জেসিন্ডা আরদার্ন ও নিউজিল্যান্ডের জাতীয় নির্বাচন: অসম্ভবকে সম্ভব করার গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ক্রাইস্টচার্চ হামলার পর তিনি মুসলমানদের বুকে টেনে নিয়েছেন, বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে নিউজিল্যান্ড করোনামুক্ত হয়েছে তার হাত ধরে। গতকাল জেসিন্ডা যে কীর্তি গড়লেন, সেটা নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসেই প্রথমবার ঘটলো। দেশটির জাতীয় নির্বাচনে...
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জেসিন্ডা আরডার্ন টানা দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হলেন। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জিতেছে তার দল লেবার পার্টি। ১২০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে জেসিন্ডার দল জিতেছে ৬৪টি আসনে। লেবার পার্টির এই জয়কে ধরা হচ্ছে ভূমিধ্বস বিজয় হিসেবে। কারন তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলের দেশ নিউজিল্যান্ডে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়াটা সবসময়ই চ্যালেঞ্জিং। জোট গড়ে, কিংবা স্বতন্ত্র সাংসদদের সমর্থন নিয়েই এখানে বেশিরভাগ সরকার গঠিত হয়। জেসিন্ডার এই জয় আরেকটা কারনে খুব স্পেশাল, এর আগে নিউজিল্যান্ডের কোন প্রধানমন্ত্রীই এক মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার পরে দ্বিতীয় মেয়াদে একক সসংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গড়তে পারেননি।
জেসিন্ডার যে নতুন ইতিহাস রচনা করতে যাচ্ছেন, এটা ভোটাভুটি শুরু হবার আগেই আন্দাজ করা গিয়েছিল। এমনকি ভোটদান শেষ হবার পরেও বুথফেরত জরিপে লেবার পার্টির জয়ের সম্ভাবনা প্রকট হয়ে উঠেছিল। বেশ উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটাররা তাদের নাগরিক অধিকারের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, ভোট দিয়ে বের হওয়া বেশিরভাগ মানুষই তাদের বর্তমাব প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ পেয়েছে গতকাল সন্ধ্যায়, তাতে সেই উচ্ছ্বাসের ছবিটাই ভেসে উঠেছে আরেকবার।
জেসিন্ডার এই বিরল সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা ভূমিকা রেখেছে, সেটা হচ্ছে করোনা মোকাবেলা। পুরো বিশ্ব যখন ক্ষুদ্র এই ভাইরাসের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে, রাশিয়া-আমেরিকা-ফ্রান্স-বৃটেনের মতো পরাশক্তিগুলো ভুগেছে, তখন নিজের দেশকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন জেসিন্ডা, নিয়েছেন সময়োপযোগী সব সিদ্ধান্ত। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে করোনাকে টাটা বাইবাই বলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে নিউজিল্যান্ড, টানা একশোদিন সেখানে নতুন কোন পজিটিভ রোগী সনাক্ত হয়নি। পুরো পৃথিবী যখন ঘর থেকে বের হতেও ভয় পাচ্ছে, নিউজিল্যান্ড তখন লকডাউন তুলে নিয়ে সবকিছু খুলে দিয়েছে।
এবছরের মে মাসে নিউজিল্যান্ড যখন নিজেদের 'করোনা ফ্রি কান্ট্রি' হিসেবে ঘোষণা করেছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত 'দ্য আটলান্টিক' ম্যাগাজিন একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল জেসিন্ডা আরদার্নকে নিয়ে। সেটার শিরোনাম দেয়া হয়েছিল- ‘পৃথিবীর সবচেয়ে উপযোগী নেতা’। মূলত করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে জেসিন্ডার লড়াইটাকেই ফোকাস করা হয়েছিল সেই লেখায়, বলা হয়েছিল, কিভাবে যথাসময়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে নিউজিল্যান্ডকে করোনার তাণ্ডব থেকে রক্ষা করতে পেরেছেন জেসিন্ডা এবং তার সরকার। যে পরীক্ষায় আমেরিকার মতো দেশ, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো নেতাও ডাহা ফেল মেরে বসেছেন, সেখানেই স্রোতের একদম বিপরীতে দাঁড়িয়ে করোনাভাইরাসকে হারানোর অসম্ভব এক যুদ্ধে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচনে সেই যোগ্যতারই পুরস্কার পেয়েছেন জেসিন্ডা।
করোনার বিপক্ষে এই লড়াইয়ে জেসিন্ডা বরাবরই নিজের চারপাশে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ লোকজনকে রেখেছিলেন, সরাসরি নেতৃত্ব দেয়ার বাহাদুরিতে তিনি যাননি, প্রতিটা জায়গাতে প্রশিক্ষিত এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে সীমান্তে কঠোর ব্যবস্থাপনা, বিদেশফেরতদের বাধ্যতামূলকভাবে কোয়ারেন্টিনে রাখা, ঝুঁকিতে থাকা সব মানুষের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসাদের লোকজনকে শনাক্ত করা- এসব ব্যবস্থার কারণেই নিউজিল্যান্ডে করোনা ঠেকানো সম্ভব হয়েছে।
ধাপে ধাপে লকডাউনের সময়সীমা না বাড়িয়ে জেসিন্ডার সরকার একেবারে এক মাসের লকডাউন পালনের অনুরোধ জানিয়েছে জনগণের কাছে। হ্যাঁ, অনুরোধ, আদেশ নয়। টেলিভিশন চ্যানেলের গুরুগম্ভীর ভাষণ নয়, এক সন্ধ্যেয় ঘরোয়া জামা পরে জেসিন্দা হাজির হয়েছেন ফেসবুক লাইভে, পরনে তখন মলিন একটা গাউন। এসেই বলেছেন, বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে এসেছেন, কিছু কথা বলতে চান জনগণের উদ্দেশ্যে- এই যে সিম্পলিসিটিটা, এটা আর কোন রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে?
একটা দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বোঝার জন্যে তার পূর্বসূরি, বা তার বিরোধীরা কি বলছে- সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকায় যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে করোনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য ধুয়ে দিয়েছেন বারাক ওবামা। অথচ নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক কিন্ত জেসিন্ডার প্রশংসায় পঞ্চমুখ! হেলেন বলছিলেন, ‘মানুষ বিশ্বাস করে, ও (জেসিন্ডা) কারো কাছে কোনোকিছু প্রচার করতে চাইছে না। তারা জানে, সবাই এখন এক ধরনের বিপদের মধ্যে আছে। আর বিপদের সময়ে প্রধানমন্ত্রী নিউজিল্যান্ডবাসীর পাশে আছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি জনগণের সম্পূর্ণ আস্থা আছে। জেসিন্ডা মানুষ হিসেবে প্রচণ্ড সহানুভূতিশীল, আর এজন্যই সব শ্রেণীর মানুষ তার ওপর ভরসা রাখতে পারে।’
জেসিন্ডার সহানুভূতিশীল আচরণ অবশ্য পৃথিবী আগেও দেখেছে। দুই বছর আগে ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে জঙ্গী হামলার সময়ও এই ভদ্রমহিলা ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। থাকাটাই স্বাভাবিক, যেভাবে আন্তরিকতা আর দরদ দিয়ে তিনি আক্রান্ত মুসলিমদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, পুরো জাতিকে এক সুতোয় গাঁথার চেষ্টা করেছিলেন, সেটা এক কথায় অনবদ্য। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি খ্রিস্টান ওই আততায়ীকে 'জঙ্গী' বলে সম্বোধন করেছিলেন, আক্রান্ত মুসলমানদের বলেছিলেন তারা তার 'ভাই'।
হামলার পরে নিউজিল্যান্ডের আতঙ্কগ্রস্ত মুসলিম কমিউনিটিকে নিজে গিয়ে স্বান্তনা দিয়ে এসেছেন তিনি, তাদের আশ্বাস দিয়েছেন, একজন নেটিভ শ্বেতাঙ্গের চেয়ে মোটেও আলাদাভাবে তাদেরকে দেখা হবে না। নিহতদের স্মরণে আয়োজিত শোকসভায় হাজির হয়েছেন মাথায় কাপড় দিয়ে, বুঝিয়ে দিয়েছেন, মুসলমানদের সঙ্গেই আছেন তিনি এবং পুরো দেশ। প্রধানমন্ত্রীর খোলস ভেঙে তিনি সাধারণের কাতারে নেমে এসে জড়িয়ে ধরছেন ক্ষতিগ্রস্থদের, একদিকে তাদের স্বান্তনা দিয়েছেন, আবার পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, অপরাধী শাস্তি পাবেই। কোমলতা আর কঠোরতার অসাধারণ এই মিশ্রণটাই জেসিন্ডাকে অনন্য করে তুলেছে। সেই অনন্যসাধারণ জেসিন্ডার কাছে হার মেনেছে করোনাভাইরাসের ভয়াবহতাও।
১৯৮০ সালে জন্ম জেসিন্দার, বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার, আর মা কাজ করতেন একটা স্কুলের ক্যাটারিং সার্ভিসে। ছোটবেলা থেকেই সংগঠনপ্রীতি ছিল জেসিন্দার, নেতৃত্বের গুণটাও সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছিল। ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াইকাটো থেকে ২০০১ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পরে রাজনৈতিক গবেষক হিসেবে যোগ দিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্কের অফিসে। মাঝে একবার ইংল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছিলেন, সেখানে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের অফিসে পলিসি অ্যাডভাইজর হিসেবে কাজ করেছেন বেশ কিছুদিন।
এরপর দেশে ফিরলেন, ততদিনে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে গিয়েছেন তিনি, তার খালা ছিলেন নিউজিল্যান্ড কেবার পার্টির নেত্রী, সেই দলেই যোগ দিয়েছিলেন জেসিন্দা। ২০০৮ সালে ছায়া সরকারের এমপি নির্বাচিত হলেন মাউন্ট অ্যালবার্ট থেকে, তখন তার বয়স মাত্র ২৮! সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ অবশ্য পাননি তখনও। সেই সুযোগটা এলো বছর নয়েক পরে, ২০১৭ সালে। সেই বছরটা অবশ্য জেসিন্ডার কাছে খুব অদ্ভুত ছিল।
২০১৭'র মার্চে লেবার পার্টির ডেপুটি চিফ হলেন, আগস্টে পুরো দলের দায়িত্বই এসে পড়লো তার কাঁধে। তারও আগে পার্লামেন্টের স্থায়ী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। দু'মাস পরে নির্বাচন, তার আগে দলের বেসামাল অবস্থা- সেখান থেকে বিরুদ্ধস্রোতে তরী বেয়ে দলকে সম্মানজনক একটা জায়গায় নিয়ে গেলেন তিনি, প্রচারণা চালালেন শহরে শহরে। দারুণ একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হলো তার, বিশ্লেষকেরা সেটাকে বর্ণনা করেছিলেন 'জেসিন্দাম্যানিয়া' নামে।
ভোটের ফলাফলে দেখা গেল, ১২০ টি আসনের মধ্যে জেসিন্দার দল লেবার পার্টি পেয়েছে ৪৬ টি আসন, যেটা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সরকার গঠনের জন্যে সেটা যথেষ্ট ছিল না। পরে কোয়ালিশন গড়ে ক্ষমতায় এলো লেবার পার্টি, জেসিন্দা বসলেন প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে। সেইসঙ্গে একটা রেকর্ডও হয়ে গেল, নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে কমবয়েসী প্রাইমমিনিস্টার তিনিই। বিশ্বের নারী প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যেও তিনিই সর্বকণিষ্ঠ।
একটু আগে যে জেসিন্ডাম্যানিয়ার কথা বলছিলাম, সেটা দিনকে দিন বেড়েছে ২০১৭ সালের পর থেকে। জেসিন্ডার জনপ্রিয়তার পারদ উঠেছে ওপরের দিকে। যে লেবার পার্টি আগের নির্বাচনে ৪৬টি আসন পেয়েছিল, কোয়ালিশন করে ক্ষমতায় এসেছিল, তারা এবার একা নির্বাচন করেই ৬৪টি আসনে জয় পেয়েছে, সরকার গড়তে কারো সাহায্য লাগবে না তাদের। এই জয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা তো জেসিন্ডার ইমেজেরই।
জেসিন্ডার বয়স মাত্র ৪০ বছর, খুব বেশি অভিজ্ঞ নন তিনি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দিক থেকেও হয়তো অনেক পিছিয়ে থাকবেন বিশ্বনেতাদের চেয়ে। কিন্ত মানুষের প্রতি মমতা আর ভালোবাসার বিশাল এক ভাণ্ডার বুকের ভেতর বয়ে নিয়ে চলেন জেসিন্ডা। আরও চার বছরের জন্য তিনি নিউজিল্যান্ডের শাসনভার হাতে পেয়েছেন, জনগনের ভোটে নির্বাচিত হবার মাধ্যমে। এই মমতা আর ভালোবাসার আরও শত শত নজির নিশ্চয়ই বিশ্ব দেখবে আগামী বছরগুলোতে...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন