তিন টাকার ডিম, এক ডলারের আইসক্রিম ও আমাদের বোধবুদ্ধিহীন আচরণ
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মানুষের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, জীবনে বুঝি কেউ আইসক্রিম খায়নি, আইসক্রিম বস্তুটা চোখেও দেখেনি, আইসক্রিম নামে যে একটা খাবার দুনিয়াতে আছে- অনেকে সম্ভবত সেটাও জানে না...
বছর তিনেক আগের কথা। বিশ্ব ডিম দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ পোলট্রি কাউন্সিল খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইন্সটিটিউটে তিন টাকায় ডিম বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছিল। সেই উদ্যোগের উদ্দেশ্য ছিল, একদম হতদরিদ্র মানুষ যেন অল্প দামে ডিম কিনে খেতে পারে। কিন্ত এটা তো বাংলাদেশ, এখানে এরকম অফার পেলে বড়লোকেরাও দরিদ্র্য হয়ে যায়, নিজের ভাগটা বুঝে পেতে যুদ্ধ শুরু করে দেয়।
যেটা বলছিলাম, তিন টাকায় ডিম বিক্রির গল্প। নির্ধারিত দিনে ভোররাত থেকেই লোকজন এসে লাইন দিনে শুরু করলো, দেখতে দেখে সেই লাইন খামারবাড়ি ছাড়িয়ে সংসদ ভবন পর্যন্ত চলে গেল। দুই কিলোমিটার লম্বা হয়ে গেল লাইন, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো হট্টগোল আর হইচই। ধাক্কাধাক্কি তো ছিলই, কয়েক জায়গায় মারামারির ঘটনাও ঘটেছে! পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে পুলিশকে আসতে হয় ঘটনাস্থলে, লাঠিচার্জ করে উন্মত্ত জনতার ওপর। বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে ডিম বিক্রিই বন্ধ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ পোলট্রি কাউন্সিল।
ভোররাত থেকে তিন টাকায় ডিম কেনার জন্য যারা লাইন ধরেছিল, এদের মধ্যে কেউই হতদরিদ্র নয়। এদের সবাই ভালো জামাকাপড় পরিহিত অবস্থাসম্পন্ন লোকজন, যারা প্রতিদিন দুইবেলা ভাত খাওয়ার সামর্থ্য রাখে। বাজারে ডিমের দাম তখন প্রতি পিস ৯/১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল, অনেকে ভেবেছিল একসঙ্গে অনেকগুলো ডিম কিনে ফ্রিজে জমিয়ে রাখতে পারলে কিছু টাকা বাঁচানো যাবে। সেই টাকার পরিমাণটা কত? বড়জোর ২০০-৩০০, এর বেশি নয়। এই টাকা বাঁচানোর জন্য হাজার হাজার মানুষ অসম্ভব এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে, এই দৃশ্যটাও দেখতে হয়েছে আমাদেরকে। মানুষের ভীড় সামলাতে না পেরে বিক্রি বন্ধ করে দেয়ায় লোকজন ক্ষেপে গিয়ে হামলা করেছিল কৃষিবিদ ইন্সটিটিউটের ভেতরে থাকা বুথে, এমনই রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছিল জায়গাটা।
লা মেরিডিয়ান হোটেলে দুইদিন আগে এক ডলারে আনলিমিটেড আইসক্রিমের অফার দেয়া হয়েছিল। আনলিমিটেড মানে এই না যে আপনাকে নানা ফ্লেভারের আইসক্রিমের বক্সের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হবে। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে এক স্কুপ আইসক্রিম খাবেন, তারপর আবার লাইনের পেছনে দাঁড়াবেন, সিরিয়াল এলে অন্য ফ্লেভারের আরেকটা আইসক্রিমের এক স্কুপ খেয়ে আবার লাইনে দাঁড়ানো- এই হচ্ছে সিস্টেম। ভ্যাট-সার্ভিস চার্জ মিলিয়ে বাংলাদেশী টাকায় এই অফারের দাম পড়েছে ৯৫ টাকার মতো।
লা মেরিডিয়ানের সামনে আইসক্রিম খাওয়ার জন্য যে বিশাল লাইন দেখলাম, এরকম লাইন সবশেষ দেখেছিলাম বোধহয় এভেঞ্জার্সের ইনফিনিটি ওয়ার সিনেমার ওপেনিং ডে'র টিকেটের জন্য। এখানে কিন্ত হতদরিদ্র লোকজন গিয়ে লাইন ধরেনি, আইসক্রিম খেতে গেছে অবস্থাসম্পন্ন মানুষজনই। স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই, নিরাপদ দূরত্ব তো আকাশ কুসুম কল্পনার ব্যাপার, অনেকের মুখে মাস্কও নেই- এদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, জীবনে বুঝি কেউ আইসক্রিম খায়নি, আইসক্রিম বস্তুটা চোখেও দেখেনি, আইসক্রিম নামে যে একটা খাবার দুনিয়াতে আছে- অনেকে সম্ভবত সেটাও জানে না। তাই এক ডলারে 'আনলিমিটেড' আইসক্রিমের অফার পেয়ে দলবেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে সেখানে।
ইউটিউবে সার্চ দিলে কিছু ভিডিও পাওয়া যায়। ব্ল্যাক ফ্রাইডে বা এরকম কোন বিশেষ দিনে বিভিন্ন দেশে দোকানপাটে ছাড়ের অফার দেয়া হয়, লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে অল্প দামে কেনাকাটা করতে, দোকানে ঢোকার জন্যেই হুড়োহুড়ি লেগে যায়, কে কার আগে কোন জিনিসটা দখল করবে সেই যুদ্ধ শুরু হয়। লা মেরিডিয়ানের এই আইসক্রিম ফেস্টেও সেই চিত্রটা দেখলাম। একদল আবার আইসক্রিম না পেয়ে সেখানেই হট্টগোল করা শুরু করেছে, ভাগ্য ভালো যে এটা ফাইভ স্টার হোটেল, পর্যাপ্ত সিকিউরিটির ব্যবস্থা আছে। নইলে দেশের মানুষ যে পরিমাণ অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে দিনকে দিন, আইসক্রিমের দাবীতে ভাংচুর শুরু হলেও অবাক হবার কিছুই থাকতো না।
সময়টা স্বাভাবিক নয়। করোনার সেকেন্ড ওয়েভ নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তায় আছে, শীতের শুরু থেকে সংক্রমণ বাড়বে বলা হচ্ছে, গতকালও শনাক্তের সংখ্যা আগের এক সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। আমরা করোনাকে ভুলে গেছি হয়তো, করোনা কিন্ত আমাদের ছেড়ে যায়নি। যারা লড়ছে করোনার বিরুদ্ধে, যারা ভুগছে এই ভাইরাসের তাণ্ডবে- তারা জানে এর ভয়াবহতা। এক ডলারে আনলিমিটেড আইসক্রিম খেতে যাওয়া বা সাজেক-সেন্টমার্টিনে চিল করে বেড়ানো জনগন সেটা বুঝবে না। বুঝবে যখন তাদের বয়ে নেয়া ভাইরাস প্রাণঘাতী হয়ে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ কারো জীবন সংহারের কারন হবে, তখন। কিন্ত ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে যাবে।
জাতি হিসেবে কমনসেন্সের ব্যবহারে আমরা বরাবরই বেশ পিছিয়ে থাকি। এই জিনিসটা যে আমাদের মধ্যে আছে, সেটাও ভুলে যাই মাঝেমধ্যেই। নইলে কেন তিন টাকার ডিম কিনতে দুই কিলোমিটার লম্বা লাইন হবে, কেন এক ডলারে আইস্ক্রিম খেতে করোনার মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করতে হবে? এই ঘটনাগুলো আমাদের মানসিকভাবে দেউলিয়া হবারই প্রমাণ দেয়। এই হাভাতেপনা না করলে, এমন বিকারগ্রস্ত আচরণ না দেখালে কি জাত যাবে?
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন