রিক্সাচালক, এইচএসসি পরীক্ষা, সবকিছু থাকুক নিউজফিডে, শুধু ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ইস্যুটাকে হারিয়ে যেতে দেবেন না। এই বসন্ত হারিয়ে গেলে গ্রীষ্মের প্রখর রোদে পুড়তে হবে আমাদের মেয়েদের, আমাদের বোনেদের...

একসময় বাংলাদেশ ছিল নদীমাতৃক দেশ। এখন হয়ে গেছে ইস্যুমাতৃক দেশ, টপিকের কোন অভাব নেই, পাবলিক বাসের মতো একটার পর একটা আসছে, যাচ্ছে। কয়েকদিন তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরব হচ্ছে, কয়েকদিন বাদেই আবার নতুন কোন ইস্যু এসে আগেরটাকে হাওয়ায় মিলিয়ে দিচ্ছে। টানা কয়েকদিন যেমন ধর্ষণ নিয়ে খুব প্রতিবাদ হলো, এর মাঝখানে গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দখল করে নিয়েছিল রিক্সাচালক ফজলুর রহমানের কান্না, আর আজ এইচএসসি পরীক্ষা না হবার সংবাদ। সব মিলিয়ে নিউজফিড থেকে ধর্ষণ অনেকটাই গায়েব হয়ে গেছে, স্থিমিত হয়ে গেছে আওয়াজ।

সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে যেদিন স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে আসা তরুণী গণধর্ষণের শিকার হলো, সেদিন ঘটনার ভয়াবহতায় আঁতকে উঠেছিল পুরো দেশ। স্বামীর সঙ্গেও যদি একজন নারী নিরাপদে না থাকে, তাহলে আর কোথায় থাকবে? ঘটনার সঙ্গে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নাম জড়িত থাকার ক্ষোভের মাত্রা আরও বেড়েছে, ক্রমাগত প্রতিবাদ আর সমালোচনার মুখে ভেস্তে গেছে আপোষ-রফাদফার পরিকল্পনা, পুলিশও তড়িৎ অ্যাকশন নিয়ে গ্রেপ্তার করেছে অভিযুক্ত পাষণ্ডগুলোকে। 

এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ফেসবুকে হাজির হয়েছে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে শ্লীলতাহানি করার ভিডিও। নিজেকে রক্ষার করার জন্য সেই নারীর আর্তচিৎকার প্রতিটা হৃদয়বান মানুষের বুকের গভীরে ধাক্কা দিয়েছে, আরও একবার প্রতিবাদে মুখর হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। রাত গড়ানোর আগে এক অভিযুক্ত গ্রেপ্তার হয়েছে, পুলিশ এবং র‍্যাব মিলে আটক করেছে ঘটনার মূল হোতা এবং আরও কয়েকজনকে। প্রতিবাদ গড়িয়েছে রাজপথে, অনেকদিন পরে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে আন্দোলন হচ্ছে এই দেশে। পুলিশের লাঠির বাড়ি, গ্রেপ্তার কিংবা হুমকি- কিছুই দমাতে পারছে না এই প্রতিবাদী ছেলেমেয়েগুলোকে। 

রাজপথে চলছে আন্দোলন

দুটো পয়েন্ট বলি। পয়েন্ট নাম্বার ওয়ান- একটা জিনিস কি খেয়াল করেছেন? গত কয়েকদিনে পত্রিকা বা টিভিতে প্রচুর ধর্ষণের খবর আসছে, স্বাভাবিকের তুলনায় যেটা দ্বিগুণ বা তিনগুণ হবে। নিজেকে একবার প্রশ্ন করুন, কেন। উত্তির হচ্ছে, আপনার, আমার, আর এই প্রতিবাদী তরুণ-তরুণীদের কারনে। দেশে প্রতিদিন গড়ে ১৭টা ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, নারী-শিশু-বৃদ্ধা এমনকি মাদ্রাসার ছাত্রও আছে এই নির্যাতিতের তালিকায়। যৌন নিপীড়ন বা নিগ্রহ তো আরও অনেক বেশি। মিডিয়া সব ঘটনাকে কাভারেজ দেবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্ত এখন দেশে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন চলছে, একটা পজিটিভ হাওয়া বইছে, আর তাই মিডিয়াও তুলে আনছে এসব নিপীড়নের খবর। 

পয়েন্ট নাম্বার টু- গত কয়েকদিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় পটেনশিয়াল রেপিস্টদের দৌরাত্ম্য একটু হলেও কমেছে। ধর্ষণের পরে যারা নারীর পোশাকের দিকে আঙুল তুলতো, ধর্ষিতা নারীর দোষ খুঁজে বের করার চেষ্টা করতো, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ফেসবুক কমিউনিটির কিছু শিক্ষিত মানুষ এক হয়েছে। এদের নোংরা বা আক্রমণাত্মক কমেন্ট, মেসেজ এবং এদের ফেসবুক একাউন্টের স্ক্রিনশট নিয়ে পোস্ট দেয়া হচ্ছে। 

আগে এরকম ঘটনায় কোন ফলাফল আসতো না, এখন আসছে। ছাত্রলীগের ময়মনসিংহ মেডিকেল শাখার এক নেতাকে ধর্ষণ নিয়ে বাজে মন্তব্য করার কারনে বহিস্কার করা হয়েছে সংগঠন থেকে, অজস্র পটেনশিয়াল রেপিস্ট নিজেদের আমলনামা ঢাকার জন্য আইডি ডিয়্যাক্টিভ করে রেখেছে ভয়ে। এই অমানুষগুলোর মনে এই ভীতির সঞ্চার করতে পেরেছি আমরা, এই অর্জনটা মোটেও খাটো নয়। দরকার শুধু আন্দোলন আর প্রতিবাদের এই স্রোতটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া, অন্য কোন ইস্যুর ভীড়ে এটাকে হারাতে না দেয়া। 

ধর্ষণের বিচারের দাবীতে রাস্তায় নেমেছে মানুষ

সারাদিন ভারতকে গালি দেই আমরা, রেন্ডিয়া নামে ডাকি, মনে রাখবেন, ভারতের মানুষ রাস্তায় নেমে, পুলিশের মার খেয়ে আন্দোলন করে দিল্লির তরুণী নির্ভয়ার বিচার নিয়ে ঘরে ফিরেছিল। আমরা কিন্ত এই জায়গায় ব্যর্থ, তনুর বিচার হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। এবার সিলেট বা বেগমগঞ্জের ঘটনাগুলোকে অন্তর কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। 

প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধীকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনা এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা দূর করা সহ নানা দাবীতে কিছু মানুষ রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছে। নারীর জন্য নিরাপদ শহর, নিরাপদ দেশ গড়াটাই তাদের লক্ষ্য। আপনি রাস্তায় এসে দাঁড়াতে না পারেন, ধর্ষকের বিরুদ্ধে মাঠে নামতে না পারেন, অন্তত ফেসবুকে বসেই নাহয় আওয়াজ তুলুন, আপনার যুদ্ধটা পটেনশিয়াল রেপিস্টদের বিরুদ্ধেই নাহয় হোক, তবু এই লড়াইয়ে শামিল থাকুন। ইস্যুটাকে হারিয়ে যেতে দেবেন না, এই বসন্ত হারিয়ে গেলে গ্রীষ্মের প্রখর রোদে পুড়তে হবে আমাদের মেয়েদের, আমাদের বোনেদের। তাদের জন্য সমাজ আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম- দুটো জায়গাই নিরাপদ করে গড়ে তুলতে হবে আমাদের, এই কথাটা ভুলে যাবেন না যেন...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা