ইন্ডিয়া ঘোষণা দেয়ার আগেই কারা পেঁয়াজের দাম তিনগুণ করে ফেলে? পাইকারি বাজার থেকে পাঁচ কিলো দূরে পেঁয়াজের ট্রাক আটকে রেখে কারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে? একেকটা ক্রাইসিস সিজন শেষে কাদের একাউন্টে শত শত কোটি টাকা জমে যায়?

আপনারা যারা খুব বেশি ফেরেশতা টাইপের সরল মানুষ, আপনাদেরকে একটু গণিত বোঝাই।

মাননীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পেঁয়াজের হিসেব নিকেশ দিয়ে শেষে  বলেছেন, বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করতে দেখলে প্রশাসনকে খবর দিন। আপনার কাছে মনে হতে পারে উনি তো খুব ভালো কথা বলেছেন, দায়িত্বশীল মানুষের মতো নির্দেশনা দিয়েছেন। বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করতে দেখলেই এখন প্রশাসনকে জানানো যাবে, ওয়াও! এখন কোন শালা বেশি দামে পেঁয়াজ বেচে দেখব।

ওয়াও পরে বলেন ভাই। আগে হিসেবটা বুঝে নেন। আপনি পেঁয়াজ কার থেকে কেনেন? বাজারের খুচরা বিক্রেতা কিংবা রাস্তার ভ্যানওয়ালা, তাই তো? সুতরাং প্রশাসনকে যদি অবগত করেন এদের ব্যাপারেই করবেন তাই তো?

হ্যাঁ, প্রশাসনকে অবগত করলে এসব ক্ষেত্রে কাজও হয়। আগের বার যখন পেঁয়াজের দাম বাড়ল তখন প্রচুর পরিমাণে মোবাইল কোর্ট করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হয়েছে। ধরে নিতে পারেন আপনার অভিযোগে এবারেও কাজ হবে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জরিমানা হবে।

পেঁয়াজের দাম বাড়ার সাথে এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ভূমিকা কী?

কিছু কিছু ব্যবসায়ী পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণে কিছুটা সুবিধা পান। ধরুন আগের দিন উনি ১০ বস্তা পেঁয়াজ কিনেছেন ৪০ টাকা কেজি ধরে। পরের দিন পেঁয়াজের কেজি হয়ে গেল ৮০ টাকা। পার কেজিতে ৪০ টাকা লাভ। ৫০০ কেজিতে লাভ ২০ হাজার টাকা। রেগুলার লাভ বাদ দিলে বাড়তি মুনাফা হয়ে গেল ১২-১৫ হাজার টাকা। আপনি কম্পলেইন করলে এবং প্রশাসন ভালো উদ্যোগ নিলে এই ১২-১৫ হাজার টাকা বাঁচানো সম্ভব। তবে এখানে অনেকগুলো "কিন্তু" থেকে যায়।

আমি যতদূর জানি দাম বাড়া-কমা ব্যাপারে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা আপডেট পান না। সংগত কারণেই আপডেট জানানো হয় না। আগে থেকে সংকেত পেলে এরা নিজেরাই নিজেদের সামর্থ্যমতো স্টক করে ফেললে রাঘব বোয়ালরা বিপাকে পড়বেন। পাইকারি ব্যবসায়ীরা এই জিনিস হাইড রাখেন অথবা নিজেরাও ঠিকমতো আন্দাজ করতে পারেন না। (আন্দাজ না করার ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য না)

তার মানে কী দাঁড়াল? আজকে যে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কপালে জোরে ১২-১৫ হাজার টাকা লাভ করল, দাম যখন কমবে তখন কপাল খারাপ হলে একই পরিমাণ টাকা লস করার সম্ভাবনাও আছে। দাম একটা সময় কমবেই এবং ব্যবসায়ীকে নিয়মিত পণ্য আনা লাগে। পেঁয়াজ তখন যত বেশি জমা থাকবে, তত বেশি লস গুনতে হবে।

দাম বাড়ার ব্যাপারটার সাথে যদি লসের আশংকা থাকে তবে একজন লাভ করার সুযোগ কেন নেবে না? দাম বাড়ার পরে যাদের মাল আনা লাগে তারা কিন্তু খুব একটা লাভ দেখে না বরং লসের আশংকা থাকে শতভাগ। লাভ লসের ব্যাপারটা লটারির মতো হলে কেউ লাভের ভাগ ছাড়বে না, এটাই নিয়ম।।দাম যখন পড়ে যায়, যখন কেনা দামের চেয়ে কম দামে জিনিস বিক্রি করতে হয়, তখন কোনো কাস্টমার এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর লসের ভার নেয়? আপনি নেন? আমি নিই?

আচ্ছা একটু অন্যভাবেই না হয় ভাবলাম। পাইকারি বাজারে কেজি যখন ৭০ টাকা তখন আগের কেনা বলে একজন খুচরা বাজারে ৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। লোকটা ভাবল, না আমি কসাইয়ের মতো লাভ করব না। পরে লস হোক আর না হোক, এখন ন্যায্য দামেই বিক্রি করি।

লোকটার দোকান মুহুর্তের মাঝেই খালি করে ফেলবে জনতা। পাইকারি দামের চেয়ে কমে পেলে অন্য ব্যবসায়ী এসেও চান্স নেবে। গ্রোসারির ক্ষুদ্র শপে একটা নির্দিষ্ট পরে পণ্য বিক্রি হয় না। এক সাথে অনেকগুলো প্রোডাক্ট ব্যালেন্স করে বিক্রি করা লাগে। বিশ্বাস না হলে আপনি আপনার পাশের বাজারের যে কোনো দোকানে গিয়ে বলেন দোকানের সব রসুন চলতি দামেই কিনে নিতে চান। আমি হলফ করে বলতে পারি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আপনার কাছে সব রসুন বিক্রি করবে না। এতে দোকান ইমব্যালেন্স হয়ে যাবে।

এই পয়েন্ট বুঝাতে পারলাম কিনা জানি না। বুঝতে না পারলে কষ্ট করে বোঝার দরকার নেই। জাস্ট একটা জিনিস মনে রাখেন, পাইকারি বাজারে যে কোনো জিনিস যে দামে বিক্রি হয়, খুচরা বাজারে এরচেয়ে কমে আপনি পাবেন না। তাতে খুচরা ব্যবসায়ী ২০০% না ৫০০% লাভ করল সেটা দেখে কাজ নেই। এটা এক ধরনের নিয়ম।

মাননীয় প্রতিমন্ত্রী বলেছেন বাজারে বেশি দামে বিক্রি করতে দেখলেই প্রশাসনকে জানাতে। ধরেন আপনি জানালেন এবং প্রশাসন এসে ব্যবসায়ীকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করে ফেলল। আপনি কি মনে করেন ব্যবসায়ী এই জরিমানা পকেট থেকে দিয়ে দেবে?।দেবে না। সে পেঁয়াজের দাম কমিয়ে রসুনের দাম কেজিতে দশ টাকা বাড়াবে। আদার দাম বাড়াবে কেজিতে ৫০ টাকা। ১০ হাজার টাকা আপনার থেকেই উদ্ধার করবে।

ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলে দেখবেন, এই আচমকা ক্রাইসিসে খুচরা ব্যবসায়ী আর আপনি আলাদা কিছু না। দুই পক্ষই সাফারার। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ ভাগ্যের ফেরে কিছু লাভ করে ফেলে সত্যি, তবে প্রায়শই তাদের লসও করতে হয়।

আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে কারা জীবনেও লস করে না। ইন্ডিয়া ঘোষণা দেয়ার আগেই কারা পেঁয়াজের দাম তিনগুণ করে ফেলে এদেরকে আপনি চেনার চেষ্টা করুন। পাইকারি বাজার থেকে পাঁচ কিলো দূরে পেঁয়াজের ট্রাকের সারি আটকে রেখে কারা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এদের ব্যাপারে জানুন। সম্ভব হলে অনুসন্ধান করে দেখুন এমন একেকটা ক্রাইসিস সিজন শেষে কাদের একাউন্টে শত শত কোটি টাকা জমে যায়।

খুচরা ব্যবসায়ীরা ফেরেশতা না, লোভ ও পাপ সবার ভেতরেই আছে। এদের একাংশও জুলুম করে মানুষকে। কিন্তু এরা আপনার প্রধান প্রতিপক্ষ নয়। মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর স্ট্যাটাস দেখে আপনি আনন্দে বগল বাজাতে বাজাতে যদি এদেরকে ফাঁসিয়ে দেন, তাতে এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লোকটা হয়তো প্রাপ্য শাস্তি পাবে নয়তো অন্যায়ের শিকার হবে। কিন্তু তাতে সামগ্রিক পরিস্থিতির একটুও উন্নতি হবে না।

মাথাটাকে একটু বড় পরিসরে নিয়ে ভাবার চেষ্টা করবেন। ইন্ডিয়া বর্ডারের ওপারের রাজ্য। তাদেরকে গালাগাল দিয়ে খুব বেশি লাভ লস নাই। তারা যাই করুক না কেন, আমাদের সাথে যত অন্যায় করুন না কেন... নিজেদের দেশ ও জনতার লাভের জন্যই করছে। আমাদের লাভ কে দেখে? আমাদের ভালোটা কে বুঝে? আমাদেরকে গার্জিয়ান কে?

মাসে লাগে ২ লক্ষ টন। মজুত আছে ৬ লক্ষ টন। মানে তিন মাস চলবে এই পেঁয়াজে। তাহলে এক রাতের ব্যবধানে কী করে এত দাম বাড়ে? কে বাড়ায়? কারা? ইহুদি নাসারা? ভারতীয় র- এর এজেন্ট নাকি পাকিস্তানের আইএসআই? এদের না ধরে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ধরার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে এক কেজি পেঁয়াজ কেনা জনতাকে!

বাবার দরবারে কে কোন চরিত্রে অভিনয় করছে বোঝার চেষ্টা করুন। ধর্ম আর দেশপ্রেমের দেশে এক রাতে দাম কীভাবে তিনগুণ হয় সেটা নিয়ে গবেষণা করুন। আর না হলে মুড়ি খান আর যারে গালি দিলে রিস্ক সবচেয়ে কম তারে গালি দিন। আমাকেও দিতে পারেন, রিস্ক একেবারেই নাই। সম্প্রতি এক গবেষণায় এসেছে, গালাগাল যারা দেয় তাদের হার্ট ভালো থাকে।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা