করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে লকডাউন হওয়ায় সবচেয়ে লাভবান হয়েছে অনলাইন স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলো। মানুষ বাসায় বসে অবসর কাটানোর জন্য প্রচুর সময় ব্যয় করছে এই স্ট্রিমিংগুলোতে। দেখে নিচ্ছে তাদের পছন্দমতো ওয়েব সিরিজ, সিনেমা। আর নেটফ্লিক্স, এমাজন, ডিজনির মতো বড় বড় স্ট্রিমিং জায়ান্টরাও পাল্লা দিয়ে একের পর এক নতুন সিরিজ, সিনেমা রিলিজ করেই যাচ্ছে।

ইন্ডিয়াতে স্ট্রিমিং সার্ভিস পপুলার হয়েছে বেশিদিন হয়নি। নেটফ্লিক্সের সেকরেড গেমসের হাত ধরেই মূলত বড় একটা বাজার আবিষ্কার হয়েছে প্রথম। এরপর থেকেই যেন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে সবগুলো স্ট্রিমিং সার্ভিস। ইন্ডিয়ার বিশাল পপুলেশন ও সিনেমাপ্রেমকে পুঁজি করে একের পর এক ওয়েব সিরিজ বানিয়ে যাচ্ছে।

স্বাভাবিকভাবে যখন সংখ্যা বেড়ে যাবে, তখন কোয়ালিটি কমে যায়, ওয়েব সিরিজের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সেকরেড গেমস, মির্জাপুরদের হাত ধরে দারুণ সম্ভাবনাময় শুরু দেখালেও সে লেভেলে আর কোন ওয়েব সিরিজই পেরে উঠতে পারছে না। কিন্তু তাই বলে যে ভালো সিরিজ একেবারেই নির্মাণ হচ্ছে না- এমনটাও না।

বলিউডের বস্তাপচা মশলা এন্টারটেইনার থেকে রুচিশীল অনেক দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিলেও তারা নিজেদের খোরাক মেটাচ্ছে এই ওয়েব সিরিজগুলো দিয়ে। এমনকি সাধারণ অনেক দর্শকও মুখিয়ে থাকে ভালোমানের ওয়েব সিরিজ দেখার জন্য। আজ আলোচনা করা যাক এই বছর ইন্ডিয়া থেকে আসা ৫টি দারুণ ওয়েব সিরিজ নিয়ে। যে সিরিজগুলো দর্শককে মুগ্ধ করেছে, দর্শককে আলোচনা করতে বাধ্য করেছে।

জামতারা: সাবকা নাম্বার আয়েগা 

বছরের সেরা পাঁচ ওয়েব সিরিজ নিয়ে পড়তে এসে প্রথমেই অপরিচিত নাম? জ্বী হ্যাঁ, এই সিরিজটি অপরিচিতই বটে। খুব কম দর্শকই দেখেছেন নেটফ্লিক্সের দারুণ আন্ডাররেটেড এই সিরিজটি। এর মূল কারণ অভিনয়ে কোন বড় তারকা বা পরিচিত অভিনেতা না থাকা। নেটফ্লিক্স মার্কেটিংও করেনি সেভাবে।

এই ওয়েব সিরিজের মূল কাহিনী একদল তরুণকে নিয়ে। যারা বসবাস করে ভারতের প্রত্যন্ত জামতারা গ্রামে। কিন্তু এরা সকলেই বেশ ধনী। অবাক করা ব্যাপার না? এতো টাকা কীভাবে এই ছেলেগুলোর কাছে এলো? কারণ- এই ছেলেগুলো ফিশিং স্ক্যামের সাথে জড়িত। বিভিন্ন উপায়ে ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড হোল্ডারদের কল লিস্ট যোগাড় করে কণ্ঠ বদলে ফোন দিয়ে সাধারণ মানুষের কার্ডের ডিটেইলস নিয়ে নিতো এরা, তারপর সেখান থেকে টাকা বের করে নিতো ইচ্ছেমতো। ব্যাংক-কার্ড হোল্ডাররা বোঝার আগেই টাকা জামতারার এই ছেলেগুলোর পকেটে চলে যেত।

জামতারা: সাবকা নাম্বার আয়েগা 

কিন্তু তাদের এই সুখী সময় বেশিদিন রইল না যখন এলাকার প্রভাবশালী একজন পলিটিশিয়ান তার হয়ে এই কাজ করতে তাদের বাধ্য করলো আর অন্যদিকে পুলিশ বেশ ভালোমতোই তাদের পেছনে লেগে গেল। সাথে নিজেদের মাঝে অন্তর্দ্বন্দ্ব তো আছেই। গ্রামীন রাজনীতি, ফিশিং স্ক্যাম, সম্পর্ক, দারিদ্রতা ও টক্সিক ম্যাসকুলানিটির এক দারুণ কম্বিনেশন এই ওয়েব সিরিজটি। এখনই দেখে ফেলুন নেটফ্লিক্সে।

পঞ্চায়েত

টিভিএফের কাজগুলোর সুবাদে অনেক দর্শকের কাছেই জিতু ভাইয়া ওরফে জিতেন্দ্র কুমার বেশ পপুলার একটি নাম। সে টিভিএফ টিমই যখন এমাজনের হয়ে ওয়েব সিরিজ বানালো, তখন ভালো না হয়ে আসলে উপায় থাকে না।

একজন সদ্য গ্র্যাজুয়েট ইঞ্জিয়ার ভালো বেসরকারি চাকরি না পেয়ে সরকারি চাকরির জন্য এপ্লাই করে। চাকরি হয়েও যায় তার, সে সুবাদে গ্রামের পঞ্চায়েত সেক্রেটারি হিসেবে পোস্টিং হয় উত্তর প্রদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে আধুনিকতার আলোও পৌঁছায়নি। অভিষেক ত্রিপাঠি নামের সে স্বপ্নবাজ ছেলেটির গ্রামের সাথে মানিয়ে নেয়ার গল্পই ‘পঞ্চায়েত’।

পঞ্চায়েত

এরই সাথে উঠে এসেছে গ্রামীন কুসংস্কার, নারীর অধিকারহীনতাসহ প্রয়োজনীয় অনেক ইস্যু। জিতেন্দ্র কুমার, নীনা গুপ্তা, রঘুবীর যাদবের মতো দারুণ অভিনেতারা তো ছিলেনই, সাথে অন্যান্য যারা সহঅভিনেতা ছিল প্রত্যেকেই এতো অনবদ্য অভিনয় করেছেন যে দর্শক মুগ্ধ হবে বারবার।

স্পেশাল অপস 

ইন্ডিয়ার সিক্রেট সার্ভিস আর পাকিস্তানের সন্ত্রাসী- এই প্লটে প্রচুর কাজ হয়েছে ইন্ডিয়ায়। সিনেমা, সিরিজ কিছুই বাকি নেই বলতে গেলে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের স্বজাত্যবোধ থেকে তারা এরকম গল্প বলতেই চাইবে। কিন্তু নীরাজ পান্ডের মতো ঝানু পরিচালক যখন সেইম প্লট নিয়ে কাজ করেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রেজেন্টেশন ভিন্ন হবে ধরে নেয়া যায়।

এখানে এক ব্যর্থ সিক্রেট এজেন্টের গল্পই নিরাজ তুলে ধরেছেন। যিনি কিনা তাদের দেশের বিভিন্ন সিক্রেট এজেন্সি, বড় বড় হর্তাকর্তাদের ইগোর কারণে নিজের ফিল্ড এজেন্ট জীবনে পাকড়াও করতে পারেননি এক ধুরন্ধর সন্ত্রাসীকে। সে এজেন্টই এখন এজেন্সির বড় পদে, বিভিন্ন দেশে তার ফিল্ড এজেন্টরা তৈরি সে সন্ত্রাসীকে ট্র্যাক করে পাকড়াও করার জন্য।

স্পেশাল অপস

একদিকে ওপরের মহল থেকে তার এজেন্সির ট্রাঞ্জাকশন নিয়ে নিয়মিত ট্রায়াল চলছে অন্যদিকে সে সন্ত্রাসী মাস্টারমাইন্ডকে ধরার পরিপূর্ণ আয়োজন করছে। টানটান উত্তেজনায় ভরপুর নিরাজ পান্ডের ‘স্পেশাল অপস’ সিরিজটি। যেটি হয়তো এতো দারুণ হতো না যদি না কে কে মেনন লিড রোলে না থাকতেন। তিনি তার অফিসে বসে, ট্রায়ালে বড় অফিসারদের সামনে বসেই পুরো সিরিজ কাটিয়ে দিয়েছেন কিন্তু তার কনভারসেশন, তার ট্যাকটিকস, তার পিতৃত্ববোধ সবকিছু এতো দারুণভাবে মেনন তুলে ধরেছেন যে স্রেফ অবাক হয়ে যেতে হয়। দারুণ এই সিরিজটি দেখা যাবে ডিজনি প্লাস হটস্টারে।

অসুর

ওয়েলকাম টু ইওর ডার্ক সাইড- একটা সিরিজ কেবল ওয়ার্ড অফ মাউথে পপুলার হয়ে যাওয়া সম্ভব? যে স্ট্রিমিং সার্ভিসের কেউ নামও শোনে নি ঠিকমতো সে ভূত স্ট্রিমিং সার্ভিস থেকে যখন ‘অসুর-ওয়েলকাম টু ইওর ডার্ক সাইড’ সিরিজটি রিলিজ পেলো তখন কেউ টেরও পায়নি সিরিজটি এতো দারুণ হবে। মিস্ট্রি, সিরিয়াল কিলিং নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে ইন্ডিয়াতে কিন্তু কেবল ফরেনসিক সাইডটাকে মূল ফোকাস দিয়ে সাথে ইন্ডিয়ান মাইথোলজিকে সুন্দর করে ব্লেন্ড করে প্রেজেন্ট শুধু অসুরই সফলভাবে করতে পেরেছে।

একের পর এক সিরিয়াল কিলিং হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সিবিআই এর দুই ফরেনসিক এক্সপার্ট কোন সুরাহা করতে পারছে না। কিলারের বুদ্ধিমত্তা, দর্শন নাজেহাল করে দিচ্ছে পুরো পুলিশ ফোর্সকে। অসম্ভব মাত্রার আইকিউ, এক্সপার্টিজ ও মিথিক্যাল বিলিভ নিয়ে থাকা এই অশরীরী শত্রুর মোকাবেলা কীভাবে করেছে সিবিআই, সে গল্প নিয়েই অসুরের প্রথম সিজন শেষ হয়েছে।

অসুর

আরশাদ ওয়ারসি, বরুন সোবতিসহ সবাই বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। মূলত প্লটের টুইস্ট এন্ড টার্নস, মিথের সাথে আধুনিক ফরেনসিক এক্সপার্টিজ, ক্যারেক্টার ক্ল্যাশ ও টানটান স্ক্রিনপ্লে অসুরকে দারুণ উপভোগ্য করে তুলেছে দর্শকদের কাছে। দ্বিতীয় সিজনও আসার কথা অদূর ভবিষ্যতে।

পাতাল লোক

দীর্ঘ প্রায় পঁচিশ বছর ধরে ইন্ডিয়াতে ক্রাইম থ্রিলার জনরা নিয়ে কাজ করা ও কাল্ট ক্লাসিক কিছু কাজ নিজের ঝুড়িতে রাখা অনুরাগ কশ্যপ যখন একটি সিরিজ দেখে কমেন্ট করেন- ক্রাইম থ্রিলার জনরায় এর চেয়ে ভালো কোন কাজ ইন্ডিয়াতে হয়নি, তখন সাধারণ দর্শকের আসলে বলার কিছু থাকে না। অনুশকা শর্মার প্রোডাকশন ক্লিন স্লেট ফিল্মস সবসময়ই দারুণ সব স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করে আসছে বেশ কিছু বছর ধরে। এমাজনের জন্য তাদেরই রিসেন্ট প্রোডাকশন পাতাল লোক।

এক সিজনের এই সিরিজটিতে আপনি পাবেন কম্প্যাক্ট স্টোরিটেলিং, অনবদ্য অভিনয়, অসাধারণ ক্যারেক্টার আর্ক, ওয়েল রিটেন ডায়লগসহ টেকনিক্যাল সব ব্রিলিয়ান্স একসাথে। এর সাথে যোগ করুন এই সিরিজের রাজনৈতিক দিক, ধর্মীয় ও জাতিগত অসহিষ্ণুতা, সংবাদমাধ্যমের জালিয়াতি ও মানবিকতার দিকগুলো।

এতোকিছু নিখুঁত হওয়া একটি সিরিজের জন্য অনেককিছু। পাতাল লোক এমনই একটি সিরিজ। জয়দীপ আহলাওয়াত, অভিষেক ব্যানার্জি, নিরাজ কবির অভিনয় ইন্ডিয়ান ওয়েব সিরিজ ইতিহাসেরই সেরা অভিনয়গুলোতে জায়গা করে নেয়ার মতো। এই সিরিজটি দেখে নিতে পারেন এমাজন প্রাইমে।

পাতাল লোক

এই সিরিজগুলো ছাড়াও আরও বেশকিছু ভালো সিরিজ মুক্তি পেয়েছে এ বছর। ব্রিদ- ইন টু দ্য শ্যাডোজ, আরিয়া, ইনসাইড এজ, শিসহ আরও কিছু সিরিজ দর্শকদের পছন্দের তালিকায় আছে। সামনেও বেশ দারুণ দারুণ ওয়েব সিরিজ মুক্তির অপেক্ষায়। মির্জাপুর সিজন টু, ফ্যামিলি ম্যান সিজন টু, এ সুইটেবল বয়, দিল্লির মতো বিগ বাজেট ওয়েব সিরিজও আছে মুক্তির অপেক্ষায়। অসুস্থ এই সময়টায় স্বস্তি হয়ে আসুক অবসরের সঙ্গী এই ওয়েব সিরিজগুলো, এটাই কামনা রইল।

-

* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে

আরও পড়ুন-


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা