মসজিদের বাইরে থেকে ফরিদ আহমেদকে ততক্ষণে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়েছে লোকজন। অধীর আগ্রহে তিনি অপেক্ষা করছিলেন স্ত্রীর ফিরে আসার। কিছুক্ষণ পরেই তাকে দেয়া হলো দুঃসংবাদটা, তার স্ত্রী আর বেঁচে নেই!
রইস উদ্দিন ভূঁইয়ার নাম শুনেছেন আপনারা? ভদ্রলোক জাতীয়তায় বাংলাদেশী, চাকুরীর সন্ধানে পাড়ি জমিয়েছিলেন সুদূর আমেরিকায়। ৯/১১-এর উত্তাল সময়টায় আমেরিকায় যখন মুসলমানদের ওপরে হামলা হচ্ছে এখানে সেখানে, রইসউদ্দিনও তখন হয়েছিলেন এমনই এক বিকৃতমনস্ক ব্যক্তির প্রতিহিংসার শিকার। শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার অপরাধে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে শটগান দিয়ে গুলি করা হয়েছিল রইসউদ্দিনকে, সমস্ত মুখমণ্ডল ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল তার! যমে মানুষে টানাটানি করে ডাক্তারেরা তার জীবন বাঁচিয়েছিলেন, তবে আঠারো বছর আগের সেই ক্ষতগুলো এখনও তার সঙ্গী।
সুস্থ হবার পরে রইসউদ্দিন কি করেছিলেন জানেন? যে লোকটা তার প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে হামলা চালিয়েছিল, সেই ঘাতক মার্ক স্ট্রম্যানকে বাঁচানোর জন্যে লড়াই শুরু করেছিলেন তিনি! পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া স্ট্রম্যানকে আইনের হাত থেকে মুক্ত করার জন্যে একাধিকবার আপিল করেছেন তিনি, তাতে অবশ্য লাভ হয়নি খুব একটা, আদালতের রায়ে বদল আসেনি। ত্নে স্ট্রম্যান কিন্ত রইসের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন, বলেছিলেন, তিনি অনুতপ্ত! স্ট্রম্যানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার পরে তার পরিবারকেও যথাসাধ্য সাহায্য করেছিলেন রইসউদ্দিন।
এবার আরেকটা মানুষের গল্প বলি। বছরখানেক আগের কথা, আসানসোলের দাঙ্গায় ষোল বছরের কিশোর সিবগাতুল্লাহকে খুন করা হয়েছিল নৃশংসভাবে। কুপিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে লাশটা এমনভাবে বিকৃত করা হয়েছিল যে, পরনের জামাকাপড় ছাড়া সেটাকে চিহ্নিত করার কোন উপায়ই ছিল না। আসানসোলের মুসলমানেরা তখন ক্ষোভে ফুঁসছে, ভাই হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে তৈরি হয়ে গিয়েছে শত শত তরুণ!
সিবগাতুল্লাহ'র বাবা ছিলেন আসানসোলের স্থানীয় একটা মসজিদের ইমাম, তার নাম ইমদাদুল্লাহ রাশিদী। ছেলের জানাজা পড়াতে গিয়ে এলাকার মানুষের মনোভাব বুঝতে দেরী হলো না তার, আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর চোখে প্রতিশোধের আগুন দেখতে পেলেন তিনি। নিজের করণীয় ঠিক করে ছেলের লাশের সামনে দাঁড়ালেন ইমদাদুল্লাহ, বরফের মতো ঠান্ডা কণ্ঠে বললেন, ছেলের হত্যাকারীকে তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন, উপস্থিত জনতাও যাতে সেটা করেন। স্পষ্ট করে তিনি বললেন, আমি আমার ছেলেকে হারিয়েছি, সেটার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে যেন আর কোন মায়ের কোল খালি না হয়! নইলে তার ছেলের আত্মা শান্তি পাবে না। সেদিন ইমদাদুল্লাহ'র সেই বক্তব্যই পশ্চিমবঙ্গ কিংবা পুরো ভারতকে রক্ষা করেছিল ভয়াবহ এক দাঙ্গার হাত থেকে!
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে হামলার স্মৃতিটা এখনও তরতাজা। ৪৯ জন নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন সেই হামলায়, এদের প্রায় সবাই মুসলমান। নিহতদের মধ্যে আছেন কমপক্ষে তিনজন বাংলাদেশীও। এদেরই একজন হুসনা আহমেদ। গত শুক্রবার দুপুরে স্বামী ফরিদ আহমেদের সঙ্গে সেই মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন হুসনা। সড়ক দুর্ঘটিনায় আহত ফরিদ আহমেদ পায়ে হেঁটে চলাফেরা করতে পারেন না, সার্বক্ষণিক হুইলচেয়ারই তার সঙ্গী। মসজিদের পুরুষদের অংশে স্বামীকে ঢুকিয়ে দিয়ে, নারীদের জন্যে নির্ধারিত অংশে এসে বসেছিলেন হুসনা। তখনই শুরু হলো হামলা।
এক সাক্ষাৎকারে ফরিদ আহমেদ বলছিলেন, মসজিদ থেকে বেঁচে ফেরার আশা তিনি ছেড়েই দিয়েছিলেন। মৃত্যুকে বরণ করে নেয়ার প্রস্তুতিটাও নিয়ে রেখেছিলেন মানসিকভাবে। তখনই স্ত্রী হুসনা আহমেদ ছুটে আসেন তার কাছে, তারপর হুইলচেয়ার ঠেলে তাকে নিয়ে আসেন মসজিদের বাইরে। ভেতরে আটকে পড়া নারী আর শিশুদের সাহায্য করার জন্যে আবার ভেতরে ছুটে যান হুসনা। কিন্ত তিনি আর ফিরে আসেননি, উগ্রপন্থী সেই জঙ্গীর নিশাণায় পরিণত হন হুসনা। মসজিদের বাইরে থেকে ফরিদ আহমেদকে ততক্ষণে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়েছে লোকজন। অধীর আগ্রহে তিনি অপেক্ষা করছিলেন স্ত্রীর ফিরে আসার। কিছুক্ষণ পরেই তাকে দেয়া হলো দুঃসংবাদটা, তার স্ত্রী আর বেঁচে নেই!
১৯৯৪ সালে স্বামীর সাথে নিউজিল্যান্ডে পাড়ি জমান সিলেটের বিশ্বনাথের হুসনা আহমেদ। ২০০৪ সালে দেশে আসেন তারা, তখনই এক সড়ক দুর্ঘটনায় দুই পা হারান স্বামী ফরিদ আহমেদ। সেই থেকে তিনি হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। প্রায় দুই যুগ ধরে নিউজিল্যান্ডে বসবাস করছেন এই দম্পতি, পনেরো বছর বয়সী একটা কন্যাসন্তান আছে তাদের। নিউজিল্যান্ডে নিজেদের দেশের মতোই মানিয়ে নিয়েছিলেন তারা। কিন্ত কে জানতো, শান্তির দেশে অশান্তির কালো মেঘ এসে হানা দেবে! তবে স্ত্রীকে অকালে হারালেও, খুনী ব্র্যান্ডন ট্যারেন্টের প্রতি একটুও ক্ষোভ বা ঘৃণা নেই ফরিদ আহমেদের। সাক্ষাৎকার নিতে আসা সাংবাদিকদের অবাক করে দিয়েই কথাটা বলেছেন তিনি। স্ত্রীকে হারানোর শোক একপাশে সরিয়ে রেখে মহানুভবতার দরজা খুলে দিয়েছেন ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেছিলেন,
'আমার স্ত্রী সব সময় বলতেন, কারো প্রতি ঘৃণার মনোভাব দেখিও না, সবাইকে সব সময় ভালোবাসবে। তাহলেই পৃথিবীতে শান্তি আসবে। আমি সত্যিই তাকে(খুনি) ক্ষমা করে দিয়েছি। আমার মনে হয় তার জীবনে কোনো কালো অধ্যায় আছে। হয়তো সে কখনো কারো ভালোবাসা পায়নি। আমি তাকে ঘৃণা করতে পারি না, সত্যিই পারি না। হুসনা যা চাইত, আমিও তা-ই চাই। আর তা হচ্ছে ক্ষমা, আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি...'
ইসলাম আর মুসলিমদের সঙ্গে যারা জঙ্গীবাদকে মিলিয়ে ফেলে বারবার, তাদের জন্যে এরকম উদাহরণ খুঁজলে আরও হাজার হাজার পাওয়া যাবে। ইসলাম ক্ষমার কথা বলেছে বারবার, ক্ষমাকে মহত্বের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করেছে। রইসউদ্দিন, ইমাম ইমদাদুল্লাহ কিংবা ফরিদ আহমেদ, তারা সবাই ইসলামের সেই আদর্শকেই মহিমান্বিত করেছেন বারবার। মুসলমান শব্দটা শুনলেই যাদের মানসপটে আইসিস জঙ্গীদের মুখোশে ঢাকা চেহারা ভেসে ওঠে, তাদের জানানো দরকার, প্রকৃত মুসলিম কিন্ত এই রইসউদ্দিন, ইমদাদুল্লাহ কিংবা ফরিদ আহমেদরাই...