ইতালির কান্ট্রি সিস্টেমকে কি এরা এখন 'পাক' করতে পারবে?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
একসময় গোটা পৃথিবী করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলবে, পৃথিবী উন্মুক্ত হয়ে যাবে আগের মতো, আমরা নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকব একটা কোণে, আমাদের কেউ ঢুকতে দিতে চাইবে না, সেটা আমাদের বদ স্বভাবের কারণেই ঘটবে, অন্য কারো দোষে নয়...
আগামী এক সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশ থেকে কোন বিমান ইতালিতে যেতে পারবে না- এই নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে ইতালীর সরকার। বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে যাওয়া একটি ফ্লাইটের কমপক্ষে একুশজন যাত্রীর শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়ার পরপরই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখনও ওই ফ্লাইটের সব যাত্রীর নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যায়নি, ধারণা করা হচ্ছে, করোনা পজিটিভ রোগীর সংখ্যাটা আরও বাড়বে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই যাত্রীদের প্রত্যেকের কাছেই কিন্ত দেশের নানা জায়গা থেকে সংগ্রহ করা করোনা পরীক্ষার নেগেটিভ সার্টিফিকেট ছিল!
ঢাকা থেকে রোমে যাওয়া সেই ফ্লাইটে মোট ২২৫ জন যাত্রী ছিলেন। এর মধ্যে অন্তত একুশজন করোনা পজিটিভ হিসেবে ধরা পড়েছেন। এখনো সবার পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যায়নি- এই তথ্য জানিয়ে লাৎসিও রাজ্যের (রাজধানী রোম ইতালির যে প্রদেশে অবস্থিত) স্বাস্থ্য কমিশনার আলেসিও ডি'আমাতো বাংলাদেশ থেকে আসা বিমানটিকে ভাইরাসবাহী বিধ্বংসী বোমার সঙ্গে তুলনা করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘‘আমরা সেই বোমাটিকে সফলভাবে নিষ্ক্রিয় করেছি৷''
একটা বিমানের এতজন যাত্রী করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন, যাদের প্রত্যেকের হাতেই নেগেটিভ সার্টিফিকেট আছে- এটা যে কি লজ্জার একটা ঘটনা, সেটা আমরা বুঝতে পারছি না হয়তো। কারণ জাতিগতভাবেই আমাদের লাজ-লজ্জা একটু কম। দুই-চার হাজার টাকার বিনিময়ে যে দেশে করোনাভাইরাসের নেগেটিভ সার্টিফিকেট বিক্রি হয়, ভুয়া নমুনা পরীক্ষা করে বড় বড় সব প্রতিষ্ঠান, তাদের মালিকেরা আবার মন্ত্রী-মিনিস্টারের সঙ্গে ছবি তুলে শো-অফ করে, সেদেশে এরকম কিছু অসম্ভব নয়।
কিন্ত ইতালির জন্য এটা বিস্ময়কর। এরকম কিছু যে ঘটতে পারে, সেটা তাদের ধারণাতে ছিল না। নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে বিমানে ওঠা এতজন যাত্রী পজিটিভ কি করে হলেন, সেই রহস্যভেদ করতে তাদের সময় লাগেনি। আর সেকারণেই সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে ইতালী ভ্রমণে এক সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে তারা। ইতালির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন গতকাল, ফ্লাইট বন্ধের খবরটা জানিয়ে মন খারাপ করেই লিখেছেন, 'সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও আমরা বাইরে থেকে সংক্রমণ আসা ঠেকিয়ে রাখতে পারছি না।'
পারবেন কি করে? আমাদের মতো অসভ্য, ইতর আর নির্লজ্জ লোকজন থাকলে দুনিয়ার কোন দেশই সংক্রমণ ঠেকাতে পারবে না। ভুয়া নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে কয়েকজন বাংলাদেশী জাপানে গিয়ে করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ প্রমাণীত হওয়ায় এর আগে জাপান সীমিত সময়ের জন্য বাংলাদেশী ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রেখেছিল। একই ঘটনা ঘটেছে চীনের সঙ্গেও। ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে চীনে ল্যান্ড করার পর দুই বাংলাদেশীর শরীরে পাওয়া গিয়েছিল করোনার অস্তিত্ব, ১৪ দিনের জন্য ফ্লাইট বন্ধ রেখেছিল চীনও।
ইতালিতে যারা নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়েও ধরা পড়েছে করোনা পজিটিভ হিসেবে, এই লোকগুলোকে জেলে ঢোকানো দরকার, এরা চোর, প্রতারক। আর কোন বিশেষণ এদের জন্য ব্যবহার করতে ইচ্ছে করছে না। টাকার বিনিময়ে ভুয়া নেগেটিভ সার্টিফিকেট জোগাড় করে যারা বিদেশে গিয়ে ধরা পড়ে দেশের জন্য 'বিরল সম্মান' বয়ে আনছে, এদের জন্য ভালো কোন শব্দ মাথায় আসে না।
এই লোকগুলোই ইতালিতে করোনা সংক্রমণের পিক টাইমে প্লেন ভাড়া করে দেশে ফিরে এসেছিলেন, আই ফাক বাংলাদেশ বলে গায়ের জোর দেখিয়ে কোয়ারেন্টাইন না মেনে বাড়ি চলে গেছেন, করোনা ছড়িয়েছেন। আর এখন বাংলাদেশ যখন করোনার সঙ্গে লড়াইটায় হেরে যাচ্ছে, তখন তারা ফিরছেন ইতালিতে, সুবিধাবাদী চামারের দল!
আর এসব যাদের দেখার কথা, তারা তো নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন সেই কবে থেকেই! স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপিরিচালক আর পরিচালকরা ব্যস্ত রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যানের সঙ্গে ছবি তুলতে, যে হাসপাতাল ছয় বছর ধরে লাইসেন্স ছাড়াই ব্যবসা করে আসছে, কোভিড-১৯ রোগীদের সেবা দেয়ার নাম করে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা, তারপর আবার সরকারের কাছে বিলও পাঠিয়েছে!
এর বাইরেও রিজেন্ট হাসপাতাল ভুয়া পরীক্ষার নামে যেভাবে খুশি সেভাবে রিপোর্ট বিলিয়েছে, পজিটিভ রোগীকে নেগেটিভ রিপোর্ট দিয়েছে, নেগেটিভকে দিয়েছে পজিটিভ! আর আমাদের সম্মানিত স্যারেরা এসব বাটপার লোকেদের পাশে দাঁড়িয়ে গদগদ হয়ে ছবি তোলেন। জনগনকে ঠকানো দুই নম্বুরী পয়সার ভাগটাও পান কিনা, সেই প্রশ্ন তুললাম না, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বলে একটা বস্তু তো আছে দেশে!
অথচ চাইলেই গোটা ব্যাপারটাকে একটা নিয়ম-নীতির মধ্যে রাখা যেতো। আইসিডিডিআর,বি বা এরকম কোন প্রসিদ্ধ সংস্থার মাধ্যমে দেশের বাইরে যেতে চাওয়া লোকজনকে পরীক্ষা করানো যেতো। নিয়ম করে দেয়া যেতো যে, বিদেশ গমনে ইচ্ছুক যাত্রীরা আইসিডিডিআর,বি ছাড়া অন্য কোথাও থেকে করোনা পরীক্ষা করালে সেটার ফলাফল কাউন্ট করা হবে না। তাহলেই টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট কেনার ব্যাপারটা ঘটতো না আর। নিউইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকায় এই ঘটনা নিয়ে এত বড় হেডলাইন দেখা লাগতো না। লজ্জায় মাথা হেঁট হতো না আমাদের। প্রয়োজন ছিল একটু সদিচ্ছার, কিন্ত সেই সদিচ্ছার যে বড় অভাব এদেশে!
এই যে ইতালি ফ্লাইট বন্ধ করলো, জাপান করেছে, চীন করেছে, সামনে আরও অনেক দেশ করবে। ভাবমূর্তি বলে কিছু যদি অবশিষ্ট থেকে থাকে, সেটার বারোটা বাজানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছি আমরা, দরকার, জনগন, সবাই মিলে। একসময় গোটা পৃথিবী করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলবে, পৃথিবী উন্মুক্ত হয়ে যাবে আগের মতো, আমরা নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকব একটা কোণে, আমাদের কেউ ঢুকতে দিতে চাইবে না, সেটা আমাদের বদ স্বভাবের কারণেই ঘটবে, অন্য কারো দোষে নয়...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন