আবদুল্লাহ আল ইমরানের মতো তরুণদের কারণেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
হুমকি কিংবা ভয়কে অগ্রাহ্য করে আবদুল্লাহ আল ইমরানের এমন সাহসী সাংবাদিকতা আমাদের স্বপ্ন দেখায়, আশা যোগায়- এদেশে শাহেদের মতো প্রতারকরা থাকলে, তাদের স্বরূপ উন্মোচন করার জন্য আবদুল্লাহ আল ইমরানরাও তো আছেন!
এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে আলোচিত এবং সমালোচিত চরিত্রের নাম মোহাম্মদ শাহেদ করিম। এই প্রতারক তার রিজেন্ট হাসপাতালের মাধ্যমে অজস্র রোগীর সঙ্গে প্রতারণা করেছে, করোনার স্যাম্পল নিয়ে ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে, কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল হয়েও লাখ লাখ টাকা বিল নিয়েছে একেকজন রোগীর কাছ থেকে। তার নানামুখী প্রতারণার কথা এখন প্রকাশিত হচ্ছে, তার নামে ৫২টা মামলা আগে থেকেই ছিল, জেল খাটা দাগী আসামী সে- এসব আমরা এখন জানতে পারছি। পালিয়ে ভারত যাওয়ার সময় র্যাবের অভিযানে গ্রেফতারও হয়েছে সে।
তবে শাহেদের গ্রেফতারের এই সংবাদের ভীড়ে একটা মানুষের কথা আমরা ভুলে যাচ্ছি, রিজেন্টের প্রতারণার ব্যাপারটা যিনি সবার আগে গণমাধ্যমে এনে মানুষের নজর সেদিকে নিয়ে গিয়েছিলেন- তিনি আবদুল্লাহ আল ইমরান, বেসরকারী টিভি চ্যানেল 'চ্যানেল ২৪' এর ক্রাইম এন্ড ইনভেস্টিগেশন বিটের রিপোর্টার তিনি। পাশাপাশি তিনি একজন সুলেখকও। শাহেদ কাণ্ডের আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জালিয়াতি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন ইমরান, সেই প্রতিবেদনের জের ধরেই গ্রেফতার করা হয়েছে অনেককে, ছাত্রত্ব বাতিল হয়েছে প্রশ্ন জালিয়াতি করে চান্স পাওয়া অনেক ছাত্রের।
শাহেদকাণ্ডে আসা যাক। ৯ই জুলাই, চ্যানেল ২৪ এর অনুসন্ধানমূলক নিয়মিত অনুষ্ঠান সার্চলাইটের সেদিনকার পর্বটির নাম ছিল রিজেন্ট লিজেন্ড। নাম শুনেই বোঝার কথা, রিজেন্ট হাসপাতালের অনিয়ম আর দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান করাই ছিল সেই বিশেষ পর্বটির উদ্দেশ্য। রিজেন্টে র্যাবের অভিযান হয়েছে এ মাসের ছয় তারিখে, তবে আবদুল্লাহ আল ইমরান এবং তার টিম কাজে নেমেছেন আরও বেশ কিছুদিন আগে। স্পষ্ট করে বললে, জুনের শেষদিক থেকে।
রিজেন্ট হাসপাতালের ব্যাপারে তখন অভিযোগ আসা শুরু হয়েছিল চ্যানেল ২৪-এ। অনেকেই অভিযোগ জানাচ্ছিলেন, তারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। রিজেন্ট থেকে লোক বাসায় এসে করোনার স্যাম্পল নিয়ে গেছে, কিন্ত রিপোর্ট এসেছে ভুয়া। যার করোনার উপসর্গ আছে তাকে দেয়া হয়েছে নেগেটিভ রিপোর্ট, যার উপসর্গ নেই তাকে দেয়া হয়েছে পজিটিভ। কয়েকজন জানালেন, তারা সরকারী ওয়েবসাইটে নিজেদের রিপোর্টের সিরিয়াল নম্বর মিলিয়ে খুঁজেছেন, এই রিপোর্টের অস্তিত্বই পাননি!
এতসব অভিযোগ পেয়েই নড়েচড়ে বসে টিম সার্চলাইট, অনুসন্ধানে নামেন আবদুল্লাহ আল ইমরান। তখনও তারা জানতেন না যে, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপের দেখা পাবেন! যতই সামনে এগুতে থাকলেন, ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বললেন, অনুসন্ধান যত এগিয়ে গেল, ততই তাদের চোখে ধরা পড়তে লাগলো রিজেন্টের প্রতারণার ব্যাপারগুলো। এ যেন অভিনব এক জোচ্চুরি! প্রতিটি অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পান তারা, সেই সঙ্গে হাতে আসতে থাকে প্রমাণাদি।
অনুসন্ধানে তারা জানতে পারলেন, এই প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি ২০১৪ সালের পর, অথচ তাদেরই কিনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কোভিড ডেডিকেডেট হাসপাতাল হিসেবে মনোনীত করেছে! শুধু তাই নয়, রোগীদের থেকে লাখ টাকার ওপরে বিল তো রিজেন্ট নিয়েছেই, আবার কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে দুই কোটি টাকার বিল পাঠিয়েছে সরকারের কাছেও! তার ওপর বিনামূল্যে ঔষধ, অক্সিজেন, ডাক্তার- এসব সাহায্য তো নিয়েছেই!
সাংবাদিক হিসেবে আবদুল্লাহ আল ইমরান এবং তার দল যখন একের পর এক সূত্র দিয়ে মালা গেঁথে রিজেন্টের বিরুদ্ধে প্রমাণ জড়ো করছেন, তখন র্যাবের একটি ইউনিটও নানা অভিযোগের ভিত্তিতে রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আবদুল্লাহ আল ইমরান তার হাতে থাকা তথ্য-প্রমাণগুলো ভাগাভাগি করেছেন র্যাবের সঙ্গে, যাতে তাদের অভিযান চালাতে সুবিধা হয়। তিনি নিজেকে ক্রেডিট নিয়ে একটা প্রতিবেদন করলেন, সেটার ফলে অপরাধী সুযোগ বুঝে পালিয়ে গেল- এমনটা ঘটাতে চাননি ইমরান।
৬ই জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের এমডি মিজানুর রহমানের সাক্ষাৎকার নেন আবদুল্লাহ আল ইমরান, সেই সাক্ষাৎকারে নিজেদের দুধে ধোয়া তুলসি পাতা হিসেবে দাবী করেছিলেন রিজেন্টের এমডি। সাক্ষাৎকার গ্রহণের তিন ঘন্টা পরেই র্যাব অভিযান চালায় সেখানে। সেই অভিযান সরাসরি সম্প্রচার করেছিল চ্যানেল ২৪, আবদুল্লাহ আল ইমরানও উপস্থিত ছিলেন তখন। তারপরের গল্পটা তো গোটা বাংলাদেশ জানে, সাহেদের অপকর্মের ফিরিস্তি বের হয়েছে একের পর এক, তার প্রতারণার তালিকা বানিয়ে একটা শাহনামাই লিখে ফেলা যাবে এখন। সবাই যেটা জানে না, সেটা হচ্ছে, শাহেদের গ্রেফতার বা তার প্রতারণা ফাঁস হবার পেছনে তরুণ এই সাংবাদিকের অবদানের কথা।
আবদুল্লাহ আল ইমরানের আরেকটা উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন জালিয়াতি চক্রের সন্ধান বের করা। ইমরান নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র, তার আজকের অবস্থানের পেছনে এই প্রতিষ্ঠানের একটা অবদান আছে। নিয়মিত ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের কারণে ঢাবির ঐতিহ্য যখন সমালোচনার মুখে, তখন তিনি এগিয়ে এসেছেন। খুঁজে বের করেছেন ওই প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত একাধিক চক্রকে। এই চক্রে সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা- সবাই জড়িত ছিল।
প্রাণের ভয় না করে ইমরান সত্যের পেছনে ছুটেছেন, প্রমাণ জড়ো করেছেন। ইমরানের সেসব অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পর নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন, বেরিয়ে এসেছে থলের বেড়াল। একে একে গ্রেফতার হয়েছে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকা অনেকেই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন জালিয়াতি করে চান্স পাওয়া ছাত্রদের খুঁজে খুঁজে তাদের বহিস্কার করেছেন। আইন-আদালতের ফাঁক গলে গ্রেফতার হওয়া অনেকেই পরে বেরিয়ে গেছে, কিন্ত ইমরান নিজের দায়িত্বটা পালন করেছেন পুরোপুরি, তার জায়গা থেকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি কোথাও।
শেষ করার আগে আবদুল্লাহ আল ইমরানকে নিয়ে আরেকটা ঘটনা বলে ফেলি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী গিয়েছেন গাউছিয়া মার্কেটে, কিছু কেনার জন্য। সেখানে এক বিক্রেতা তার সঙ্গে বাজে ব্যবহার করলো। সেই ছাত্রীটি ছিলেন প্রতিবাদী, তিনি প্রতিবাদ করলেন এই ঘটনার। তখন উল্টো তাকে হুমকি দিলো সেখানকার দোকানদারেরা। সেই ছাত্রী যোগাযোগ করলেন আবদুল্লাহ আল ইমরানের সঙ্গে। ইমরান তাকে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন নিউমার্কেট থানায়, থানা থেকে পুলিশ গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সেই বিক্রেতাকে গ্রেফতার করলো। আধঘন্টা আগেও যারা গর্জন করছিল, তারা তখন মেনি বেড়াল হয়ে ক্ষমা চাইছে!
নিউমার্কেট-গাউছিয়ায় এরকম ঘটনা হরহামেশা ঘটে, কেউ প্রতিবাদ করে না, মুখ বুজে অপমান সয়ে ফিরে চলে আসে। একারণে এই বিক্রেতারা পেয়ে বসেছিল। সেদিনের সেই প্রতিবাদের পরে অবস্থা বদলেছে অনেকটাই, এই ঘটনাটার গল্প নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে বলে ইমরান সবাইকে আহবান জানিয়েছিলেন, রাস্তাঘাটে, মার্কেটে বা গণপরিবহনে, যে কোন জায়গায় হ্যারাসমেন্টের কোন ঘটনা ঘটলেই যেন সেটার প্রতিবাদ করা হয়, পুলিশকে জানানো হয়। তার সেই প্রচারণায় কাজ হয়েছিল।
রিজেন্ট কাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধান শুরুর আগে দীর্ঘ সময় করোনায় ভুগেছেন আবদুল্লাহ আল ইমরান এবং তার স্ত্রী সানজিদা তিন্নি আবদুল্লাহ, যিনি প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকার কেরাণীগঞ্জে কর্মরত আছেন। করোনার ধকল কাটিয়েই ইমরান কাজে ছুটে গেছেন, অনুসন্ধান চালিয়ে আলোতে এনেছেন স্মরণকালের সবচেয়ে বড় প্রতারণার ঘটনাগুলোর একটিকে। হুমকি কিংবা ভয়কে অগ্রাহ্য করে আবদুল্লাহ আল ইমরানের এমন সাহসী সাংবাদিকতা আমাদের স্বপ্ন দেখায়, আশা যোগায়- এদেশে শাহেদের মতো প্রতারকরা থাকলে, তাদের স্বরূপ উন্মোচন করার জন্য আবদুল্লাহ আল ইমরানরাও তো আছেন!
আরও পড়ুন-
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
*
সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে