বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গা নদীতে ছুঁড়ে ফেলা হবে- এমন হুমকি আসার পরে তিনদিনের বেশি পেরিয়ে গেছে, মহিবুল হাসান নওফেল ছাড়া আর কোন আওয়ামী লিগ নেতাই এই নোংরা বক্তব্যের প্রতিবাদ করেননি। আওয়ামী লিগ নেতাদের মেরুদন্ডহীন এই আচরণের সময়টায় সৈয়দ আশরাফের কথা মনে পড়ছে, যিনি মেরুদণ্ড সোজা করে কথা বলতেন, চোখে চোখ রেখে জবাব দিতেন...
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মিত হলে সেটা বুড়িগঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলা হবে, শাপলা চত্বর অবরোধ করা হবে- ধর্মভিত্তিক কয়েকটা গোষ্ঠীর এরকম হুমকির পরে ৭২ ঘন্টারও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে এক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ছাড়া আর কোন নেতার বক্তব্য আসেনি এর বিপরীতে। ফেসবুকে দিনরাত রাজনৈতিক বড় ভাইদের স্তুতিবাক্য প্রচার করে বেড়ানো ছাত্রলীগের কর্মীরাও অপেক্ষায় আছে, হাওয়া কোনদিকে যাবে সেটা বোঝার জন্য। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ধোলাইখালে ঠাঁই পেলো নাকি বুড়িগঙ্গায় ফেলা হলো, সেটা নিয়ে এদের মাথাব্যথা নেই, এরা শুধু চাটাচাটি করে পাওয়ার প্র্যাকটিসটা করতে পারলেই খুশি। প্রায় একযুগ ধরে যে দলটা ক্ষমতায়, তারা কিনা জাতির জনকের ওপর এমন হুমকিতেও মৌনব্রত পালন করছে? কারনটা কী?
এর আগে ২০১৭ সালে যখন সুপ্রীম কোর্টের সামনে লেডি থেমিসের ভাস্কর্য সরানোর দাবী নিয়ে হেফাজত গণ্ডগোল পাকিয়েছে, তখনও আওয়ামী লিগকে আমরা প্রগতিশীল অবস্থান থেকে পিছিয়ে যেতে দেখেছি, থেমিসের মূর্তিটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সেটা যে কত বড় নৈতিক পরাজয় ছিল, তা বোঝার চেষ্টা করেনি কেউ। তাতেই বানরের দল আশকারা পেয়ে গেছে, মাথায় উঠে এখন মাথাটাই চিবিয়ে খাওয়ার তাল করেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলার হুমকি দিতেও এদের বিবেকে বাঁধছে না।
সবচেয়ে অবাক হয়েছি পুরো ঘটনায় আওয়ামী লিগের আচরণে। দল হিসেবে তারা কোন প্রতিক্রিয়াই জানায়নি। আওয়ামী লিগে এমন নেতা আছেন, যারা কিনা বিএনপিকে নিয়ে দিনরাত গবেষণা করতে করতে আওয়ামী লিগের বিএনপি বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন, দুনিয়ার সবকিছুতে তারা বিএনপি'র অস্তিত্ব খুঁজে পান, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কট্টরপন্থীদের এমন উদ্ধ্বত আচরনের পরও তাদের মুখ থেকে একটা টু-শব্দও বের হতে দেখলাম না। জাতির জনকের অপমানে যারা এতটুকু বিচলিত হন না, কিসের আওয়ামী লিগ করেন তারা?
আওয়ামী লিগে একজন সৈয়দ আশরাফের এখন বড্ড অভাব। গাটস দেখিয়ে, মেরুদণ্ড সোজা করে যিনি কথা বলতেন। যিনি অযথা ছিদ্রান্বেষণে ব্যস্ত না থেকে দলের জন্য, দেশের জন্য সত্যিকারের হুমকিগুলোকে খুঁজে বের।করতেন, উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতেন। হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা যখন তথাকথিত নাস্তিক-ব্লগারদের বিচারের দাবীতে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্যে শাপলা চত্বরে জড়ো হয়েছিল, তখন এই মানুষটা যেভাবে তার সাহস আর বিচক্ষণতা দিয়ে গোটা পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছিলেন, সেরকম কোন পরিস্থিতি আজ সৃষ্টি হলে কি হতো বলা মুশকিল। আশরাফের সেই সাহসটা এই আওয়ামী লিগের কার মধ্যে আছে? থাকলে গত ৭২ ঘন্টায় কোন প্রতিবাদ কেন চোখে পড়লো না?
২০১৩ সালের পাঁচই মে, বিএনপি তখন ঢাকামুখী লংমার্চের ঘোষণা দিয়েছে, আবার হেফাজতও কর্মসূচী দিয়েছে মতিঝিলের শাপলা চত্ত্বরে। পঙ্গপালের মতো কওমী মাদ্রাসার ছাত্র আর হুজুরেরা এসে ঢুকছে ঢাকায়, চালাচ্ছে তাণ্ডব। পুরো দেশই তখন শংকিত, কি হয় না হয়! প্রশাসনিক অবস্থাও খানিকটা নাজুক, এমনকি খোদ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীরাও অপ্রস্তুত অবস্থায়! অনেকেই হেফাজতের সঙ্গে আপোষ করার পক্ষপাতী ছিলেন তখন।
সেই সময়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে থাকা সৈয়দ আশরাফ বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ না করে বজ্রকণ্ঠে হেফাজতকে 'পাকিস্তানের প্রেতাত্মা' বলে উল্লেখ করেছিলেন, বলেছিলেন, এরা হচ্ছে একাত্তরের রাজাকার আর তাদের দোসরদের উত্তরসূরী। বাঘের মতো হুংকার ছেড়ে সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন, 'এবার তো ঢাকা পর্যন্ত এসেছেন, এর পরে ঢাকায়ও ঢুকতে দেয়া হবে না আর। আপনারা কারা, আপনাদের পরিচয় কি, উদ্দেশ্য কি, এসব আমাদের জানা আছে!' এমন একজন দৃঢ়চেতা নেতার অভাব আওয়ামী লীগ কি পারবে কখনও পূরণ করতে?
সৈয়দ আশরাফ কথাবার্তা কম বলতেন, তার কাছে কাজটা ছিল মুখ্য। তবুও ২০১৫ সালে শেখ হাসিনার অনুরোধে গণভবনে এক দলীয় সভায় কথা বলতে গিয়ে প্রায় আধঘন্টা ধরে ভাষণ দিয়ে ফেলেছিলেন, সেই ভাষণের প্রতিটা কথাই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আশরাফ বলেছিলেন, আওয়ামী লিগের জন্য ভবিষ্যতে বিএনপি বা রাজনৈতিক দলগুলো হুমকি হয়ে উঠবে না, বরং আওয়ামী লিগকে মোকাবেলা করতে হবে ধর্মীয় উগ্রবাদের চ্যালেঞ্জ, আওয়ামী লিগের জন্য সেটাই হবে সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ। এক বছরের মধ্যে হোলি আর্টিজান হামলায় সৈয়দ আশরাফের সেই কথার সত্যতা প্রমাণ হয়েছিল, প্রমাণ হচ্ছে গত পাঁচ বছর ধরেই।
সরকারের মন্ত্রীর সমালোচনা করে কার্টুন আঁকলে মাসের পর মাস জেলে বন্দী থাকা লাগে। এমপির নামে প্রকাশিত সংবাদ নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার দিলে গুম হয়ে যেতে হয় এদেশে, তারপর অসুস্থ শরীর নিয়ে ভোগ করতে হয় বন্দীত্বের শাস্তি। অথচ একদল মানুষ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার হুমকি দিলেও তাদেরকে গ্রেপ্তার করার সাহস কারো হয় না। এদেশে ডা.জাফরউল্লাহ'র মতো মানুষের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র ভিন্নমতাবলম্বী হবার কারনে মাছ চুরির, ভ্যানিটি ব্যাগ চুরির মামলা হয়, কিন্ত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটুক্তি করা লোকগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করার সাহস কেউ পায় না। এদেশে কার্টুন আঁকা, ফেসবুকে নিউজ শেয়ার দেয়াটা অপরাধ, কিন্ত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলার হুমকি দেয়াটা কোন অপরাধ নয়।
তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বলেছেন, এই অল্প সংখ্যক লোকের কথাকে গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই। তথ্যমন্ত্রী হয়তো জানেন না, শরীরে ফোঁড়া দেখা দিলে তখনই ঔষধ খেয়ে সেটার নিরাময় করতে হয়। নইলে সেই ফোঁড়া কখন যে টিউমার হবে, সেই টিউমার আবার ক্যান্সার হয়ে গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে- তা কেউ জানে না। যখন জানা যাবে, তখন হয়তো নিরাময়ের সুযোগটাও থাকবে না আর। এজন্যেই এই দুর্দিনে সৈয়দ আশরাফকে ভীষণ মিস করি, হেফাজতকে যিনি ঢাকা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছিলেন। তার মতো মেরুদণ্ড সোজা করে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার মতো নেতা তো আওয়ামী লিগে অবশিষ্ট নেই কেউ এখন...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন