ফুটবল বিধাতার নিষ্ঠুরতায় বিশ্বকাপের শিরোপাটাই শুধু জেতা হয়নি পুসকাসের এই দলটার, নইলে পঞ্চাশের দশকে হাঙ্গেরির সামনে দাঁড়ানোর সাহস ছিল না কারো। ফুটবল ইতিহাসের সেরা এই দলটির করুণ পরিণতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশটির ব্যর্থ এক গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস...

সেদিন বার্নের বিকেলটা ছিলো বৃষ্টিভেজা। বিখ্যাত সুইস পাহাড়ের ফাঁক গলে উঠে এসেছিলো তুমুল কালো মেঘ। যা দেখে বিখ্যাত হাঙ্গেরিয়ান ধারাভাষ্যকার ইয়োর্গি যেপসি বলেছিলেন, "এটা যেনও আমাদের দুর্ভাগ্যের চিহ্ন না হয়"। আর  হাঙ্গেরিয়ানদের  দুর্ভাগ্যটুকুই চেয়েছিলো পশ্চিম জার্মানরা।

জার্মানরা তখন লড়াই করছে আবার মাথা উঁচু করে দাড়াতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে নয় বছর কেটে গেলেও তার প্রভাব কমেনি।  নিজেদের হারিয়ে যাওয়া ভাবমুর্তি পুনঃরায় উদ্ধার করতে তাদের দরকার ছিলো কিছু একটা যা গর্ব করার মতো হবে। সে সময়ে একটা বিশ্বকাপ ট্রফি সারা পৃথিবীর সামনে আবার নতুন করে দাড়াবার অনুপ্রেরণা দিবে এমনটাই আশা করেছিলো জার্মানরা। কিন্তু তাদের সামনে যে হাংগেরি, যারা ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স বা দ্যা ম্যাগনিফিসেন্ট ম্যাগিয়ার্স নামেই বেশি পরিচিত।  তাই ৪ই জুলাই, ১৯৫৪ এর বিকেলে, বিশ্বকাপ ফাইনাল জয়ের জন্য জার্মানদের দরকার ছিলো ফুটবল দক্ষতার  চেয়েও বেশি কিছু। সে সময় হাঙ্গেরির মুখোমুখি হলে প্রতিপক্ষ এমনটাই চাইতো। তবুও শেষ রক্ষা হতো না। এতোটাই দুর্দান্ত ছিলো হাঙ্গেরি দলটা। কিভাবে এতো দুর্দান্ত হয়ে উঠেছিলো তারা?

যুগান্তকারী কোচ এবং ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্সের উত্থান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হাঙ্গেরি দলের কোচ হয়ে আসেন গুস্তাভ সেভেস। তিনি দলে তিনটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। প্রথমত, তিনি খেলোয়াড়দের ফিটনেসের উপরে জোর দেন। তিনি যে ফর্মেশনে দলকে খেলাতে চেয়েছিলেন তাতে নব্বই মিনিট দলকে সমান পরিশ্রম করতে হতো। তাই তার দলের জন্য ফিটনেস এক অতি আবশ্যিক বিষয়। দ্বিতীয়ত, তিনি "ডিপ লাইং স্ট্রাইকার" প্রথা চালু করেন। সেসময় ট্রাইকার মানেই ছিলো ডিবক্সে দাড়িয়ে সুযোগের অপেক্ষা করা। কিন্তু হাঙ্গেরি দলের স্ট্রাইকার নিচে নেমে আক্রমণ তৈরিতে সহায়তা করতেন। আবার উইংগাররা মাঝমাঠে নেমে দলকে ডিফেন্স ও আট্যাকে সহায়তা করতো। ফলে তার দলের ফর্মেশন হতো ২-৩-৩-২, যারা খুব দ্রুত আট্যাকিং এবং ডিফেন্সিভ ট্রানজিশন করতে পারতো।

তৃতীয়ত, তিনি কোনও খেলোয়াড়ক কোনও নির্দিষ্ট পজিশন দিতেন না, বরং সারা মাঠজুড়ে খেলতে উৎসাহ দিতেন। তারা আট্যাক করতো একসাথে আবার ডিফেন্সও করতো একসাথে। যেটা পরবর্তীকালে ডাচদের হাত ধরে "টোটাল ফুটবল" নামে পরিচিত পায়। তার দলের মূল প্লেয়ার ছিলেন ৬ জন- ফেরেংক পুসকাস, সান্দোর কচসিচ, নান্দোর হিদেকুটি, যলতান জিবর, জোসেফ বসিক এবং ইয়োলা গ্রোসিচ। এর মাঝে ফেরেংক পুসকাস ছিলেন দলের মেরুদণ্ড এবং অধিনায়ক। এই ফর্মেশন ছিলো যুগান্তকারী এবং ফুটবল ইতিহাসের দিকবদলকারী দিকনির্দেশক।

সেভেচের উদ্ভাবনী কৌশল আর এইসব দুর্দান্ত  খেলোয়াড়দের মিলিত প্রচেষ্টায় হাঙ্গেরি এমন ফুটবল খেলতে শুরু করে যা আগে কেউ দেখেনি। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপের আগে পর্যন্ত মাত্র একটা ম্যাচ তারা হেরেছিলো। ১৯৫০ সাল থেকে তারা টানা ৪ বছর অপরাজিত ছিলো। কারও কারও মতে হাঙ্গেরি ১৯৫০ এর বিশ্বকাপ বয়কট না করলে তারাই টুর্নামেন্ট জিততো। ১৯৫২ সালের অলিম্পিকে তারা যুগোস্লাভিয়াকে হারিয়ে স্বর্ণপদক জয় করে।

তবে তাদের সবচেয়ে বিখ্যাত ম্যাচটি ছিলো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। সেসময় ইংল্যান্ড ছিলো বিশ্বের তিন নাম্বার দল আর হাঙ্গেরি এক নাম্বার। ইংল্যান্ড তখন পর্যন্ত নিজেদের মাঠে হারেনি, তাই হাংগেরি যখন ইংল্যান্ডে খেলতে আসে তখন সে ম্যাচ নিয়ে তীব্র উত্তেজনা শুরু হয়ে যায়। ব্রিটিশ প্রেস সে ম্যাচের নাম দেয়, "ম্যাচ অফ দ্যা সেঞ্চুরি"। কিন্তু ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামের এক লাখ দর্শকের সামনে ইংল্যান্ডকে রীতিমতো নাকানিচুাবানী খাইয়ে ৬-৩ গোলে হারিয়ে দেন হিদেকুটি, পুসকাসরা। এই ম্যাচের পর পুরো ইংল্যান্ড ফুটবল উলটপালট হয়ে যায়। তারা তাদের ফুটবল দর্শন, কোচিং স্টাইল সব বদলে ফেলে। এরপরের বছর বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে হাংগেরি গেলে আবার তারা ৭-১ গোলে পরাজিত হয়। এতোটাই দুর্দমনীয় ছিলো ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্সরা।

মিরাকল অফ বার্ন  অথবা ফুটবল বিধাতার নিষ্ঠুরতা

সুতরাং, হাঙ্গেরি অবিসংবাদিতভাবে ফেভারিট হিসেবে ১৯৫৪ এর বিশ্বকাপ শুরু করে। প্রথম ম্যাচেই তারা দক্ষিন কোরিয়াকে ৯-০ গোলে হারিয়ে দেয়। এরপরে পশ্চিম জার্মানিকে ৮-৩ গোলে হারায়। কিন্তু জার্মানদের রাফ ট্যাকলের শিকার হয়ে পুসকাস ইনজুরিতে পড়েন এবং টুর্নামেন্টে তার খেলা অসম্ভব হয়ে যায়। কোয়ার্টার ফাইনালে তারা ব্রাজিলকে ৪-২ গোলে পরাজিত করে।  তখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে কখনই না হারা উরুগুয়েও হার মেনে নেয় ৪-২ গোলে হাংগেরির কাছে। ফাইনালে যখন তারা পশ্চিম জার্মানির মুখোমুখি হচ্ছে তখন সবার বিশ্বাস ছিলো হাঙ্গেরি আর ট্রফির দূরত্ব মাত্র ৯০ মিনিট। শুধু একজন বাদে, জার্মান কোচ, সেপ হারবার্গার। তাকে যখন একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, ৮ গোল খাওয়ার পরেও জয়ের আশা করো? তিনি উত্তর দিলেন, আমরাও তিন গোল দিয়েছি। সাংবাদিক অবাক হয়ে বললেন, তাতে কি? তখন সেপ বলেন, তাতে এই আমাদের শুধু ওদের গোল করা ঠেকাতে হবে।

মাঠেও পশ্চিম জার্মানি কোচের কথার প্রতিফলন দেখা গেলো। তিনি হিদেকুটিকে মার্ক করার দায়িত্ব কোনও ডিফেন্ডারকে দিলেন না, দিলেন মিডফিল্ডারকে। যেনও হিদেকুটি নিচে নেমে আক্রমণ তৈরি করতে না পারে। বসিককে মার্ক করার দায়িত্ব দিলেন লেফট উইংগারকে। ফলে হাংগেরির ফ্রি স্টাইল আক্রমণ তৈরিতে বাধা তৈরি হলো। পুসকাস নামলেন ইনজুরি নিয়েই, সেটাও জার্মানদের পক্ষে গেলো। তবে সবচেয়ে বড় প্রভাবক হয়ে উঠলো বৃষ্টি। সেদিন বার্নে প্রবল বৃষ্টিতে ভারি হয়ে যায় মাঠ। সেখানে জার্মানরা আডিডাসের তৈরি বুট পরে খেলতে নামে, যে বুট সকল আবওহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতে পারে। ফুটবল বিশ্বের কাছে এই বুট ছিলো অচেনা। ফলে শুরুর আট মিনিটে দুই  গোল খাওয়ার পর সবাই যখন হাঙ্গেরি আরেকটা গোল উৎসবের অপেক্ষা করছে তখনই জার্মানি ম্যাচে ফিরে আসে বিশ মিনিটের মধ্যেই।

এরপরেই উত্থান হয় জার্মান গোলকীপার টুরেকের। একের পর এক সেভ করতে থাকেন তিনি। তার অতিমানবীয় পারফোমেন্সের জন্য যখন হাঙ্গেরি কিছুতেই গোল পাচ্ছিলো না তখন, খেলা শেষ হওয়ার ছয় মিনিট আগে হেলমুট রান গোল করে বসেন পশ্চিম জার্মানির পক্ষে। অবিশ্বাস খেলে যায় পুরা স্টেডিয়ামজুড়ে। পরের ছয় মিনিটে পুসকাসের গোল বাতিল হয় অফসাইডে, পেনাল্টি আবেদন বাতিল করেন রেফারি এবং শেষ মিনিটে জিবরের শট অতিমানবিক দক্ষতায় সেভ করেন টুরেক। সৃষ্টি হয় ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম ট্রাজেডি কিংবা এক রুপকথার গল্প, " মিরাকল অফ বার্ন"! ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্সদের সাত বছরের ইতিহাসে এটা ছিলো তাদের দ্বিতীয় ও সর্বশেষ পরাজয়। ফুটবল কখনও কখনও কি নিষ্ঠুর, অকরুণ।

ম্যাজিক্যাল মাগিয়ার্সের শেষ ম্যাচ অথবা অনুপ্রেরণার গল্প

কোনও দলকে নিয়ে বিপুল প্রত্যাশা থাকলে তার পরাজয়ের প্রতিক্রিয়াও হয় ব্যাপক। সে সময় হাঙ্গেরিতে চলছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত কমিউনিস্ট শাসন। তারা ফুটবল দলের সাফল্যকে নিজেদের পার্টির প্রপাগন্ডা হিসেবে কাজে লাগাতেন। তাই বার্নের ব্যর্থতা তাদের কাছে বিশাল পরাজয় হিসেবে দেখা দেয়। তারা দ্রুতই গোলকীপার গ্রসিচকে ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে গৃহবন্দি করে রাখে এবং পরবর্তীতে তাকে মূল লীগের দল থেকে বদলী করে প্রাদেশিক দলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হাঙ্গেরিয়ান জনগণের প্রতিক্রিয়াও ছিলো চরম ভয়ানক। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। তারা ফুটবল দলের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে থাকে এবং ভাংচুর করতে থাকে। অনেকে বলেন এই ক্ষোভ শুধু ফুটবলের বিরুদ্ধে নয়, বরং সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের অনাস্থাও এর কারন ছিলো।

তবে ধীরে ধীরে এর উত্তাপ কমে আসে। ম্যাজিক্যাল মাগিয়ার্স আবারও মাঠে নামে। সাধারণত বড় কোনও ফল বিপর্যয় হলে সে দলের উঠে দাড়াতে সময় লাগে। কিন্তু ম্যাগিয়ার্সরা ছিলো সম্পুর্ণ ভিন্ন। মাঠে নামতেই তারা আবার পুরানো ফর্মে চলে আসে। এরপর ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তারা টানা ১৯ ম্যাচ অপরাজিত থাকে, যার ১৬ টিতেই তারা জয় পায়। তারা সর্বশেষ ম্যাচটি খেলে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে ২৩শে সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬ সালে। তখন পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘরের মাঠে হারেনি। স্নায়ুযুদ্ধের সে সময়ে সবকিছুকেই কমিউনিজমের সাফল্য বলে প্রচার করা হতো। সোভিয়েতদের উদ্দেশ্য ছিলো হাঙ্গেরিকে হারিয়ে তাদের প্রপগন্ডা প্রচার। হাঙ্গেরি সরকার যেহেতু সোভিয়েত সমর্থিত ছিলো সেহেতু তারা কাজটা অসম্ভব ভাবেনি। তীব্র চাপেও ভেংগে পড়েনি পুসকাস, ককেসিচরা। শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করছে দারুন সাহসে। মস্কোর এক লাখ দুই হাজার দর্শককে হতভম্ভ করে হাঙ্গেরি তাদেরকে ১-০ গোলে হারিয়ে দেয়। বলা হয়, এই ম্যাচটাই শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহস জুগিয়েছিলো হাঙ্গেরির জনগণের মধ্যে। অনুপ্রেরণা দিয়েছিলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাড়াবার। এই ম্যাচের মাত্র এক মাস পরেই শুরু হয় হাঙ্গেরিয়ান গণঅভ্যুত্থান।

 

একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান এবং ইতিহাস সেরা দলের পতন

কেনও হয়েছিলো এই গণঅভ্যুত্থান, তা জানতে আমাদের একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হাঙ্গেরি নাজিদের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহন করে। যুদ্ধে মিত্রপক্ষ জয়ী হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন হাঙ্গেরি দখল করে নেয়। হাংগেরির স্বাধীনতা ছিলো সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসলে তারা একদলীয় শাসন চালু করে। তারা জনগণের মতামতের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। ফলে কয়েক বছরের মধ্যে সাত হাজারের বেশি লোক রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুম বা হত্যার শিকার হোন। এসব নিয়ে অষন্তোষের চুড়ান্ত বিস্ফোরণ হয় ২৩শে আক্টোবর, ১৯৫৬ সালে। ছাত্র বিদ্রোহ দিয়ে শুরু গণঅভ্যুত্থান এক রাতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সোভিয়েত সৈন্যদের সাথে ছাত্র ও সাধারণ মানুষের রক্তক্ষয়ী লড়াই। ফলে সরকার পতন হয়।

নতুন সরকার প্রধান ইমরে নাজি সোভিয়েত সৈন্যদের দেশত্যাগ করতে বলেন। প্রথমে তারা রাজি হয়। বিক্ষোভ অনেকটা শান্ত হয়ে আসে এরপরে। ২৮ তারিখ থেকে নভেম্বরের ৩ তারিখ পর্যন্ত শান্ত অবস্থা জারি থাকে। ইমরে নাজি ঘোষণা দেন বহুদলীয় সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তনের এবং সোভিয়েত সমর্থিত ন্যাটো চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার। পরের দিন সোভিয়েত সৈন্যরা ট্যাংক নিয়ে বুদাপেস্টে ঢুকে পড়ে এবং বিদ্রোহীদের দমন করতে শুরু করে। গ্রেফতার হন ইমরে নাজি। ১০ তারিখ পর্যন্ত টানা অভিযানে বিদ্রোহীরা পরাজিত হয় এবং সোভিয়েত সমর্থিত সরকার আবার ক্ষমতায় আসে। এই বিদ্রোহে ৩০০০ এর বেশি মানুষ নিহত হন। বিদ্রোহ দমনের পর জানুয়ারি পর্যন্ত চলে বিদ্রোহীদের ধড়পাকড় এবং বিচার। দুই লাখের উপরে মানুষ দেশ থেকে পালিয়ে বিভিন্ন দেশে শরনার্থী হোন।

ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্সও জড়িয়ে পড়ে এই অভ্যুত্থানের সাথে। সে সময় তারা জাতীয় দলে ছিলেন না। খেলছিলেন হনভেদ ক্লাবের হয়ে। বুদাপেস্ট  হনভেদ ক্লাব ছিলো হাঙ্গেরি লীগ চ্যাম্পিয়ন এবং সে দলে ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স এর আটজন খেলোয়াড় ছিলেন। ইউরোপিয়ান কাপ ( বর্তমান চ্যাম্পিয়নস লীগ) খেলতে তারা তখন দেশের বাহিরে। সেসময় গণবিদ্রোহ শুরু হলে তারা আর দেশে ফেরেননি। তারা বিদ্রোহীদের সমর্থন দেন। অধিনায়ক পুসকাস প্রকাশ্যে সরকার এবং ফুটবল ফেডারশনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। যদিও সেসময় তাদের পরিবার দেশে ছিলো, তারা জানতেন না তাদের কি অবস্থা। তবু তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে আসেননি। তবে অনেকের পরিবার দেশ ছেড়ে আসতে সমর্থ হলে তারা স্পেন, ইতালী এবং পর্তুগালে চ্যারিটি ম্যাচ খেলতে থাকেন। যদিও তীব্র চাপ ছিলো তাদের উপরে। কিন্তু এসব ম্যাচ খেলে তারা বিদ্রোহীদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেন।

এতে হাঙ্গেরিয়ান সরকার এবং ফুটবল ফেডারেশন তাদের উপরে প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ হয়। তাদেরকে দেশে ফিরে আসতে বললেও তারা তা উপেক্ষা করে ব্রাজিল চলে যান এবং চ্যারিটি ম্যাচ খেলতে থাকেন। হাংগেরি সরকার ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিফার উপরে চাপ সৃষ্টি করে হনভেদ ক্লাবকে নিষিদ্ধ করার জন্য। মেক্সিকো তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে চাইলেও তারা তা প্রত্যখান করে তাদের বিদ্রোহ চালু রাখেন। একসময় হাঙ্গেরি সরকার সফল হয়। ফিফা হনভেদ ক্লাবের নাম নিয়ে কোনোও ম্যাচ খেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। অগত্যা তারা ইউরোপে ফিরে আসেন। অধিকাংশ সদস্য দেশে ফিরে যান, সেখানে গিয়ে কেউ কেউ ফুটবল ছেড়ে দেন। কুবালা, জিবর, ককসিচ স্পেনে বার্সেলোনায় থিতু হোন। আর ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্সদের মেরুদণ্ড পুসকাস চলে আসেন মাদ্রিদে, পরিণত হন রিয়াল মাদ্রিদ কিংবদন্তীতে। এভাবেই বিছিন্ন হয়ে যান তারা। আর কখনই তারা হাঙ্গেরির জার্সি গায়ে মাঠে নামেননি। পতন হয় ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স সম্রাজ্জের। বার্নের সেই বিকেলের মতোই বিষন্ন, করুন গল্পের মতো।

ধীরে ধীরে হাঙ্গেরিয়ান ফুটবলও অবনমিত হতে থাকে। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপে ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স এর চার সদস্য খেললেও তারা যেনও ছিলো অতীতের কংকাল। এরপরে হাঙ্গেরি আর কখনই বড় সাফল্য পায়নি। বরং একের পর এক বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার ব্যর্থতা তাদেরকে ফুটবল মানচিত্র থেকে মুছে দেয়।তারপর কেটে গেছে বহুদিন। হাঙ্গেরিতে পতন হয়েছে কমিউনিস্ট সরকারের। ১৯৫৬ সালে নিজেদের ভূমিকার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্ষমা চেয়েছে হাঙ্গেরির কাছে ১৯৮৯ সালে। ২৫ বছর নির্বাসনে থাকার পর দেশে ফেরার আনন্দে পুসকাস ভেসে গেছেন শিশুর মতো কান্নায়। ধীরে ধীরে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স এর সব সদস্য। তবুও আজও হাঙ্গেরির মানুষের পরম মমতায় মনে করেন পূর্নতা না পাওয়া গল্পের নায়কদের। আর সারাবিশ্বের ফুটবলপ্রেমিরা তাদের মনে রেখেছেন ফুটবল খেলাটির চেহেরা বদলে দেওয়া ইতিহাসের সেরা দল হিসেবে। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা