আজ কেবলই হাহাকার-শূন্যতা, আজ কেবলই হারানোর শোক!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
নেপোটিজমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি শুধু জেতেননি, নিজেকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যার অকাল বিদায়ে শূন্যতা তৈরি হয়ে গেছে। ইরফান খান দেখিয়েছিলেন, শুধু স্ক্রিপ্টে দম থাকলে হবে। বাকিটা আমিই দেখিয়ে দেবো!
সব সকাল একরকম প্রত্যাশিতভাবে শুরু হয় না। সব সকালে নবউদ্যম, নবজন্মের আভাস থাকে না। নবসূচনার ক্রিয়া থাকে না। কিছু কিছু সকাল অকস্মাৎ মৃত্যু-ধ্বংসও নিয়ে আসে। নিয়ে আসে তান্ডব৷ আচমকা ভেঙে যায় হৃদয়। আর ভাঙা হৃদয় নিয়ে শুরু হওয়া সকালের চাইতে ভারী কিছু কি এই পৃথিবীতে আছে? ইরফান খানের না ফেরার দেশে চলে যাওয়াও কি আজকের সকালটা কেমন জানি ভারী করে দিলো না? যা আমরা এখনো বয়ে চলছি।
ইরফান খান, অনেকে বলতো বলিউডের 'চতুর্থ' খান। যিনি বাকি তিন খানের চেয়ে যশ, খ্যাতি, অর্থ-বিত্তে যত পিছিয়ে ছিলেন, অভিনয়ের ভূমিকা ও কারিশমায় ঠিক তত এগিয়ে। তবে বলিউড ছাপিয়ে ইরফান খানের ভূমিকা ও সেই সাপেক্ষে আলোচনা আরো বিশাল ক্ষেত্রজুড়ে হওয়ার দাবী রেখেছে সবসময়। টম হ্যাংক্সের 'ইনফার্নো' কিংবা অস্কারজয়ী সিনেমা 'লাইফ অফ পাই' কিংবা ফারুকীর 'ডুব' কিংবা বচ্চনের 'পিকু', কোথায় নেই তিনি! যা করেছেন, নিজের ছাপটা আলাদাভাবে রেখেছেন।
শুধুই কি তাই? স্পিলবার্গের প্রজেক্ট, নোলানের 'ইনটার্স্টেলার' এ কাজ করার সুযোগ কিংবা 'বডি অফ লাইস' এ ডিক্যাপ্রিও-র সাথে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েও তিনি 'না' করেছেন। কারণ অন্য কোনো বলিউডের প্রজেক্টে তিনি কাজ করছিলেন, আর পেশাদারিত্বকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বিশ্বাস ও ওয়াদা তিনি ভাঙতে পারবেন না। অথচ এই লোকের তো মাটিতে 'পা' পড়ার কথা ছিল না, হাতছানি ছিল উপমহাদেশের অভিনেতা হয়ে একের পর এক মাইলস্টোনের এবং বলিউডে তৈরি হওয়া অপসংস্কৃতিকে মোক্ষম জবাব দেয়ার সুযোগ যে তারা দেখুক একজন ছাপোষা থিয়েটার করে বেড়ানো গডফাদারবিহীন অভিনেতা নিজেকে কোথায় নিয়ে গেছে! অথচ ইরফান খান, কতটা সাবলীল ছিলেন ও ছিলেন অহমিকাশূন্য। এতো কিছুর পরেও গ্ল্যামারহীন। অসাধারণত্ব যে সাধারণের মাঝে লুকিয়ে থাকে তা যেন ইরফান বারবার প্রমাণ করে গেছেন। ভাবুন একবার, তিনি যেভাবে উপমহাদেশ ও আন্তর্জাতিক সিনেমার মধ্যে ব্রিজ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন তা আর কে কিভাবে পেরেছিলেন হাল আমলে বা এর আগেও!
নাসিরউদ্দিন শাহ ভাবতেন, কমার্শিয়াল সিনেমাগুলোর প্রচন্ড প্রতাপে ইন্ডাস্ট্রিতে এই ছেলের টিকতেই তো কষ্ট হয়ে যাবে। অথচ আশেপাশের অনেকেই বুঝতে পেরেছিলেন, নাসিরউদ্দিন শাহ এর লিগ্যাসি যদি কেউ এগিয়ে নিতে পারে তবে তা একজন ইরফান খান-ই। এমনকি নাসিরউদ্দিনের স্ত্রী রত্না পাঠকও একই কথাই বলতেন। অথচ ভাগ্যের পরিহাস দেখুন, আজ তিন দশক পর এসে দাঁড়িয়ে আমাদের হয়তো ভাবতে হবে ইরফান খানের লিগ্যাসি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কেউ আর আসবে কিনা।
মুম্বাইয়ের বলিউড পাড়ায় অত্যাধিক নেপোটিজম, খান-কাপুর-চোপড়াদের রাজত্বের ভিড়ে কমার্শিয়াল সিনেমাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে কিছু স্বাধীনচেতা পরিচালক বা চরিত্র অভিনেতাদের দাঁড়িয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তাই অনেককে সাথে নিয়ে ইরফানের টিকে থাকার লড়াইটা ছিল চলমান। আজ সেই লড়াইয়ে তিনি শুধু জেতেননি, নিজেকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যার অকাল বিদায়ে শূন্যতা তৈরি হয়ে গেছে। ইরফান খান দেখিয়েছিলেন, শুধু স্ক্রিপ্টে দম থাকলে হবে। বাকিটা দেখিয়ে দেবো!
'পান সিং টোমার' এর কথা মনে আছে? সিনেমা দেখতে বসলে একপর্যায়ে আপনার মনে হবে, সূক্ষ্ম পর্দা ছাড়া আর কিছু নেই আপনার সামনে। আপনি বরং ইরফানের পাশেই বসে আছেন। সিনেমাটির পরিচালক তিগমাংশু ধুলিয়া একবার বলেছিলেন, ইরফানের সাথে কাজ করতে গিয়ে বারবার উপলব্ধি করেছি, তাঁর মতো অভিনেতা সমগ্র উপমহাদেশে আর জন্মাননি। অভিনেতা কে কে মেনন তো একবার জোর গলাতেই বলেছেন, আরেকজন ইরফান খান বানিয়ে দেখাও! আসলেই তো তাই। 'মকবুল' বা 'দ্যা নেমসেক' বা 'দ্যা লাঞ্চবক্স' এর মতো সিনেমা বলিউডে আসবে হয়তোবা, কিন্তু ইরফান খানের অতো কাউকে কি বলিউড আর জন্ম দিতে পারবে?
বিখ্যাত 'আনন্দ' সিনেমায় রাজেশ খান্না এক দৃশ্যে অমিতাভ বচ্চনকে উদ্দেশ্যে করে বলেছিলেন, 'বাবুমশাই! জীবন বড় হওয়া চাই, লম্বা নয়।' ইরফান খান যেন এই শিক্ষাটা দিয়ে গেলেন। যদিও এমন লোক কি কখনো আলাদাভাবে ভেবেছেন জীবনের প্রাপ্তি ও অবস্থান নিয়ে? হয়তো ভাবেননি। তাই হয়তো স্পিলবার্গের সাথে কাজ না করার জন্য এই লোকের মধ্যে কোনো আফসোস ছিল না। কিন্তু আমাদের কাছে রাজেশ খান্নার সেই ডায়লগের গুরুত্ব আছে, অন্তত ইরফানের জীবনের দিকে তাকালে তাই খুঁজে পাই। এজন্য আজকে আমরা তাঁর কীর্তি আঁকড়ে ধরে রেখেছি, তাঁর অভিনয়ের মুগ্ধতা আমাদের মস্তিষ্ককে কাতর করে তুলছে ভীষণভাবে। আজ কেবলই হাহাকার, শূন্যতা। আজ কেবলই হারানোর শোক।
ডাকাতের সর্দারে আপনার অভিনয় কাঁদিয়েছে, তো অসংখ্য সিনেমার ফাঁকে ফাঁকে আপনার সেন্স অফ হিউমার ও ড্রাই কমেডি হাসির রোল তুলেছে। অথচ আজ আত্মীয় বিয়োগের মতো ব্যাথা নিয়ে কেন এমন কিছু লিখে যেতে হচ্ছে? 'পিকু' বা 'কারওয়ান' বা 'কারিব কারিব সিঙ্গেল' এর জার্নিটা সত্যিই কি শেষ হয়ে গেল? বিশ্বাস করতে মন চাইছে না। ভালো থাকবেন প্রিয় ইরফান খান। আজও কেবল নামটাই যথেষ্ট, শত বিশেষণ নামটার ভারে মূল্যহীন।
আরও পড়ুন-