ক্যারিয়ারটা উত্থান আর পতনে কাটিয়েছেন ইরফান, দারুণ পারফর্ম করেছেন, বাজে খেলে দল থেকে ছিটকেও পড়েছেন। আবার ফিরে এসেছেন দোর্দণ্ড প্রতাপে, কিন্ত ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেননি। ছিটকে গেছেন আবারও।
গুজরাটের বিদর্ভে দেড় কামরার ছোট্ট একটা বাসা নিয়ে থাকেন মেহমুদ খান পাঠান। স্থানীয় এক মসজিদে মুয়াজ্জিন তিনি, মসজিদ কমিটি থেকে মাসিক একটা বেতন দেয়া হয় তাকে, বাড়িভাড়া দেয়ার পরে হাতে আর থাকে না তেমন কিছুই। তার ওপরে বিয়ে করেছেন দুটো, দুই পরিবার সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় সারাক্ষণই। দুই রুমে দুটো চৌকি পেতে রাখা, বয়স্করা সেখানে ঘুমান, বাচ্চাকাচ্চাদের জায়গা হয় মেঝেতে। একবেলা ভরপেট খেলে অন্যবেলা আধপেটা থাকতে হয়, ধার-দেনার ঝামেলা তো আছেই। মাসের শেষ দিনগুলো কাটতে চায় না কোনভাবেই, একেকটা ঘন্টা যেন একটা দিনের সমান মনে হয় তখন।
সেই পরিবার থেকে উঠে এসে ক্রিকেটার হয়েছিলেন মেহমুদের দুই ছেলে, ইরফান এবং ইউসুফ। বেড়ে ওঠার পথটা মসৃণ ছিল না কখনোই, দারিদ্র্যতার কষাঘাতে জর্জরিত হয়েছে তাদের শৈশব, কৈশর। ভারতে ক্রিকেটটা ধর্মের মতোই মানা হয়, সেই ক্রিকেটের প্রেমে পড়েছিলেন ইরফান, একদম শৈশবেই। স্কুল পালিয়ে পাড়ায় পাড়ায় খেলে বেড়ানো ছেলেটা তখনই স্বপ্ন দেখতেন, ভারতের নীল জার্সিটা একদিন উঠবে তার গায়ে।
ইরফান নিজের সেই স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন, উনিশ বসন্তে ক্রিকেট দুনিয়াকে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন নিজের মেধা দিয়ে। অ্যাডিলেডে পেস সহায়ক উইকেটে সুইঙের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন আনকোরা এক তরুণ পেসার। হেইডেন-ল্যাঙ্গার-পন্টিংদের নিয়ে গড়া অস্ট্রেলিয়ান একাদশ অবশ্য সেই ম্যাচে পিটিয়ে ছাতু বানিয়েছিল তাকে। সেই ইরফান পাঠান সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিলেন গতকাল। ব্রেকিং নিউজের আকারে খবরটা শোনার পরে প্রথমেই মাথায় এলো- ইরফান পাঠান এখনও অবসর নেননি? এতদিন তাহলে বর্তমান ক্রিকেটার ছিলেন?
ভারতের ক্রিকেটে ইরফান পাঠানের নামটা আনন্দের চেয়ে আক্ষেপই জাগিয়েছে বেশি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেই হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। জাভাগাল শ্রীনাথের বিদায়ের পরে পেস আক্রমণে জহির খানের যোগ্য সঙ্গী পাওয়া যাচ্ছিলো না কোথাও, হরভজন-কুম্বলেদের নিয়ে ভারতের স্পিন আক্রমণ তখন বিশ্বসেরা, কিন্ত পেস ব্যাটারিতে দম নেই। তখনই আলোর মশাল হয়ে এসেছিলেন ইরফান।
করাচীর সেই টেস্টের কথা মনে পড়ে ভীষণ। টানা তিন বলে তিন উইকেট, হ্যাটট্রিক! মোহাম্মদ ইউসুফের অবিশ্বাস্য চাউনি, স্ট্যাম্প ভেঙ্গে ছত্রখান হয়ে পড়ে আছে। ইরফান নিজেও অবাক, চোখেমুখে বিস্ময়, হ্যাটট্রিকটা হয়ে গেছে- সেটা বিশ্বাস হচ্ছিলো না বোধহয়। বাতাস কেটে বাঁক নিয়ে ছুটে যাচ্ছে বল, বোকা বানাচ্ছে ব্যাটসম্যানকে- একজন ওয়াসিম আকরামের ছায়াটা ইরফান পাঠানের মধ্যে তখন দেখেছিল ভারতের মানুষ।
সেই স্বপ্ন ইরফান পূরণ করতে পারেননি, পূরণ তো দূরে থাকুক, ধারেকাছেও যেতে পারেননি। ২৯ টেস্ট আর ১২০টা ওয়ানডেতে থেমে গেছে তার ক্যারিয়ার, সবশেষ ভারতে জার্সিতে তাকে দেখা গেছে সেই ২০১২ সালে, আট বছর হয়ে গেছে সেসবেরও। আইপিএলে তাকে দেখা গেছে, সেখানেও যে মনে রাখার মতো আহামরি কিছু করতে পেরেছিলেন- এমনটা নয়। ইরফান বিস্মৃতির অতলে হারিয়েছেন অনেক আগেই, মনে রাখার দায় আসলে কারোরই ছিল না।
যে পরিমাণ সামর্থ্য ছিল, তার সিকিভাগও মাঠে অনূদিত হয়নি। ইরফান পারেননি। প্রথম টি-২০ বিশ্বকাপ, যেটা দিয়ে ক্রিকেটে ভারতের নতুন এক জয়রথের শুরু হয়েছিল, সেই ম্যাচটাও ভারত জিতেছিল ইরফানের দুর্দান্ত বোলিংয়ের কারণেই। সবাই ধোনির বুদ্ধিদীপ্ত অধিনায়কত্ব, মিসবাহ’র ভুল কিংবা যোগিন্দর শর্মার শেষ ওভারটাকেই দেখে, এর আগে পাকিস্তানের মেরুদণ্ডটা যে ইরফান ভেঙ্গে দিয়েছিলেন, সেটা পাঁড় ক্রিকেটভক্ত ছাড়া খুব বেশি মানুষের মনে নেই।
ক্যারিয়ারটা উত্থান আর পতনে কাটিয়েছেন ইরফান, দারুণ পারফর্ম করেছেন, বাজে খেলে দল থেকে ছিটকেও পড়েছেন। আবার ফিরে এসেছেন দোর্দণ্ড প্রতাপে, কিন্ত ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেননি। ছিটকে গেছেন আবারও। মাঝে বাগড়া দিয়েছে হাঁটু আর কনুইয়ের ইনজুরি, সেসবে জেরবার হয়েছেন কয়েক দফা, তবুও তিনি হার মানেননি, বিদায় বলার কথা ভাবেননি, চেষ্টা করেছেন টিকে থাকার।
আটত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেছে, ভবিষ্যতটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলেন বলেই হয়তো আনুষ্ঠানিক বিদায়টা জানিয়ে দিলেন এবার। নইলে ইরফান যে পেশাদার ক্রিকেটে আছেন, সেটাই তো ভুলে গিয়েছিল মানুষ। ক্রিকেটার ইরফানের চেয়ে বরং নাচের রিয়্যেলিটি শো ‘নাচ বলিয়ে’র বিশেষ প্রতিযোগী হিসেবে যাওয়া ইরফান খানই আলোচনার খোরাক হয়েছেন বেশি। দারুণ এক প্রতিভার কী নিদারুণ অপচয়!
করাচীর সেই স্মরণীয় হ্যাটট্রিক, টি-২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে তিন উইকেট নিয়ে পাকিস্তানকে খাদের মুখে ফেলে দেয়া, পার্থ টেস্টে দুর্দান্ত পারফর্ম করে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হওয়া, কলম্বোতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পাঠান ব্রাদার্সের শো কিংবা ব্যাট হাতে ওপেনিংয়ে নেমে ৯৩ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলা- আমাদের চোখে ইরফান মোমেন্টস তো কম নেই! বিদর্ভের ঘুপচি ঘর আর এঁদো গলি থেকে উঠে আসা ইরফান ভারতীয় ক্রিকেটের সেনসেশনে পরিণত করেছিলেন নিজেকে, তবে শেষ পর্যন্ত সঙ্গী হয়েছে বিশ্বজয় করতে না পারার আক্ষেপ। সেই ইরফান এখন কেবলই একজন ‘সাবেক ক্রিকেটার, বিদায়ের অনেক আগেই যিনি হারিয়ে গিয়েছিলেন স্মৃতির রাডার থেকে…