নেপালের নাগরিক কেন যুদ্ধ করছে ভারতের পক্ষে?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ব্রিটিশ আমল থেকেই ভারতের সেনাবাহিনীতে কাজ করছে নেপালের 'গোর্খা' নাগরিকেরা। যেটা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। এক স্বাধীন দেশের নাগরিক কেন বুক চিতিয়ে লড়াই করছে অন্য আরেকটি দেশের জন্যে?
'নেপালি গোর্খা' সৈন্যদের নিয়ে ভারতের প্রথম ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ বলেছিলেন বাঁধাই করে রাখার মত এক লাইন-
যদি কোনও সৈন্য বলে সে জীবন দিতে ভয় পায় না - তাহলে সে হয় মিথ্যে বলছে, নয়তো সে গোর্খা!
গোর্খারা তাদের এই বিশ্বস্ততার কারণেই সবখানে প্রবল জনপ্রিয়। নেপালের খুব ছোট্ট এক অংশের নাগরিক হওয়া সত্বেও সবাই তাদের চেনে। ব্রিটিশ আমল থেকে বুক চিতিয়ে লড়াইও করছে তারা ভারতের পক্ষে। একটু খটকা লাগছে না? তারা নেপালের আদি ও অকৃত্রিম নাগরিক। তারা কেন অন্য আরেকটি রাষ্ট্রের হয়ে লড়াইয়ে সামিল হচ্ছে? এই প্রশ্ন মাথায় আসা স্বাভাবিক তো বটেই, প্রাসঙ্গিকও।
ভারতের সেনাবাহিনীতে নেপালের গোর্খারা অংশগ্রহণ করে আসছেন উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আসার পর থেকেই। সময়ের ব্যবধানে ভারতবর্ষ অনেক উত্থানপতন দেখেছে, মানচিত্রে অনেকরকম আঁকিবুঁকি হয়েছে, তবে গোর্খারা প্রথম থেকেই রয়ে গিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ফার্স্ট গোর্খা রাইফেলস, যেটাকে বলা হয় আদি গোর্খা রাইফেলস, তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮১৬ সালে। তখনই প্রথম গোর্খারা ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করা শুরু করে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, সে সময়ে ভারতের সৈন্যসংখ্যা দাঁড়ায় বিশ লাখে! যুদ্ধের পরে তাই এই 'অতিকায় সেনাবাহিনী' থেকে 'সৈন্য-ছাঁটাই শুরু হয়। ছাঁটাই প্রক্রিয়ায় বাদ যায় অনেক গোর্খা সৈন্যও। গোর্খাদের কাছে জানতেও চাওয়া হয়, তারা ভারতের সেনাবাহিনীতে কাজ করতে ইচ্ছুক কী না, অথবা তারা ব্রিটেনের সেনাবাহিনীতে যেতে চায় কী না, অথবা তারা তাদের দেশ নেপালে ফিরে যেতে চায় কী না৷
গোর্খারা জানিয়ে দেয়, তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনেই কাজ করবে। গোর্খাদের এই সিদ্ধান্তের পেছনে কারণও আছে, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করেই অনেক গোর্খার পারিবারিক সচ্ছলতা এসেছে, সেটিকে তারা নষ্ট করতে চাচ্ছিলো না। গোর্খাদের অর্থনৈতিক অবস্থা প্রথম থেকেই বেশ দূর্বল। রুটিরুজির সংস্থান হচ্ছিলো এই চাকরীর মাধ্যকেই, সেটিকে তারা কেনই বা ছাড়বে? গোর্খাদের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তাই ত্রিপাক্ষিক চুক্তিও হয় তখন। ভারত, নেপাল ও ব্রিটেনের অংশগ্রহণে। যেখানে বলা হয়, ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রতিবছর কিছুসংখ্যক 'গোর্খা সৈন্য'কে রিক্রুট করবে বাহিনীতে। তারই ফলশ্রুতিতে ভারতীয় সেনা প্রতি বছর প্রায় তেরোশো গোর্খা রিক্রুট করে, ব্রিটিশ আর্মি ও সিঙ্গাপুর পুলিশের জন্যও নেপাল থেকে প্রতিবছর বাছাই করা হয় শদুয়েক গোর্খাকে। এবং এটাও জেনে রাখা ভালো, ভারতের সেনা ও আধা-সামরিক বাহিনীগুলো মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশ হাজারের মতো গোর্খা সেনা কর্মরত আছেন এখন। ব্রিটেন, সিঙ্গাপুর, ভারত যেখানেই তারা কাজ করুক না কেন, ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ এর কথাকে তারা নিয়মিত প্রমাণ করে যাচ্ছে তাদের বিশ্বস্ততা দিয়ে।
তবে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে কিছু বিতর্কও তৈরী হয়েছে৷ অনেকে বিশেষজ্ঞই বলছেন, একটা দেশের মানুষ যদি অন্য আরেকটি দেশের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন, সেটা আসলে কতটা যৌক্তিক? তাছাড়া যদি কোনোদিন ভারত আর নেপালের যুদ্ধ হয়, এই গোর্খা সৈন্যরা কোন পক্ষের হয়ে লড়াই করবে? তাছাড়া দুইশো বছর আগের এ চুক্তি অনুসারে এখনও কেন অন্য দেশের মানুষকে সেনাবাহিনীতে নিতে হবে? কেন নতুন চুক্তি নবায়ন করা হচ্ছেনা? যেহেতু বিষয়টি নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে, সেহেতু নতুন করে চিন্তাভাবনা হচ্ছে না কেন? একটা স্বাধীন দেশের মানুষ কেন অন্য দেশের অধীনে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে থাকবে, এটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে সবার সামনে। আবার আরেক দল বিশেষজ্ঞ বলছেন, গোর্খাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করা নিয়ে এত জলঘোলার তো কিছু নেই৷ এক দেশের মানুষ অন্য দেশের সেনাবাহিনীতে কাজ করার তো নজির আছে অজস্র। সেখানে ঘরের পাশের দেশে যদি এরকম কাজ করে স্বাবলম্বী হওয়া যায়, সমস্যাটি ঠিক কোথায়? তাছাড়া নেপাল যদি তার যুবকদের চাকরী দিতে না পারে, তাহলে তারা বেকার হয়ে বসে থাকবে? কাজের চেষ্টা করবে না? এভাবেই চলছে।
কয়েক মাস আগে সীমানা নিয়ে নেপাল ও ভারতের বিরোধ শুরু হলে এই 'গোর্খা-প্রসঙ্গ' আবার চলে আসে আলোচনার টেবিলে। নেপালের উচ্চপদস্থ কেউ কেউ এটাও দাবী করেছেন, যে চুক্তির ফলশ্রুতিতে গোর্খারা ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করছেন, সে চুক্তি অযৌক্তিক। ভারতীয় বাহিনীতে গোর্খাদের রিক্রুটমেন্ট নিয়ে অনিশ্চয়তাও তৈরি হয়ে গিয়েছে এরকম কথাবার্তার পর। তবে এবারেই যে এই চুক্তি বাতিলের দাবী প্রথমবারের মতন এসেছে, এরকম না বিষয়টা। আট বছর আগেও গোর্খা রিক্রুটের এই চুক্তি বাতিলের দাবী উঠেছিলো।
এ ছাড়াও বেশ অনেকদিন ধরেই হচ্ছে আরেকটা দাবী। স্বতন্ত্র গোর্খাল্যান্ডের দাবী। দার্জিলিং এ বসবাসরত গোর্খারা দাবী করছেন, তাদের জন্যে একটা আলাদা জায়গা দিতে হবে। এই দাবীর যৌক্তিকতা ও অযৌক্তিকতা নিয়েও ভিন্ন ভিন্ন আলোচনা হচ্ছে। এবং 'গোর্খাল্যান্ড' এর দাবীতে প্রতিবাদ, সমাবেশ ও মানববন্ধনও হয়েছে স্থানে স্থানে। 'গোর্খ্যাল্যান্ড আন্দোলন' নামে আন্দোলনও হয়েছে বেশ কয়েকবার।
তবে, এটাও ঠিক, আশেপাশের বিক্ষিপ্ত উত্তাপের আঁচ এখনো গায়ে এসে লাগছে না ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত গোর্খাদের। তারা তাদের মতই আনুগত্যের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু অসন্তোষ যদি চরমে ওঠে, তাহলে এই গোর্খারা আর কতদিন থাকবেন এভাবে, শ্যাম মানেকশের সেই বিখ্যাত লাইন কতটুকু সত্য থাকবে, সেটা অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়। কারণ, কথাতেই তো আছে-
নগর পুড়লে, দেবালয় কি এড়ায়?
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন