ইন্দিরা গান্ধীকে বলা হতো আয়রন লেডি অফ ইন্ডিয়া, প্রতিপক্ষের রাজনীতিবিদরাও প্রবলভাবে সমীহ করতেন তাকে। একাত্তরে তিনি সর্বশক্তি দিয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছেন, অথচ সেই লৌহমানবী আচমকাই নিহত হয়েছিলেন নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে...

অক্টোবর, ১৯৮৪। ঠিক পাঁচ মাস আগেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার নির্দেশে পাঞ্জাবে শিখ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উপসনালয় 'গোল্ডেন টেম্পেল (স্বর্ণ মন্দির)'- এ ভারী ভারী কামান, ট্যাঙ্ক সমেত অপারেশন চালিয়েছিলো ভারতীয় সেনাবাহিনী। নাম দেয়া হয়েছিলো অপারেশন 'ব্লু স্টার' এবং উদ্দেশ্য ছিল, শিখ নেতা বিন্দ্রায়ালের নেতৃত্বে মন্দিরে অবস্থানকারী একদল বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র জঙ্গীদের উচ্ছেদ করা৷ অপারেশন সফল হলেও, এটির পরিণতি দ্রুতই নেতিবাচক অর্থে বিস্তার লাভ করে এবং শিখদের ধর্মীয় আবেগ সুবিশাল ধাক্কা খায়। কারণ সেনাবাহিনীর আচমকা হামলায় শিখদের বিভিন্ন স্থাপনা গুড়িয়ে যায় এবং মন্দিরে অবস্থানকারী সাধারণ শিখরাও উল্লেখযোগ্য হারে নিহত হন। 

সেই মুহুর্তে তৎকালীন গোয়েন্দা সংস্থা র' এর চিফ ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা আর এন কাও দ্রুতই ইন্দিরার নিরাপত্তারক্ষী বাহিনী থেকে দুজন শিখ সদস্য সাতওয়ান্ত সিং এবং বিন্ত সিং-কে সরিয়ে দেন। কিন্তু এতে বাঁধ সাধেন ইন্দিরা নিজেই৷ জবাবে বলেছিলেন, 'আমরা সারাজীবন প্রগতিশীল রাজনীতি করেছি। প্রগতির জন্য কাজ করে গেছি৷ আজ যদি আমি তাদের সরিয়ে দিই তাহলে দেশ ও জাতির কাছে ভুল বার্তা যাবে, আদর্শেরই কোনো মূল্য থাকবে না।' তাঁর আদেশেই সেই দুই শিখের বদলি থামিয়ে পুনরায় আগের দায়িত্ব দেয়া হলো। পাঁচ মাস পর, গুলিবিদ্ধ ইন্দিরা যখন লুটিয়ে পড়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী বাসভবনের সম্মুখে কাঠের গেইটটির কাছাকাছি, তখন বিন্ত সিং তিনবার গুলি চালালেও, সাতওয়ান্ত সিং ইন্দিরার শরীরের পর প্রায় ত্রিশ রাউন্ড গুলি খরচ করে ফেলেছিলেন।

১৯৭৪ সালে কংগ্রেস নেতা ডি কে বড়ুয়া (পরবর্তীতে দলীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন) বলেছিলেন, 'Indira is India, India is Indira'। নেতা কি কখনো দেশের উর্ধ্বে চলে যান? হয়তো না। কিন্তু নেতা কখনো কখনো নিজেই স্বয়ং দেশ ও জাতি হয়ে উঠতে পারেন, এমনটা হয়তো অনেকে বিশ্বাস করে এবং ব্যাখ্যার দাবীতে বেশকিছু উদাহরণও দাঁড় করানো যায়। আসলে তৎকালীন ভারতীয় রাজনীতিতে ইন্দিরা এতোটাই শক্তিশালী এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন যে, একথাটি তাই রাজনীতির পথে প্রান্তরে হরহামেশাই শোনা যেত৷ এবং নানান মতে ইতিহাস বিশ্লেষণে এখনো কথাটির গুরুত্ব, জনপ্রিয়তা ও প্রাসঙ্গিকতা বলবৎ আছে। আমার কাছেও বিষয়টি খানিকটা এরকমই যে হয়তো ইন্ডিয়া হতেই ইন্দিরা শব্দটি এসেছে, ইন্দিরা হতেই ইন্ডিয়া এসেছে! কেননা একজন বাংলাদেশী হিসেবে 'ইন্ডিয়া' শব্দটা কানে আসলে স্বাভাবিকভাবে চোখে ইন্দিরা গান্ধীর মুখই প্রথম ভেসে উঠে।

তাঁর জন্ম হয়েছিলো এলাহাবাদে, পিতা পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু এবং মাতা কমলা নেহেরুর কোল আলো করে। পিতা নেহেরু ও দাদা মতিলাল নেহেরু তো বটেই, মাতাও ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বাগ্রে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাম রেখেছিলেন প্রিয়দর্শিনী। মূলত চেহারায় অদ্ভুত মায়ার কারণেই রবিঠাকুর এই নাম দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।

রবিঠাকুর তার নাম দিয়েছিলেন প্রিয়দর্শিনী 

এদিকে জন্মের পর থেকেই শুরুর দিকে পিতার সাথে আত্মিক সম্পর্ক সেভাবে গড়ে উঠেনি। অধিকাংশ সময় নেহেরুকে কারাগারেই থাকতে হতো কিংবা দেশব্যাপী আন্দোলন সংগ্রামে ব্যতিব্যস্ত থাকতেন। ফলে নেহেরু অগত্যা চিঠি লেখা শুরু করেন ইন্দিরাকে৷ পিতার চিঠিগুলো ইন্দিরার মননকে চমৎকার প্রভাবিত করার ফলে তাঁর মানবিক ও রাজনৈতিক চেতনার উৎকর্ষ সাধিত হয়। তাছাড়া মহাত্মা গান্ধীর স্বরাজ আন্দোলনের মুহুর্তে নেহেরু কন্যা ইন্দিরাকেও দেখা যেত দেশীয় খাদির বানানো কাপড় পরিধান করতে। সুতরাং শিশুকাল থেকেই পিতার গড়া জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিমুখী আন্দোলনের সংস্কৃতি ও চর্চাকে যেমন উপলব্ধি করেছেন, তেমন পাশাপাশি পারিবারিক মহলে বড় সব সংগ্রামী জীবনকে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার ফলে রাজনৈতিক মেজাজ নিয়েই গড়ে উঠেছেন তিনি।

পরবর্তীতে একটি বয়সে মায়ের সাথে কলকাতার বেলুড় মঠে চলে আসেন। সেখানে স্বামী রাঙ্গানাঠানাডার সংস্পর্শে ছিলেন বেশ কিছুদিন। পরবর্তীতে শান্তি নিকেতনে যান যা আজ বিশ্ব-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় নামেই সমধিক পরিচিত। যদিও সেখানে পড়াশোনা খুব বেশি দিন চলে নি, ১৯৩৭ সালে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ্যায় ভর্তি হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেখানেও তিনি পড়ালেখা শেষ করতে পারেননি। মায়ের অসুস্থতার পরে, নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন ইউরোপ থাকাকালীন। এক পর্যায়ে দেশে ফিরে আসেন।

১৯৪২ সালে সাবেক কংগ্রেস নেতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ফিরোজ গান্ধীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ইন্দিরা। যদিও রাজনীতির মাঠে কট্টর হিন্দুপন্থীরা পরবর্তীতে 'ফিরোজ' শব্দটিকে ব্যবহার করে ইন্দিরা মুসলিম পুরুষ বিয়ে করেছেন বলে অপপ্রচার চালিয়েছিলো। কিন্তু আসলে দেখা যায়, ফিরোজ গান্ধী ছিলেন পার্সি ধর্মের অনুসারী।

পরবর্তীতে স্বাভাবিকভাবেই কংগ্রেসের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ইন্দিরা গান্ধী৷ ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত নেহেরুর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিয়োগ পান। ধীরে ধীরে আঞ্চলিক প্রদেশগুলোতে তাঁর সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। ১৯৫৭ সালে কেরালার প্রাদেশিক নির্বাচনে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি 'থিন মেজরিটি' নিয়ে জয়ী হয় (তৎকালীন সময়ে গণতান্ত্রিক ভোটে অংশগ্রহণ করে কোনো বামধারার কমিউনিস্ট দলের অন্যতম বিজয় ছিল এটি), যা দিল্লীর সরকার ও কংগ্রেসের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে উঠে। ১৯৫৯ সালে কংগ্রেসের সভাপতিত্ব নিয়েই কেরালায় চোখ দেন ইন্দিরা। তাছাড়া ততদিনে কেরালায় নতুন রাজনৈতিক ক্রাইসিসও তৈরি করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলো কংগ্রেস। 

১৯৬০ সালে ফের প্রাদেশিক নির্বাচন হলে এবার কংগ্রেসই জিতে আসে, সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে প্রথম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ইন্দিরা। এরপরেও রাজনীতি নিজস্ব গতিতেই চলছে, যদিও জাতীয় রাজনীতিতে তখনো ইন্দিরা প্রভাবশালী কেউ হয়ে উঠতে পারেননি। ১৯৬৪ সালে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে ইন্দিরাকে ভারত সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়।

ইন্দিরা গান্ধী- দ্য আয়রন লেডি অফ ইন্ডিয়া

তবে ১৯৬৬ সালে শাস্ত্রীর রহস্যজনক মৃত্যুর পর দলীয় নেতৃত্বেই সংকট তৈরি হয় এ বিষয়ে যে কে হতে যাচ্ছেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী, মোরাজি দেশাই নাকি ইন্দিরা। দিনশেষে দলীয় সভাপতি কে. কামারাজ এর ব্যক্তিগত কারিশমায় মোরাজি দেশাই কোণঠাসা হলে প্রধানমন্ত্রী পদে ইন্দিরার চেহেরায় সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণযোগ্যতা পায়। কিন্তু ১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে ইন্দিরার নেতৃত্বে কংগ্রেস জিতে আসলেও প্রত্যাশিত ফলাফল করতে পারেনি। বিগত নির্বাচন হতে আসন ও ভোট সংখ্যা দুটোই ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। এতে দলের মধ্যকার কোন্দল প্রকট হয়ে উঠে আসে। 

ফলাফল হিসেবে দেখা যায়, অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিভিন্ন রাজ্যে প্রবীণ কংগ্রেস নেতারা দল ছাড়তে শুরু করলে নানামুখী ভাঙন তৈরি হয়। পশ্চিম বঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অজয় চক্রবর্তী দল ত্যাগ করে প্রণব মুখার্জি, গণি খান চৌধুরীদের নিয়ে 'বাংলা কংগ্রেস', উত্তরপ্রদেশে চরণ সিং দল ত্যাগ করে 'ভারতীয় ক্রান্তি দল', উড়িষ্যায় সাবেক মুখ্যমন্ত্রী হরেক্রুষ্ণা মাহাতাব দল ত্যাগ করে 'উড়িষ্যা জন কংগ্রেস' নাম রাজনৈতিক দল গঠন করেন। হরিয়ানা ও মনিপুর রাজ্যেও কংগ্রেস ভেঙে নতুন দল বেরিয়ে আসে৷

ইন্দিরা গান্ধী প্রথমবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেও দলের পরিবেশ মোটেও সুখকর ছিল না৷ তাই শেষ অবধি ইন্দিরা নিজেই কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসে এবং 'Indian National Congress (Requisitionists)' নামক দল গঠন করেন। এটি পরবর্তীকালে ইন্দিরা কংগ্রেস নামেই সমধিক পরিচিত লাভ করে। অপরদিকে কামারাজ এর নেতৃত্বে কংগ্রেসের একটি অংশ থেকে যায়, তারা দলের নামকরণ করে 'Indian National Congress (Organisation)'। এটি পুরোনো কংগ্রেস হিসেবেই পরিচিত লাভ করে। কিন্তু ইন্দিরার নেতৃত্বে নতুন কংগ্রেসই ভারতের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে এবং বিশাল ব্যবধানে ১৯৭১ সালের সাধারণ নির্বাচন জিতে আসে। ফলে দেখা যায় ধীরে ধীরে ইন্দিরা কংগ্রেসই শতবছর পুরোনো কংগ্রেস দলের উত্তরাধিকার হয়ে উঠে এবং পুরোনো কংগ্রেস দলটি জনতা দলের সাথে আবদ্ধ হয়ে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যায়।

তবে ইন্দিরা জাতীয়তাবাদী নেতা হয়ে উঠেছিলেন ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (যা পশ্চিমদিকের কাশ্মীর, পাঞ্জাব এবং রাজস্থানসহ বেশ কিছু সীমান্ত অঞ্চলে সংঘটিত হয়) এবং বাংলাদেশের জনগণের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখার জন্য। জোড়ালো ভূমিকার কারণে একই সাথে তিনি আন্তর্জাতিক মহলেও প্রভাবশালী নেত্রী হয়ে উঠেন। বিশেষত আন্তর্জাতিক মহলে তিনি যেভাবে বাংলাদেশের জন্য লড়েছেন, শরণার্থী শিবিরে এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশী নাগরিক আশ্রয় দিয়েছেন ফলে বিরোধী পক্ষেও তাঁর জোর সমর্থন তৈরি হয়। প্রচলিত আছে, ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী তাঁকে 'মা দুর্গা' বলে সম্বোধন করেছিলেন, যদিও তিনি তা পরবর্তীতে অস্বীকার করেন। কিন্তু সেই সময় ইন্দিরার সাহসী পদচারণায় রাজনীতিতে তাঁর সময়ের নেতাদের চেয়ে ঢের এগিয়ে যান৷

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী

অবশ্য ইন্দিরার রাজনৈতিক পথচলায়, সবচেয়ে বড় সমস্যা তৈরি হয় ১৯৭৫ সালে দেশব্যাপি বিদঘুটে কারণ ও যুক্তি দেখিয়ে ইমার্জেন্সি ডাকায়। এ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের গ্রেফতার এবং নির্যাতন করা হয়। অনেক কর্মী খুন হয়। দেশের মানুষের জীবনযাত্রাও বিপর্যস্ত হয়ে উঠে, জনরোষ সৃষ্টি হয়৷ ফলে সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল একই প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে জোটবদ্ধভাবে ১৯৭৭ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণ করে। যথারীতি ভারতের স্বাধীনতার প্রায় ত্রিশ বছর পর প্রথমবারের মতো কংগ্রেস সাধারণ নির্বাচন হেরে ক্ষমতাচ্যুত হয়। বিরোধী পক্ষ 'জনতা জোট', নির্বাচনে প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট পায়৷ ইমার্জেন্সির সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে আজো তিনি সর্বমহলে সমালোচিত হন, কট্টর বিরোধিতাকারীরা আজো তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও শিষ্টাচার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

ইমার্জেন্সির পর ভোটে বিশাল ব্যবধানে হেরে যাওয়ায়, অনেকেই ভেবেছিলেন ইন্দিরার দ্রুত সময়ে ফের প্রত্যাবর্তন বুঝি অসম্ভবই। কিন্তু ১৯৭৭ সালে বিহার প্রদেশের বেলচি গ্রামে কুর্মি জাতের একটি সন্ত্রাসী দল দলিতদের ওপর গণহত্যা চালায়। ঘটনার পর ইন্দিরা কাল বিলম্ব না করে বিহারের উদ্দেশ্যে রওনা হন। প্রতিপক্ষ এবং জনমনেও এই ভাবনা ছিল, ইন্দিরা সেই গ্রাম অবধি যাবেন না। কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা এতো খারাপ ছিল, ভাঙা রাস্তা, জল, কাঁদা মাটি পেরিয়ে অনেক ঝক্কি পোহাতে হবে। কিন্তু ইন্দিরা প্রমাণ করলেন, রাজনীতির মাঠে তাঁকে বরাবরই আনপ্রেডিক্টেবল হিসেবে ধরে নিতে হবে! কখনো জীপ, কখনো ট্রাক্টর তো কখনো 'মতি' নামের হাতিতে চড়ে প্রায় সাড়ে ভ্রমণ, ইন্দিরা বেলচি পৌঁছেছিলেন সকল বাঁধা উপেক্ষা করেই। সেখানে তিনি নিহতদের পরিবারগুলোর সাথে দেখা করেন। ইন্দিরার মাস্টারস্ট্রোকে কয়েকমাস পেরোতেই প্রতিপক্ষ জোট প্রবল ধাক্কা খায়। রাজপথে তখন ফের স্লোগান উঠে, 'আধা রুটি খায়েঙ্গে, ইন্দিরা কো লায়েঙ্গে'! বলা হয়ে থাকে, বিহারি রাজনীতিবিদদেরই সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল ইন্দিরাকে কোণঠাসা করার, অথচ সেই বিহার দিয়েই ইন্দিরা তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের পুনর্জাগরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

তিন বছর পরে বিরোধী পক্ষে ভাঙন দেখা দেওয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে ফেলে এবং ১৯৮০ সালে পুনরায় নির্বাচন হয়৷ আবার ইন্দিরা জিতে আসেন, এবার পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর ক্যারিশমাও কাজ করে। প্রধানমন্ত্রীত্ব ফিরে পাওয়ার কয়েক মাস পরেই 'মা' হিসেবে বড় আঘাত পান ইন্দিরা গান্ধী। ছোট ছেলে সঞ্জয় নিহত হন বিমান দুর্ঘটনায়। পরিবারের ছোট বউ মেনকা গান্ধীর সাথে দূরত্ব তৈরি হয় তাঁর। কঠিন মনোমালিন্যে কিছু বিষয় আদালত অব্ধি গড়িয়ে পড়ে, এক পর্যায়ে বাড়ি ও পরিবার ছাড়েন মেনকা। যদি ঘরের এসব বিষয়কে কখনো দেশ, জাতির ও দলের বিষয় বানাননি তিনি। কিন্তু বিরোধী পক্ষ হতে নানান অপপ্রচার হয়ে আসছিলো সর্বদা। অবশ্য এতেও ইন্দিরা কাবু হননি বরং আদর্শের প্রতি সদা অবিচল তিনি নিজের দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে সামলে গেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। নরম সুরে কথা বলার অভ্যাস থাকলেও, সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি বরাবরই হয়ে উঠতেন 'আয়রন লেডি'! সংকোচহীনতা ও সৎসাহস তাঁর নরম ব্যক্তিত্বকে মুহুর্তেই অগ্নিঝরা ব্যক্তিত্বে পরিণত করতো। তাই শত্রুরাও তাঁকে বারংবার এড়িয়ে চলেছে৷

ইন্দিরা গান্ধী

পূর্ব বাংলার মাটি যখন ভয়াবহতম পর্যায়ে শত্রুর আক্রমণে আক্রান্ত তিনি দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, 'পৃথিবীর আর কেউ না থাকুক, আমি আছি তাদের পাশে'। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে কলকাতার ময়দানে লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে সাক্ষী রেখে কৃতজ্ঞতার সহিত বলেছিলেন, 'আমার সাথে ইন্দিরার গান্ধীর মিল আছে আদর্শে, নীতিতে, মানবিকতায়। তিনি বিশ্ব শান্তির জন্য কাজ করেছেন।' আসলেই তো তাই। যুদ্ধ চলাকালীন কোটি শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান, মিত্র বাহিনী তৈরি কিংবা জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে সাথে নিয়ে পাকিস্তান-আমেরিকা-চীন শক্তিকে মোকাবেলা করা, যা কিছু সম্ভব ছিল সবই করেছেন। আজও ভারত বাংলাদেশের দৃঢ় ও মধুর মিত্রতা দাঁড়িয়ে আছে কেবল একজন ইন্দিরার ভূমিকার জন্য, যা কখনো কোনোভাবেই কোনো মাপকাঠিতে পরিমাপ করা যাবে না! ১৯৭১ সালে তিনি ভারতরত্ন উপাধিতে ভূষিত হন, বাংলাদেশ সরকার তাঁর অবদানের সর্বোচ্চ স্বীকৃতিস্বরূপ 'স্বাধীনতা সম্মাননা' পুরষ্কার প্রদান করেন। ইন্দিরা গান্ধীর পর ওমন শক্তিশালী ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতা আর আসেননি বলেই অনেকের ধারণা।

তাই বলতে হয়, ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী অমর থাকবেন তাঁর অগ্নিঝরা ব্যক্তিত্বের মধ্যে, তাঁর কর্মে, তাঁর রাজনৈতিক চেতনা, মতাদর্শ ও দূরদর্শিতায়। আজও এই উপমহাদেশে নারীর অবিরাম ও আদর্শিক সংগ্রামের সব চাইতে বড় মূর্ত প্রতীক হলেন তিনি। আজও প্রগতিবাদী সমাজ স্বপ্ন দেখে প্রতি কণ্টকাকীর্ণ ও প্রতিক্রিয়াশীল বিরোধী পথে, প্রতি শান্তি প্রতিষ্ঠার তৎপরতায় যেন একজন ইন্দিরার জন্ম হয় আদর্শিক চেতনায়।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা