স্বাধীন হায়দরাবাদ যেভাবে ভারতের অংশ হলো!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
দেশভাগের সময় বৃটিশরা হায়দরাবাদকে স্বাধীনতা দিয়ে গিয়েছিল, আকারে বাংলাদেশের চেয়েও অনেক বড় এই প্রদেশটা শাসন করতো মুসলিম নিজামরা। সেই স্বাধীন অঞ্চলটা কীভাবে ভারতের একটা রাজ্যে পরিণত হলো?
ভারতের দক্ষিণের তেলেঙ্গানা রাজ্যের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর 'হায়দরাবাদ'। অবশ্য বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছরে রেস্টুরেন্টগুলোয় যেভাবে হায়দরাবাদী বিরিয়ানি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এবং আইপিএলে মুস্তাফিজুর রহমানের সূত্র ধরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধিকাংশ লোকই নিশ্চিতিভাবে এখন শহরটিকে চিনে। কিন্তু যেভাবে আমরা বর্তমানে এটিকে ভারতের একটি রাজ্যের শহর হিসেবে দাবী করছি, ভারতের স্বাধীনতার সূচনালগ্নেও বিষয়টি এরকম ছিল না। বরং হায়দরাবাদ ছিল একটি স্বাধীন ভূখন্ড, এমনকি ভারতের স্বাধীনতার পরেও দীর্ঘ বারোমাস তাদের এই স্বাধীনতা অক্ষুন্ন ছিলো!
খানিকটা অবাক হলেন তাই তো? ১৯৪৮ সালে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার বল্লভ পাটেলের শক্ত ভূমিকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে হায়দরাবাদ প্রদেশ ভারতের একটি অতিকায় অংশ হয়ে ওঠে। আজ সেই হায়দরাবাদের স্বাধীনতা, পরাক্রমশালী নিজামদের দুশো বছরের শাসন, ব্রিটিশদের প্রতি তাদের নতজানু নীতি সবশেষে কিভাবে, কিরকম পরিণতি লাভ করে সেটির সারসংক্ষেপই আপনাদের শোনাতে চাইছি।
বহমান মুসি নদীর তীরে গড়ে ওঠা বিখ্যাত শহর হায়দরাবাদ। ইতিহাসের বারুদ যে শহরের আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে, চমৎকার প্রাচীন আবহ যে শহরের সম্বল সেই হায়দরাবাদে একসময় ছিল নিজামদের ডামাডোল। ঘটনার সূত্রপাত আঠারোশো শতকের শুরুতে। সম্রাট আওরঙ্গজেব এর মৃত্যুর পর, মুঘল সাম্রাজ্য তখন ক্রমশঃ দুর্বল হতে শুরু করেছে। পরিস্থিতির সর্বোচ্চ ফায়দা নিয়ে ১৭২১ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সুবাদার কামারুদ্দীন খান হায়দরাবাদকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা দিয়ে নিজাম-উল-মূলক উপাধি নিয়ে রাজ্য শাসন করা শুরু করেন, যা ১৭২৪ এ প্রতিপক্ষের সাথে এক যুদ্ধের পর পাকাপোক্ত হয়।
১৭৯৮ সালে পুরো ভারতবর্ষে যখন ভিনদেশী ব্রিটিশদের আধিপত্য বিস্তার লাভ করেছে, তখন নিজেদের রক্ষার খাতিরে নিজামরা দৃঢ় কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরির পথে অগ্রসর হয়। ব্রিটিশরা বাণিজ্যসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তার নিরিখে অন্য রাজ্যগুলো হতে যাবতীয় সকল প্রকার নিরাপত্তার প্রস্তাব দেয়, কিন্তু বড় শর্ত হলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিভুক্ত সৈন্যদের ভরণপোষণের সকল খরচ হায়দরাবাদকে চালাতে হবে। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম রাজ্য হিসেবে হায়দরাবাদের নিজাম নিজেদের স্বতন্ত্র প্রভাব বজায় রাখার লক্ষ্যে অপকটে এই প্রস্তাব মেনে নেয়। সময়ের পরিক্রমায় স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখতে মারাঠিদের সাথে ব্রিটিশদের লড়াই, এমনকি পাশ্ববর্তী মহীশুরের সুলতান হায়দার আলী এবং টিপু সুলতানের সংগ্রামেও নিজামদের কোনো অংশগ্রহণ তো ছিলই না, বরং নির্লজ্জভাবে তারা ব্রিটিশদের পক্ষাবলম্বন করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও তারা ব্রিটিশদের সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করে। ব্রিটিশরা নিজামকে নিজেদের সবচাইতে বিশ্বস্ত মিত্রের আখ্যা দেয়।
উনিশ শতকের শুরুতে হায়দরাবাদে নিজাম হন তথা ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন মীর ওসমান আলী খান। যিনি ছিলেন বিগত নিজামদের তুলনায় অতি বিত্তশালী এবং শক্তিমান। তুখোড় সেনাপতিদের দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন দক্ষ সেনাবাহিনী। বলা হয়ে থাকে, তৎকালীন সময়ে ওসমান আলীর বাৎসরিক আয় হতো প্রায় নয় কোটির মুদ্রারও বেশি। নিজস্ব বাহিনীর সাথে মুদ্রা ব্যবস্থা (উসমানিয়া সিক্কা নামে প্রচলন ছিল), বিমান পরিবহন ব্যবস্থা, রেল ব্যবস্থা, টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি, ডাকব্যবস্থা, বেতার কেন্দ্র- কি ছিলো না তাঁর! এমনকি তিনি রাজ্যের নিজস্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংক হায়দরাবাদ স্টেট ব্যাংক চালু করেন, যা এখনো আছে। বাৎসরিক বাজেটের ১১% শিক্ষাখাতে ব্যয়ের পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল এমনটাও শোনা যায়। নারী এলিজাবেথ এর বিয়ে উপলক্ষে তিনি হীরা খচিত একটি মূল্যবান হার উপহার দিয়েছিলেন যা হায়দরাবাদের নিজামের হার বলে পরিচিত। এভাবেই আপাতদৃষ্টিতে নিজামদের চমৎকার শাসন ব্যবস্থা ও ব্রিটিশদের সাথে পারস্পরিক স্বার্থের আদান প্রদানে, বছরের পর বছর অতিবাহিত হচ্ছিলো।
অপরদিকে সর্ব ভারতীয় আদর্শকে উজ্জীবিত করে দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলনের সুপরিণতিতে, ব্রিটিশদের অধীন হতে কংগ্রেস পার্টির নেতৃত্বে ভারত স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছায়। যেহেতু মুসলিম লীগ আলাদাভাবে মুসলিমদের জন্য ভূখন্ড দাবী করে তাই বেশ পাকিস্তান সৃষ্টির প্রস্তাবের বাইরেও কিছু স্বতন্ত্র প্রদেশ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। স্বাভাবিকভাবে হায়দরাবাদ এসবের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল। মুসলিম শাসক দ্বারা দীর্ঘদিন এই রাজ্য চললেও, রাজ্যটি ছিল মূলত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ (প্রায় মোট জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশ)। তবে ব্রিটিশদের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত মিত্র ও দারুণ বোঝাপড়া থাকায় প্রথমদিকে ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন খানিকটা নরম সুরেই ব্যাপারটা সুরাহা করতে চাইলেন।
হায়দরাবাদের কাছে তিনটি সাধারণ প্রস্তাব আসে। প্রথম দুটি হলো, হয় তারা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবে নাহয় ভারতের সাথে। শেষটি ছিল, তারা স্বাধীন ভূখন্ড হিসেবে থাকতে চাইলে সেটিও পারবে। নিজাম মীর ওসমান আলী খান তৃতীয় প্রস্তাবটি লুফে নেন, যা বাস্তবতার আলোকে একপ্রকার অসম্ভব বিষয়ই ছিল। প্রথমত অন্ধপ্রদেশ ভারতের প্রায়ই মাঝামাঝি অবস্থিত, দ্বিতীয়ত এটির সাথে কোনো সমুদ্রপথে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। চারদিকেই ভারতের সীমান্ত, আর ভারতও চাইবেনা তাঁর মধ্যবর্তী অংশে দুই লক্ষ বর্গকিলোমিটারের একটি দেশ থাকুক, যা নিকট ভবিষ্যতে দুদেশের পরস্পর সার্বভৌমত্বকেই চ্যালেঞ্জ করে বসবে। তাই কংগ্রেস পার্টি স্বভাবতই বেঁকে বসে। লর্ড মাউন্টব্যাটেনও ব্যাপারটা বুঝে তিনি ভারতে থাকাকালীন এই সমস্যার সমাধানের জন্য নিজামদের অগ্রসর হওয়ার পরামর্শ দিয়ে, পাকিস্তানের সাথে না হয়ে বরং ভারতের সাথে যুক্ত হতে বলেন।
ব্রিটিশরা বন্ধুত্বের পরীক্ষায় পিছু হটলেও, মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলেমিন (যা মুসলিম অভিজাত ও নবাবদের নিয়ে গঠিত দল) পরামর্শে হায়দরাবাদের নিজাম স্বতন্ত্রতা বজায় রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে ভারতের সাথে যুক্ত হওয়ার বিষয়কে প্রত্যাখান করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের স্থপতি চৌধুরী রহমত আলী স্বাধীন হায়দরাবাদকে 'উসমানিস্তান' নাম দেয়ার প্রস্তাব দেন।
স্বাধীনতা অর্জনের পর কংগ্রেস পার্টিকে শুরুতে বেশ কণ্টকাকীর্ণ পথই পাড়ি দিতে হয়। সহ-প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার বল্লভ পাটেল অখন্ড ভারতের জয়গান তুলে, একে একে খাসি প্রদেশ, রাজপুতানা প্রদেশ (বর্তমান রাজস্থান), গুজরাট, গোয়ালিয়র (মধ্যপ্রদেশের একটি জেলা), জুনাগড়, ত্রিপুরা, কাশ্মীর, হায়দরাবাদ, মহীশুরসহ সকল রাজ্যকে একবিন্দুতে আনার প্রচেষ্টায় আধুনিক ভারত গড়ে তোলায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৪৬ সালে ভারত স্বাধীনতা আইন অনুসারে, অবশ্য বেশিরভাগ রাজ্য হিন্দু অধ্যুষিত হওয়ায় তারা এমনিই পেত। অবশ্য অনেক রাজ্য বা প্রদেশের স্বাধীন রাজারা সরদারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কোনো সংঘর্ষ লিপ্ত না হয়ে ভারতের সাথে একাত্ম হয়। এদিকে স্বাধীনতার শুরুতে নিজাম ও ভারত সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি হয় যেখানে ভারত, হায়দরাবাদের আন্তর্জাতিক ও সুরক্ষার বিষয়টি দেখার অঙ্গীকার করে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় হায়দরাবাদের নিজাম এর গোঁয়ার্তুমিকে কোনোভাবেই সামলাতে পারছিলেন না নেহেরু এবং সরদার৷ তাই হায়দরাবাদ প্রতিনিয়ত ভারতের হৃদয়ে বড় ক্ষত হয়ে উঠছিলো।
এদিকে মীর ওসমান আলীও প্রচন্ড প্রতিকূল সময় পার করছিলেন। ক্রমশই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছিলো হায়দরাবাদ। ১৯৪৬ সাল থেকে সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে তেলেগু ভাষাভাষীর চাষীদের মধ্যে বিদ্রোহ দানা বাঁধতে শুরু করে। যা 'তেলেঙ্গানা শ্রমিক বিদ্রোহ' হিসেবে সমধিক পরিচিত। এই আন্দোলন ও বিদ্রোহের নেতৃত্বে দিয়েছিলো ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি। প্রায় কয়েক হাজার গ্রামে, কৃষকরাই এই আন্দোলন গড়ে তোলে এবং কয়েক লাখ ফসলী জমি নিজেদের কব্জায় এনে গরীব কৃষকদের নিকট বিলিয়ে দেয়। এই বিদ্রোহ দমনে মুসলিম জমিদারদের চাপ ও সহযোগিতায় নিজাম ওসমানী গড়ে তোলেন উগ্রবাদী 'রাজাকার' বাহিনী, যার নেতৃত্বে ছিলেন সৈয়দ কাশিম রাজবি। সামরিক শক্তি প্রয়োগের ফলে অসংখ্য গ্রামে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে, যা এক পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক রূপ নিয়ে হিন্দু কৃষক ও মুসলিম কৃষকের সংঘর্ষে রূপ নেয়।
তাছাড়া ১৯৩৮ সালের পর থেকেই উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রভাবও হায়দরাবাদ জুড়ে বাড়তে থাকে, যা এধরনের ঘটনা প্রবাহকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিকে নিয়ে যায়। এতে অভিজাত মুসলিম পরিবার যারা নিজামের মিত্র হিসেবে বিবেচিত ছিল, তারাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পাশাপাশি রাজ্যে কংগ্রেস পার্টি নিজস্ব কর্মীবাহিনীকে সক্রিয় করে তোলে অভ্যন্তরীণ সমস্যার জালে নিজামকে বেকায়দার ফেলার জন্য। তাই ওসমান আলী রাজ্য থেকে কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করেন। বলা হয়ে থাকে, এসময় প্লেগ মহামারীও দেখা গিয়েছিলো। খাদ্য সংকটে অস্থিবরতা নেমে এসেছিলো জনজীবনে। সব মিলিয়ে নিজাম ওসমান আলীর ভিতটা ততদিনে নড়ে গেছে। তবে তাঁর পরিণতি আরো ত্বরান্বিত করে সেনাপ্রধান কাশমি রাজবির রাজাকার বাহিনী। এরা শুধু ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠনে রূপ লাভ করেছিলো তা নয়, পাশাপাশি কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের গুপ্তহত্যায় লিপ্ত হয়েছিলো৷ এতে হায়দরাবাদের আইন শৃঙখলার চরম অবনতি ঘটে।
অপরদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছেও নানামুখী চাপ আসতে থাকে, ফলে নেহেরু-সরদার জুটি শীঘ্রই ব্যাপারটার মীমাংসা করতে চান৷ যদিও নেহেরু খানিকটা ধৈর্য্যের পরিচয়ই দিয়েছিলেন। তিনি শুরুতে সেনা হস্তক্ষেপের পক্ষপাতী ছিলেন না। এতে দীর্ঘ সময় গড়িয়ে যাওয়ায় সরদার পাটেল অসন্তুষ্ট হন। পরে মহাত্মা গান্ধী, এই বিষয় মীমাংসায় পাটেলের যেকোনো সিদ্ধান্তকেই স্বাগত জানানোর কথা বললে নেহেরুও সেই বিষয়ে একমত হন। নিজামের প্রধানমন্ত্রী মীর লায়েক আলীর সাথে সরদার বল্লভ এর আলোচনা হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। কিছুদিন পরেই ওসমান আলীর চূড়ান্ত ভুল ছিল পাকিস্তানকে দুই কোটি টাকা অর্থ সাহায্য দেয়া, যার ফলে ভারত স্বাভাবিকভাবে চুক্তি লঙ্ঘনের ধুয়ো তুলে বিষয়টি মোকাবেলা করার সুযোগ পায়। পরে অবশ্য পাকিস্তান দূতাবাসে অর্থ আদান প্রদানের কথা স্বীকার করলেও, তাঁর অজান্তে অর্থমন্ত্রী এমন করেছিলেন বলে নিজাম এই দাবী করেন। ১৯৫৪ সালে ব্রিটিশ আদালতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেই অর্থ ফেরতের জন্য মামলাও করেছিলেন। যে মামলা ২০১৯ সালে নিজামের পক্ষে ভারত জিতে আসে। পাকিস্তানকে তাই ভারতকে ৩৫ মিলিয়ন ইউরো দিতে হবে।
পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে সেপ্টেম্বরে ভারত সরকার সেনা বাহিনীকে হায়দরাবাদের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনার দায়িত্ব প্রদান করেন। এটি 'পোলো' অপারেশন নামে পরিচিতি পেয়েছিল, এবং মিডিয়ার কাছে মূলত পুলিশ বাহিনীর তৎপরতা হিসেবেই এটিকে উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৩-১৬ সেপ্টেম্বর, এই চারদিন ভারতীয় সেনা হায়দরাবাদে সশস্ত্র হামলা চালায়, এবং বিভিন্ন দুর্গ ও এলাকা অভিযান চালাতে থাকে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর গুর্খা, পাঞ্জাব রেজিমেন্ট মূলত এই প্রত্যক্ষ হামলায় অংশ নেয়৷ হায়দরাবাদের প্রাদেশিক সেনা ও রাজাকার বাহিনী সর্বশক্তি প্রয়োগ করলেও, তা ভারতীয় সেনার সম্মুখে বেমালুম কালক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
এখানে উল্লেখ্য, হায়দরাবাদের প্রাদেশিক বাহিনী আকারে বেশ বড় হলেও, এর মধ্যে সুপ্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সৈন্যের সংখ্যা ছিল মাত্র ছয় হাজার। একে একে জালকোট, দোগরা, রাজেশ্বর, আওরঙ্গবাদ, ওসমানাবাদ, মোমিনাবাদসহ বিভিন্ন শহরে নিয়ন্ত্রণ নিজাম হারাতে থাকে। এমতাবস্থায় কমিউনিস্টদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে কংগ্রেস ঠেকানো আহ্বান জানালেও তা আর হালে পানে পায়নি। ১৭ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সেনারা বিদার, ছিটয়াল, হিঙ্গোলি পার করলে অক্ষম নিজাম পরাজয় স্বীকার করে নেন। ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি এবং হায়দরাবাদের সেনাপ্রধান মেজর এল এদ্রুস আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ করেন, কাশিম রাজবি গ্রেফতার হন। অপারেশন পোলো সফল হয়। পরবর্তীতে এসকল ঘটনার জেদ ধরে মারাঠাওয়াড়া ও রাইচুর দোয়াবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হয়। তাই বলতে হয়, এর রেশ ছিল দীর্ঘদিন। ১৯৫৬ সালে হায়দরাবাদকে যুক্ত করে অন্ধপ্রদেশ ভারতের একটি গণরাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পরবর্তীতে অন্ধপ্রদেশ তিনটি রাজ্য তথা অন্ধ্র, কর্ণাটক ও হাল আমলে তেলেঙ্গানা রাজ্যে বিভক্ত হয় এবং কিছু অংশ মহারাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত হয়। আজকের তেলেঙ্গানা রাজ্যটিকে তৎকালীন হায়দরাবাদ রাজ্যের নব সংস্করণই বলা হয়ে থাকে।
তবে আজও অনেকেই বিষয়টিকে দুইভাগে দেখার চেষ্টা করে। কেউ মত দেয় স্বাধীন ভারতের একধরনের আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের সূচনায় হায়দরাবাদ নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য হারিয়েছিলো, আবার কেউ বলে নিজাম মীর ওসমান আলী খানের বিচক্ষণতার অভাব, বিভিন্ন হঠকারী সিদ্ধান্ত এবং অতিমাত্রায় সাম্প্রদায়িক কাশিম রাজবীকে গুরুত্ব দেয়ার ফলাফল স্বরূপ এমনটি হয়েছিলো৷ প্রায় সত্তর বছর পর ২০১৩ সালে ভারতীয় সরকার একটি তদন্ত নথি জনসম্মুখে আনলে সেখানে মাত্র কয়েক হাজার মৃতের সংখ্যা উল্লেখ থাকলেও তা মানতে নারাজ অনেকেই৷ কেউ কেউ গণহত্যার মতো গুরুতর অভিযোগও তোলে, যা বরাবরই ভারত সরকার অস্বীকার করেছে। এভাবেই কৃষক বিদ্রোহ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সেনাবাহিনীর সশস্ত্র হস্তক্ষেপ, প্লেগ ও দুর্ভিক্ষের আঘাতে জর্জরিত ৮৬ হাজার বর্গমাইলের অতিকায় (যা বাংলাদেশের চেয়েও বৃহৎ) হায়দরাবাদ রাজ্যটির সার্বভৌমত্ব ভারতের মধ্যে মিশে গেছে। আর বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে গেছে অগণিত মানুষের জীবন ও রক্তের পরিমাপ।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন