁটে একমাত্র তিনিই উচ্চকণ্ঠ ছিলেন মৌলবাদের কালো থাবার বিরুদ্ধে। এই অসম সাহসিকতার মূল্যও তাকে দিতে হয়েছে চাপাতির কোপে রক্তাক্ত হয়ে, যে হামলা তার মৃত্যুর কারণ হয়েছিল।
হুমায়ুন আজাদ, এই বঙ্গে জন্ম নেয়া সবচেয়ে মেধাবী মানুষগুলোর একজন। ১৯৪৭, উত্তাল একটা বছর। ইংরেজরা ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছে এই অঞ্চলের মানুষ। রেডক্লিফ লাইন দিয়ে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়ে গেল, ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা হলো দুটো দেশ। সেবছরই ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরে জন্ম হুমায়ুন আজাদের। জন্মের সময় অবশ্য নাম রাখা হয়েছিল হুমায়ুন কবীর, পরে তিনি নিজেই সেই নাম বদলে নিয়েছিলেন।
তিনি একাধারে ছিলেন শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী। এতসবের ভিড়ে তার 'কবি' স্বত্বাটা কেমন যেন চাপা পড়ে যায়। অথচ তার লেখালেখির শুরুটা কিন্ত হয়েছিল কবিতা দিয়েই। কবিতা ছিল হুমায়ুন আজাদের প্রথম এবং শেষ প্রেম। ভার্সেটাইলিটি ছিল তার সবচেয়ে বড় গুণ, কবিতাতেও তিনি বৈচিত্র্য নিয়ে এসেছেন বারবার। প্রেম, কাম, ক্রোধ, দর্শন, সংকেত, ইঙ্গিত, বাস্তবতা, দৃশ্য-অদৃশ্য কত বিষয় নিয়ে তিনি ছন্দ সাজিয়ে মালা গেঁথেছেন! সময়, সমাজ সংঘ- তার উপলব্ধি করার মানসিকতাটা ছিল ভীষণ স্বচ্ছ এবং বহুরৈখিক। তিনি লিখেছিলেন- ‘আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে/নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক সব সংঘ পরিষদ; চলে যাবে অত্যন্ত উল্লাসে/চলে যাবে এই সমাজ-সভ্যতার সমস্ত দলিল’। - অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধি কতটা গভীর হলে এমন পংক্তি বেরিয়ে আসে কলম থেকে!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করার পরে চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন, মাত্র ২২ বছর বয়স তখন তার! ১৯৬৯ সালের ঘটনা সেটা। এরপরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ফিরে এসেছিলেন নিজের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই। পরে ঢাবির বাংলা বিভাগের প্রধানও হয়েছিলেন তিনি।
শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন কোমল আর কঠোরের দারুণ এক সমন্বয়। তাকে দেখে ছাত্ররা সিগারেট লুকিয়ে ফেললে বা ফেলে দিলে তিনি ডেকে এনে বলতেন, সিগারেট টাকা দিয়ে কেনা জিনিস, সেটা অপচয়ের কোন মানে নেই। সিগারেট খাওয়ার সঙ্গে শ্রদ্ধা বা সম্মানের বিষয়টাও অবান্তর। পরমত সহিষ্ণুতা ছিল তার বড় একটা গুণ, ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ তার সঙ্গে দ্বিমত করলে তিনি নিজেই বলতেন, 'তুমি চাইলে প্রতিবাদে ওয়াক আউট করতে পারো!'
ভাষাবিজ্ঞান নিয়ে স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছিলেন তিনি। তার লেখা লাল নীল দীপাবলিকে ধরা হয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উজ্জ্বল এক নিদর্শন হিসেবে। নব্বইয়ের দশকে তিনি গদ্য রচনা শুরু করলেন, এবং শুরু থেকেই তার লেখাগুলো যেন বুলেট হয়ে আঘাত করতে থাকলো মৌলবাদী এবং ধর্মান্ধদের। তিনি লিখলেন ধর্মের নাম করে অধর্মের ব্যবসা নিয়ে, লিখলেন দেশদ্রোহী রাজাকারদের নিয়ে, কলম ধরলেন তাদের বিরুদ্ধে। এদেশীয় সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই প্রথম নিজের সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করেছিলেন মৌলবাদের বিরুদ্ধে।
সেই এরশাদের আমল থেকেই ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি লিখে গেছেন। যে পত্রিকায় তিনি কলাম লিখতেন, সেটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার প্রচ্ছন্ন হুমকি এসেছে, তিনি কলম থামাননি। তিনি লিখেছেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, লিখেছেন ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, য়ার কলম গর্জে উঠেছে পাকিস্তানের প্রেতাত্মাদের বিরুদ্ধেও।
পাকিস্তানপন্থী এবং রাজাকারদের সাথে এদেশীয় বুদ্ধিজীবীদের একাত্ম হয়ে যাওয়ায় তিনি ব্যথিত হয়েছেন, বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারের পদলেহন করতে দেখে কোন রাখঢাক না রেখেই তিনি সরাসরি সমালোচনা করেছেন তাদের, লিখেছেন- এই ব-দ্বীপে দালালি ছাড়া ফুল ফোটে না, মেঘও নামে না। এমন সাহসী উচ্চারণ আজকের দিনে অসম্ভব, হয়তো তখনও অসম্ভব ছিল, সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন হুমায়ুন আজাদ।
তার ওপর হামলার হুমকি ছিল, নিজের স্পষ্টভাষী লেখনীর কারণেই মৌলবাদীদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন মানুষটা। তার পরিবারকে হুমকি দেয়া হচ্ছিল, হুমায়ুন আজাদকে থামাতে না পেরে তার সন্তান অনন্য আজাদকে অপহরণের চেষ্টা করা হয়েছে। তবু তখনকার ক্ষমতাসীন জোট সরকার হুমায়ুন আজাদকে যথাযথ নিরাপত্তা দেয়নি। কারণ হুমায়ুন আজাদ তো তাদেরই সমালোচনা করতেন সবচেয়ে বেশি।
২০০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই তার ওপর হামলা হলো, তাকে কুপিয়ে আহত করে মৌলবাদের ধ্বজাধারীরা বীরদর্পে চলে গেল ঘটনাস্থল থেকে। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হুমায়ুন আজাদ পড়েছেন, যে ক্যাম্পাসে তিনি যুগ যুগ ধরে শিক্ষকতা করেছেন, যে ফুলার রোডের বাসায় তিনি থেকেছেন- সেই ক্যাম্পাস রক্তাক্ত হলো তার রক্তে। নারী, পাক সার জমিন সাদ বাদ, সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে কিংবা লাল নীল দীপাবলির লেখক রক্তাক্ত শরীরে অচেতন অবস্থায় পড়ে রইলেন ফুটপাতে।
তার ওপর হামলাকারীদের গ্রেফতারের নাম করে আরেক দফা নাটক মঞ্চস্থ হলো। যারা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, তার আহত অবস্থার ছবি তুলেছিল- তাদেরকেই মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করা হলো। আসল অপরাধীরা রয়ে গেল ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদিকে হুমায়ুন আজাদ তখন থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে। সে যাত্রায় মৃত্যুকে খানিকটা দূরে ছেড়ে এসেছিলেন হুমায়ুন আজাদ, কিন্ত মৃত্যু তাকে ছাড়েনি।
সেবছরই খানিকটা সুস্থ হয়ে তিনি জার্মানীতে গেলেন, জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনের উপর গবেষণা বৃত্তি নিয়ে। ১১ই আগস্ট রাতে একটা অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফিরলেন, সেই রাতেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। পাশে কেউ ছিল না সেসময়। পরদিন ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হলো তার মৃতদেহ, শেষ হলো বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জ্বালাময়ী, সবচেয়ে প্রতিবাদী অধ্যায়টার। আসলেই কি শেষ হয়েছিল?
হুমায়ুন আজাদ জানতেন তার ওপর হামলা হতে পারে, তিনি মৌলবাদীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন অনেক আগে থেকেই। শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাকে বলেছিলেন, একটু নমনীয় ভাষায় লিখতে। মানুষটা সেসবে কান দেননি, নিজের স্বকীয়তা আর স্বাধীনতাকে বিকিয়ে দেননি হুমকির কাছে পরাস্ত হয়ে। তিনি চাপাতির বিরুদ্ধে কলমকে অস্ত্র বানিয়েছিলেন, দিনশেষে সেই কলমেরই জয় হয়েছে।
হুমায়ুন আজাদ মারা গেছেন আজ থেকে ঠিক ষোলো বছর আগে। এখনও তার চেতনা, তার ভাবনা- হাজারো, লাখো তরুণদের মানসপটে বিদ্যমান। তার লেখনী নিয়ে আজও গবেষণা হয়। ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি, উগ্রতা, ভণ্ডামি বা দুর্নীতি এবং সামাজিক নানা সমস্যার দিকে হুমায়ুন আজাদ বারবার যেভাবে আঙুল তুলেছেন, দৃষ্টি ফেরাতে বাধ্য করেছেন সবাইকে, এমন নিদর্শন কি এখন দেখতে পাওয়া যায়? চাটুকারিতা আর দালালির এই যুগে হুমায়ুন আজাদের মতো স্বাধীনচেতা স্বত্বারা তো ডাইনোসরের চেয়েও বিরল! শারীরিকভাবে হুমায়ুন আজাদকে হয়তো নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে মৌলবাদীরা, কিন্ত তার চেতনাকে তো দাবিয়ে রাখতে পারেনি, ছাইভস্ম থেকে আগুন হয়ে জ্বলেছে সেই চেতনার স্ফুলিঙ্গ।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন