চুং নামের এক লোক গরু বিক্রির টাকায় শুরু করেছিলেন গাড়ির গ্যারেজের ব্যবসা। যুদ্ধের ডামাডোলে সেটা হয়ে যায় বন্ধ। বাড়ি ফিরে আবার করলেন গরুর ব্যবসা। এরপর শহরে এসে শুরু করেন 'হুন্দাই' নামে এক অটোমোবাইল প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা। বাকিটা ইতিহাস। সময়ের বিবর্তনে হুন্দাই পরিণত হলো বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অটোমোবাইল কোম্পানীতে...

'হুন্দাই মোটরস' এর কথা তো আমরা সবাই-ই জানি। দক্ষিণ কোরিয়ার এই ব্রান্ড সময়ের ফেরে দখল করে নিয়েছে বিশ্বের বড় বড় বাজার। অল্প কিছুদিন পরে বাংলাদেশেও গাড়ি উৎপাদন করবে হুন্দাই। হুন্দাই যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সারাবিশ্বে, তারা ক্রমশ যে গ্রাস করবে অটোমোবাইল ব্রান্ডের বৃহৎ বাজার, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু হুন্দাই এর শুরুটা কেমন ছিলো? কীভাবে তারা আস্তে আস্তে শূন্য থেকে মহীরুহে পরিণত হলো? এই গল্পের সাথে চুং ইয়ু-ট্যাং নামক ভদ্রলোকের গল্পেরও বা সম্পর্ক কোথায়? জানবো সবই।

চুং ইয়ু-ট্যাং এর গল্প দিয়েই শুরু করি বরং। উত্তর কোরিয়ার তংচোন অঞ্চলে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম চুং এর। বাবা ছিলেন হতদরিদ্র এক কৃষক। তার সম্বল বলতে সামান্য কৃষিজমি আর কিছু গবাদিপশু। চুং ছিলেন এই গরীব বাবার বড় ছেলে। বড় ছেলে হওয়ার সেই গতানুগতিক অসুবিধে, অর্থাৎ পরিবারের প্রত্যাশার চাপ আকাশচুম্বী ছিলো তার উপরে। চুং এই প্রত্যাশার চাপে জেরবার হতেন নিয়মিত। সে সাথে তিনি পড়াশোনাও করতেন স্থানীয় এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতেন, যাতে করে ভালো একটা চাকরী পান এবং  দারিদ্র্য দূর করতে পারেন জীবন থেকে।

কিন্তু 'জীবন' মোটেও সোজা কোনো কনসেপ্ট না। চুং এর জীবনে কোনো দিক থেকেই ভালো কোনো সংবাদ আসছিলো না। ক্রমশই হতাশ হয়ে পড়ছিলেন তিনি। এরইমধ্যে তাই তিনি ফন্দি আঁটলেন। বাড়ি থেকে পালাতে হবে। ভেতরে ধারণা বদ্ধমূল হলো তার, বাড়ি থেকে না পালালে জীবনে বড়লোক হওয়া হবেনা।

সেই ইচ্ছে থেকেই কিশোর বয়সে একবার বাড়ি ছেড়ে পালান তিনি। কাছের এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে কাজের সন্ধানে চলে যান উত্তর কোরিয়ার কোউন অঞ্চলে। একটা কন্সট্রাকশন কোম্পানির অধীনে চাকরী শুরু করে চুং ও তার বন্ধু। কিন্তু সে চাকরী বেশিদিন করা সম্ভব হয় না৷ চুং এর বাবা খবর পেয়ে এসে ছেলেকে একরকম জোর করেই বাড়ি নিয়ে যান৷

হুন্দাইয়ের একটি শোরুম

চুং বাড়ি ফিরে আসেন। অবশ্যই অল্প সময়ের জন্যে। বাড়ি আসার কয়েকদিনের মধ্যেই আবার বাড়ি থেকে পালানোর প্রস্তুতি নিলেন। তবে এবার লক্ষ্য আরো দূরে। দক্ষিন কোরিয়ার রাজধানী সিউলে যাওয়া মনস্থির করলেন এবার৷ কিন্তু যাওয়ার নাহয় সিদ্ধান্ত নিলেন কিন্তু যাবেন কীভাবে? পকেট তো গড়ের মাঠ। আবার চিন্তা চলে এলো মাথায়৷

বরাবরের মতই এক বুদ্ধি আটলেন চুং। পারিবারিক গরুগুলোকে বিক্রি করে সিউলে যাওয়ার ট্রেনের ভাড়া যোগাড় করলেন তিনি। এরপর উঠে বসলেন সিউলের ট্রেনে। কিন্তু সেখানেও বেশিদিন থাকা সম্ভব হলো না। চুং এর বাবা খবর পেয়ে আবার সিউল থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এলো তাকে।

বাড়ি ফিরলো চুং। আবারও। কিন্তু সাময়িক সময়ের জন্যে। আবার বুদ্ধি পাকালো, কীভাবে পালানো যায়। বাড়িতে দুই মাস থাকার পরে আবার তিনি সিউলে চলে যান রাতের অন্ধকারে। সেখানে গিয়ে পাগলের মতন খুঁজতে থাকেন কাজ। খুঁজতে খুঁজতে এক চালের দোকানে ডেলিভারিম্যানের কাজ পেয়ে যান তিনি। সেখানে নিষ্ঠার সাথে কাজ শুরু করেন। তার কাজে খুশি হয়ে দোকানের মালিক তাকে দোকানের হিসাব রক্ষকের দায়িত্বে প্রমোশন দেন। দোকানের মালিক মারা যাওয়ার পরে চুং হয়ে যান দোকানটির মালিক। যদিও পরবর্তীতে রাজনৈতিক ডামাডোলে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো দোকানটি৷

দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে বাধ্য হয়ে আবার ফিরে আসেন পৈত্রিক ভিটেয়। কিছুকাল কৃষিকাজ করেন। এরপর আবার তিনি ফিরে আসেন সিউলে। এবার তিনি একটি গাড়ি মেরামতের গ্যারেজ খুলে বসেন। বেশ ভালোই ব্যবসা হতে লাগলো সেখান থেকে। তবে এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটিকেও দখলদার জাপান সরকার দখল করে নেয়। আবারও চুং'কে সব হারিয়ে ফিরতে হয় গ্রামে।

এরইমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। জাপানের শোষণ থেকে মুক্তি পায় কোরিয়া। কোরিয়ান সরকার দেশকে ঢেলে সাজানোর মিশনে নামে। তখনই চুং পেয়ে যায় তার নতুন ব্যবসার বুদ্ধি। সে 'হুন্দাই' নাম দিয়ে খুলে বসে একটি গাড়ির কোম্পানি। এই কোম্পানির সাহায্যে রেলখাত ও পরমাণুখাতেও কাজ করেন তিনি। আস্তে আস্তে 'হুন্দাই' হতে থাকে দেশের মধ্যে ভরসার এক নাম।

এরপরের গল্পটা পুরোটাই সাফল্যের। চুং'কেও আর ফিরতে হয়নি দেশে। ক্রমশ সে হয়ে যান কোরিয়ার সফল ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এ কোম্পানি আজ বিশ্বের অন্যতম জায়ান্ট অটোমোবাইল কোম্পানি। দক্ষিণ কোরিয়ার উলসানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইন্টিগ্রেটেড অটোমোবাইল উৎপাদক কারাখানা রয়েছে কোম্পানিটির। এ কোম্পানিতে কাজ করেন ৭৫ হাজার কর্মী। গত বছরে কোম্পানিটির বার্ষিক আয় ছিলো মোট ৯ হাজার কোটি ডলার!

বিশ্বখ্যাত 'হুন্দাই' ব্যান্ডের শুরুর দিকের গল্পটা বেশ অদ্ভুত! 

গাড়ি, ইলেক্ট্রনিক্স এর পাশাপাশি কোরিয়ান ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টেরও অনেক পণ্য তৈরী করছে হুন্দাই। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাইরে এসেছিলো তারা অনেক আগেই। ক্রমশই বিস্তৃত হচ্ছে হুন্দাইয়ের সেই কাভারেজ।

কোরিয়ান ভাষায় 'হুন্দাই' শব্দের অর্থ নতুন কিছু ভাবা। চুং ইয়ু-ট্যাং এর 'হুন্দাই' প্রতিষ্ঠার গল্প অথবা 'হুন্দাই' প্রতিষ্ঠার আগের সেই বিক্ষুব্ধ সময়ের নিরন্তর সংগ্রামের উপাখ্যান থেকে আমরা দেখি, হার না মানা ভাবনাচিন্তার  এক ছিমছাম সমীকরণ, যেখান থেকে শেখার আছে অনেক। চুং সময়ে সময়ে নিজেকে ভেঙ্গেছেন, গড়েছেন। সুযোগমত চেষ্টাও করেছেন ভালো কিছু করার। হাল তো ছাড়েনইনি। বরং যখনই ব্যর্থ হয়েছেন, পরবর্তীতে আবার দ্বিগুণ উদ্যমে ঝাপিয়ে পড়েছেন কাজে। চুং এর এই গল্প তাই অজস্র মানুষের পাথেয়, যারা সমুদ্রে শয্যা পাতার চেষ্টা করতে গিয়েও পাচ্ছেন ভয়। যারা জীবনে কিছু করতে চান, কিন্তু সব খোয়াবার ভয় পাচ্ছেন নিরন্তর, তাদের জন্যে 'চুং' হতে পারেন রবার্ট ব্রুস। তাদের জন্যে 'হুন্দাই' এর গল্প হতে পারে আশার একটুকরো বাতিঘর।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা