শিল্পীরা তাদের রোজগারের কথা ভাবছেন, হল মালিকেরা তাদের ব্যবসা বাঁচাতে চাইছেন, কিন্ত দর্শকের কথা ভাবছে না কেউই। দর্শক হিসেবে আমি চাই, সাহসী হিরো আলমের পরিবর্তে ভারত পাকিস্তান, এমনকি নেপালের ভালো সিনেমাগুলো দেখতে। আমি কি দেখব, সেটা অন্য কেউ কেন ঠিক করে দেবে?

বলিউডি সিনেমা বাংলাদেশের হলগুলোতে মুক্তি পেলে দেশের সিনেমা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ধ্বংস হয়ে যাবে- এমন আহাজারি শুনে মুখে অটোমেটিক হাসি চলে এলো, মজার কোন কৌতুক শুনলে যেমমটা হয়। দেশের সিনেমার ধ্বংস হতে বাকি আছে'টা কি? সেই লোকগুলোই সিনেমা ধ্বংস হবে বলে রব তুলছেন, যারা এককালে ভারতীয় সিনেমা ঠেকাতে কাফনের কাপড় পরে রাস্তায় আন্দোলন করেছেন, তারপর নিজেদের আখের গোছাতে যৌথ প্রতারণার নামে কলকাতার সিনেমাকে অবাধে বাংলাদেশে ঢোকার সুযোগ করে দিয়েছেন। তাদের মুখে দেশের সিনেমার প্রতি এমন আবেগ উথলে ওঠা দেখে কুমিরের কান্না প্রবাদের কথা মনে পড়ে গেল।

করোনার কারনে দীর্ঘদিন সিনেমা হল বন্ধ ছিল। চালু হবার পরেও ভালো কোন সিনেমা নেই মুক্তির তালিকায়, দর্শকও নেই। হলগুলো লোকসান গুনছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, হল মালিকেরা তাই টিকে থাকার জন্যেই সাফটা চুক্তিকে আপগ্রেড করে নতুন ভারতীয় সিনেমা আনতে চাইছেন। মন্ত্রণালয়ের গ্রীন সিগনালও পেয়েছেন তারা। সাফটা চুক্তির আওতায় আগে বিনিময়ের মাধ্যমে সিনেমা আনা হতো, ভারত থেকে একটা সিনেমা এলে বদলি হিসেবে বাংলাদেশ থেকে একটা যেতো। ভারত থেকে জনপ্রিয় সিনেমাগুলো এলেও, বাংলাদেশ থেকে প্রায় প্রতিবারই পাঠানো হয়েছে অখাদ্য সব সিনেমা, যেগুলো কোনোভাবেই বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে না। সেগুলো পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগঞ্জের দুই একটা সিঙ্গেল স্ক্রিন হলে মুক্তি দেয়া হয়েছে চুক্তির শর্ত পূরণ করার জন্যেই, দর্শককে দেখানোর জন্যে নয়। 

এখন হল মালিকেরা চাইছেন, সাফটা চুক্তির সংশোধন করে জনপ্রিয় কিছু সিনেমা ভারতের সঙ্গে একই দিনে বাংলাদেশেও মুক্তি দিতে। প্রতি বছর ১০-১২টি ভারতীয় সিনেমা এভাবে মুক্তি দেয়া হবে, ভারতে মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে একই দিনে সেগুলো বাংলাদেশের হলগুলোতেও প্রদর্শিত হবে। দুই ঈদে কোন ভারতীয় সিনেমা আনা হবে না, ওই স্লট দুটো খালি রাখা হবে দেশী সিনেমার জন্য, কারন আমাদের দেশে ঈদের সময়ই সবাই সিনেমা মুক্তি দিতে চায়। 

হল মালিকদের চাহিদার মধ্যে কোন অন্যায় চাহিদা দেখতে পাচ্ছি না। হ্যাঁ, কয়টা সিনেমা মুক্তি পাবে, কোন কোন সিনেমা মুক্তি পাবে, সেগুলো কয়টা হলে রিলিজ দেয়া হবে, দেশী সিনেমা এবং বিদেশী সিনেমার প্রদর্শনের অনুপাতটা কি হবে, টিকেটের দাম কেমন রাখা হবে, কি পরিমাণ ভ্যাট এবং সার্ভিস চার্জ যুক্ত করা হবে- এগুলো আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করে নিতে হবে, একটা নীতিমালার মধ্যে আনতে হবে পুরো ব্যাপারটাকে, যাতে দেশীয় সিনেমা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কিন্ত বাংলাদেশের সিনেমা ধ্বংস হয়ে যাবে- এমন অজুহাতে যারা ভারতীয় সিনেমা আনতে দিতে চাইছেন না, তাদের এই বিরোধিতার কারন একটাই- নিজেদের কন্টেন্টের ওপর বিন্দুমাত্র ভরসা না থাকা। 

ভারতীয় সিনেমা ঠেকানোর জন্য একসময় শিল্পীরা আন্দোলনও করেছেন

প্রতি বছরে ১০/১২টা করে বলিউডি, কলকাতার বাংলা সিনেমা, দক্ষিণ ভারতীয় বা অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রির সিনেমা যদি এদেশে বৈধভাবে মুক্তি পায়, শিক্ষিত শ্রেণীর দর্শকেরা সেসব সিনেমা দেখতে নিশ্চয়ই যাবেন। হিরো আলমের সিনেমা তো তারা হলে গিয়ে দেখবেন না। এতে করে আজেবাজে সিনেমা যারা বানায়, তাদের বাড়া ভাতে ছাই পড়বে, ভালো সিনেমা দেখার সুযোগ পেলে স্বাভাবিকভাবেই দর্শক মানহীন কন্টেন্ট থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেবে, এই আশঙ্কায় আবারও সরব হয়েছেন একদল মানুষ। তারা নিজেদের শিল্পী হিসেবে দাবী করেন, অথচ তাদের অন্তর সংকীর্ণতায় ঠাসা। শিল্পীসুলভ ঔদার্যের উপস্থিতি নেই কোথাও। 

আমাদের একজন সুপারস্টার বলেছেন, বলিউডের দেড়শো কোটি রূপি বাজেটের সিনেমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই প্রতিযোগিতায় ঢাকার সিনেমা কখনোই টিকতে পারবে না। সুপারস্টার জানেন না, সিনেমা টিকে থাকে কন্টেন্টের জোরে, চিত্রনাট্য, নির্মাণ আর অভিনয়ের জোরে, বাজেটের জোরে নয়। বলিউডের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে কলকাতার সিনেমা কিভাবে টিকে আছে তাহলে? সেখানকার ফিল্মের বাজেটও তো আমাদের কাছাকাছি, একসময় আমাদের চেয়েও কম ছিল। কিংবা মালয়লাম সিনেমা, তারা কিভাবে বলিউড কিংবা এতগুলো দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রির মাঝেও স্বতন্ত্র হয়ে বিচরণ করছে? 

আসামের মতো ছোট্ট একটা রাজ্যে আমিষের মতো দুর্দান্ত একটা রোমান্টিক থ্রিলার বানানো হয়, বুলবুল ক্যান সিং বা ভিলেজ রকস্টারের মতো সিনেমা দেখি আর আফসোসে পুড়ি, আমাদের দেশে কবে এরকম সিনেমা হবে এই ভেবে! ভালো সিনেমা যে এখানে হয় না তা নয়। কিন্ত একটা মনপুরা, টেলিভিশন, অজ্ঞতানামা, আয়নাবাজি, ঢাকা অ্যাটাক, ডুব কিংবা মাটির প্রজার দেশের জন্য যে অপেক্ষা, যে চাহিদা- সেটা পূরণ হচ্ছে কই! কেরালার ছোট্ট ইন্ডাস্ট্রি মালয়লাম, অল্প বাজেটে কি দুর্দান্ত সব গল্পনির্ভর সিনেমা বানায়, আর আমরা কিনা বাজেটের অজুহাত দেই সব জায়গায়! 

আমাদের সুপারস্টাররা বলেন, ভারতীয় সিনেমার আগ্রাসনে নাকি নেপালের সিনেমা ধ্বংস হয়ে গেছে, ভুটানের সিনেমা ধ্বংস হয়ে গেছে। অথচ নেপাল আর ভুটানে যে মানের সিনেমা বানানো হয়, ঢাকা সেটার চেয়েও অনেক পিছিয়ে। পাকিস্তানের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি একযুগ আগেও অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছিল, বি-গ্রেড সব সিনেমা বানানো হতো তখন। বলিউডি সিনেমা অনেক আগে থেকেই পাকিস্তানে মুক্তি পায়। কই, পাকিস্তানী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তো হারিয়ে যায়নি, বরং ফিনিক্স পাখির মতো গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে বলিউডের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। এখন পাকিস্তানী সিনেমা দেখলে ঈর্ষা হয়, আফসোস হয়। কোন জায়গা থেকে কোথায় চলে গেছে ওরা, আর আমরা পড়ে আছি সেই তিমিরেই! 

ছবি- বলাকা সিনেমা হল

এই যুগটা প্রতিযোগিতার যুগ, এখানে নিজের কাজ দিয়ে টিকে থাকতে হবে। বাজারে অন্য কাউকে ঢুকতে না দিয়ে নিজের বাজে পণ্যগুলোকেই শুধু বিক্রি করব- এই চিন্তাভাবনা নিয়ে বসে থাকলে গোটা বাজারটা ধ্বংস হবে, কারন মানুষের হাতের কাছে অজস্র অপশন। নেটফ্লিক্স-অ্যামাজন-টরেন্ট সবকিছুই এখন হাতের মুঠোয়। আপনি সিনেমার নামে অখাদ্য বানাবেন, আর মানুষ বাধ্য হয়ে ঢাকা শহরের জ্যাম ঠেলে সিনেমা হলে গিয়ে চার ঘন্টা সময় খরচ করে সেটা দেখবে- এমন দুরাশা করা ছেড়ে দিন। তারচেয়ে বাজারটা উন্মুক্ত করুন, দর্শককেই ঠিক করতে দিন তারা কি দেখবে। আপনার কাজ দর্শকের জন্য ভালো কন্টেন্ট নিয়ে আসা, ভালো সিনেমা বানানো; দর্শকের ওপর কোনকিছু চাপিয়ে দেয়াটা আপনার কাজ নয়। 

ঢাকার বাইরে কয়টা সিনেমা হলে মানুষজন পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখতে যেতে পারে? চেয়ার ভাঙ্গা, পর্দা ঘোলা, সাউন্ড সিস্টেমের দফারফা অবস্থা- এগুলো ঠিক না হলে দর্শক যাবে কীভাবে? হলের মালিকই বা সংস্কারের টাকা পাবেন কোথায়? এরচেয়ে সেই জায়গায় শপিং মল বানিয়ে ফেললে বেশি লাভ। গত দুই দশকে শত শত সিনেমা হল বন্ধ হয়েছে এভাবে, যে দেড়-দুইশোটা বেঁচে আছে, সেগুলোর মধ্যে সিংহভাগের অবস্থা বেসামাল। ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শন করে তারা যদি নিজেদের অবস্থার উন্নতি করতে পারে, সেটা তো দেশের সিনেমা, দেশের দর্শকের জন্যেই ভালো। এই সহজ হিসেবটা কেন কেউ বুঝতে পারছে না, নাকি বোঝার চেষ্টা করছে না?

শিল্পীরা তাদের রুজি-রোজগারের কথা ভাবছেন, হল মালিকেরা তাদের ব্যবসা বাঁচাতে চাইছেন, কিন্ত দর্শকের কথা ভাবছে না কেউই। একজন দর্শক হিসেবে আমি চাই আমার দেশের সিনেমা হল হোক উন্মুক্ত। এখানে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, হলিউড, টালিউড সব জায়গার ভালো সিনেমাগুলো আসুক, একটা নিয়মের মধ্যে দিয়ে মুক্তি পাক, দেশীয় সিনেমার ক্ষতি না করে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় প্রদর্শিত হোক। আয়নাবাজির পরিচালক অমিতাভ রেজা যেমন প্রস্তাব রেখেছেন, বিদেশী সিনেমাগুলোকে ত্রিশ শতাংশের বেশি শো না দেয়ার জন্য, আমিও সেই প্রস্তাবে সায় জানাই। 

অমিতাভ রেজা নিজের কাজের ওপর আস্থা রাখতে পারেন, তাই নিয়ম মেনে বাইরের সিনেমা মুক্তি দেয়ার মধ্যে দোষ খোঁজেন না। নিজেদের কাজের ওপর যাদের বিশ্বাস নেই, যারা জানে যে বাইরের দেশের ভালো সিনেমাগুলো এদেশে প্রদর্শিত হওয়া শুরু হলে দর্শক তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেবে, তারাই জুজির ভয় দেখিয়ে সব আটকে রাখতে চায়, আবার নিজেরা কাজের সুযোগ পেলে কাফনের কাপড় ফেলে দিয়ে সোজা ওইপাড়ে দৌড় লাগায়। দিনশেষে সবাই নিজের কথাটাই ভাবে, দর্শকেরটা কেউ ভাবে না, ভাববেও না হয়তো...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা