জেসিন্ডা আরদার্ন: নিউজিল্যান্ডের করোনাজয়ে যিনি 'ম্যান অফ দ্য ম্যাচ'!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে করোনামুক্ত হয়েছে নিউজিল্যান্ড, আর এই সাফল্যের রূপকার হচ্ছেন সেদেশের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরদার্ন। কিন্ত কি এমন করেছেন জেসিন্ডা, যেটা আর কেউ করতে পারলো না?
চীন মুখোমুখি হয়েছে করোনার তাণ্ডবের, ইউরোপ-আমেরিকা শ্মশান হয়ে গেছে, ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ এমনকি ল্যাটিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলও ভুগছে এখন, এসব দেশে স্রোতের মতো বাড়ছে আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা। অথচ এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিউজিল্যান্ড কিনা বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে পুরোপুরি করোনামুক্ত হয়ে গেল! গত বিশ দিন ধরে নতুন করে কেউ সংক্রমিত হননি সেদেশে, আক্রান্ত সর্বশেষ রোগীটিও সুস্থ হয়েছেন, জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে গেছে সেখানে, খুলে দেয়া হচ্ছে সবকিছু। করোনার বিরুদ্ধে নিউজিল্যান্ডের এই তুমুল বিপ্লবে বড়সড় অবদান রেখেছেন যিনি, তার নাম জেসিন্ডা আরদার্ন, দেশটার প্রধানমন্ত্রী তিনি।
দুইদিন আগে নিউজিল্যান্ডকে করোনামুক্ত দেশ হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে এসে জেসিন্ডা হাসতে হাসতেই বলছিলেন, সবশেষ রোগীর করোনা টেস্টের রেজাল্ট নেগেটিভ আসার খবর শুনে তিনি আনন্দে একদফা নেচে ফেলেছেন। জেসিন্ডা নাচতেই পারেন, করোনার বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে একদম সামনে থেকে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশকে, বুঝিয়ে দিয়েছেন, নেতার কাজ শুধু বাগাড়ম্বর করা নয়, নিজের কাজ আর সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে নেতৃত্বের প্রমাণ দেয়াটাই নেতার দায়িত্ব।
গত সোমবার মধ্যরাত থেকেই নিউজিল্যান্ড থেকে লকডাউন তুলে নেয়া হয়েছে। সীমান্তে কড়া বিধি নিষেধ থাকলেও, দেশের ভেতরে চলাফেরায় নাগরিকদের জন্য কোনও নিষেধাজ্ঞা আপাতত থাকছে না। পঞ্চাশ লাখ জনসংখ্যার এই দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১১৫৪ জন। মারা গেছেন ২২ জন। গত ১৫ই মে'র পরে সেদেশে নতুন করে কেউ করোনায় আক্রান্ত হননি বলে জানানো হয়েছে দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে।
কড়া বিধি-নিষেধই যে নিউজিল্যান্ডের করোনামুক্তির প্রধান কারণ, সেটা এখন পরিস্কার। সরকারি তত্পরতায় দেশে করোনার প্রভাব ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারেনি। সেদেশের জনগনও সরকারের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েছে, মেনে চলেছে আইন-কানুন। টানা তিন মাস কঠোর লকডাউন আর প্রচুর পরিমাণে করোনা টেস্টের কারণে হাতে নাতে সুফল পেয়েছে এই ছোট্ট দেশ। এতসবের মাঝখানে তাহলে জেসিন্ডা আরদার্নের কৃতিত্বটা কোথায়?
করোনার বিপক্ষে এই লড়াইয়ে জেসিন্ডা বরাবরই নিজের চারপাশে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ লোকজনকে রেখেছেন, সরাসরি নেতৃত্ব দেয়ার বাহাদুরিতে তিনি যাননি, প্রতিটা জায়গাতে প্রশিক্ষিত এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে সীমান্তে কঠোর ব্যবস্থাপনা, বিদেশফেরতদের বাধ্যতামূলকভাবে কোয়ারেন্টিনে রাখা, ঝুঁকিতে থাকা সব মানুষের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসাদের লোকজনকে শনাক্ত করা- এসব ব্যবস্থার কারণেই নিউজিল্যান্ডে করোনা ঠেকানো সম্ভব হয়েছে।
ধাপে ধাপে লকডাউনের সময়সীমা না বাড়িয়ে জেসিন্ডার সরকার একেবারে এক মাসের লকডাউন পালনের অনুরোধ জানিয়েছে জনগণের কাছে। হ্যাঁ, অনুরোধ, আদেশ নয়। টেলিভিশন চ্যানেলের গুরুগম্ভীর ভাষণ নয়, এক সন্ধ্যেয় ঘরোয়া জামা পরে জেসিন্দা হাজির হয়েছেন ফেসবুক লাইভে, পরনে তখন মলিন একটা গাউন। এসেই বলেছেন, বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে এসেছেন, কিছু কথা বলতে চান জনগণের উদ্দেশ্যে- এই যে সিম্পলিসিটিটা, এটা আর কোন রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে?
ফেসবুক লাইভের সেই বক্তব্যে জেসিন্ডা বলেছেন, ‘নিজেকে একটি বাবলের মধ্যে রাখুন। পরিবারের সদস্য, অফিস সহকর্মী কিংবা যাদের ছাড়া আপনার চলবেই না তাদেরকে সেই বাবলের ভেতরে রেখে অন্য সব মানুষ থেকে দূরে থাকুন। এমন আচরণ করুন যেন আপনি ইতোমধ্যেই কোভিড-১৯’এ আক্রান্ত। তাই হাতেগোনা মানুষ ছাড়া বাবলের বাইরের কারো সঙ্গে মিশবেন না। বাবলের বাইরে গেলে আপনি বাকিদের মধ্যেও সংক্রমণ ঘটাবেন। তাই প্রিয়জনদের সুরক্ষার জন্য ঘরে থাকুন।’
গত দুই মাসে কয়েক দফায় ফেসবুক লাইভে এসেছেন জেসিন্ডা, দুঃখ প্রকাশ করেছেন অনাকাঙ্ক্ষিত এই পরিস্থিতির জন্য। সবাইকে বুঝয়েছেন, এই যুদ্ধটা কারো একার নয়, এখানে সবাইকে লড়তে হবে নিজ নিজ জায়গা থেকে, দৃঢ় গলায় জেসিন্ডা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসকে সমূলে ধ্বংস করাই তার লক্ষ্য- ‘ভাইরাসের সংক্রমণ কমানো নয়, আমাদের লক্ষ্য শূন্যে নিয়ে আসা। করোনাভাইরাসকে পুরোপুরি নির্মূল করা। এই কাজে আমরা সবাই সবাইকে সাহায্য করি আসুন। নিজ নিজ অবস্থানে থাকুন প্লিজ। এখন সবকিছু বন্ধ। অন্য কোথাও যেতে গিয়ে যদি রাস্তার মাঝখানে গাড়ি নষ্ট হয়, তাহলে সারানোর লোক পাবেন না। তখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে একা একা বিপদ হতে পারে।’
একটা দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বোঝার জন্যে তার পূর্বসূরি, বা তার বিরোধীরা কি বলছে- সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকায় যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে করোনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য ধুয়ে দিয়েছেন বারাক ওবামা। অথচ নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক কিন্ত জেসিন্ডার প্রশংসায় পঞ্চমুখ! হেলেন বলছিলেন, ‘মানুষ বিশ্বাস করে, ও (জেসিন্ডা) কারো কাছে কোনোকিছু প্রচার করতে চাইছে না। তারা জানে, সবাই এখন এক ধরনের বিপদের মধ্যে আছে। আর বিপদের সময়ে প্রধানমন্ত্রী নিউজিল্যান্ডবাসীর পাশে আছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি জনগণের সম্পূর্ণ আস্থা আছে। জেসিন্ডা মানুষ হিসেবে প্রচণ্ড সহানুভূতিশীল, আর এজন্যই সব শ্রেণির মানুষ তার ওপর ভরসা রাখতে পারে।’
জেসিন্ডার সহানুভূতিশীল আচরণ অবশ্য আমরা আগেও দেখেছি। দুই বছর আগে ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে জঙ্গী হামলার সময়ও এই ভদ্রমহিলা ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। থাকাটাই স্বাভাবিক, যেভাবে আন্তরিকতা আর দরদ দিয়ে তিনি আক্রান্ত মুসলিমদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, পুরো জাতিকে এক সুতোয় গাঁথার চেষ্টা করেছিলেন, সেটা এক কথায় অনবদ্য। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি খ্রিস্টান ওই আততায়ীকে 'জঙ্গী' বলে সম্বোধন করেছিলেন, আক্রান্ত মুসলমানদের বলেছিলেন তারা তার 'ভাই'।
হামলার পরে নিউজিল্যান্ডের আতঙ্কগ্রস্ত মুসলিম কমিউনিটিকে নিজে গিয়ে স্বান্তনা দিয়ে এসেছেন তিনি, তাদের আশ্বাস দিয়েছেন, একজন নেটিভ শ্বেতাঙ্গের চেয়ে মোটেও আলাদাভাবে তাদেরকে দেখা হবে না। নিহতদের স্মরণে আয়োজিত শোকসভায় হাজির হয়েছেন মাথায় কাপড় দিয়ে, বুঝিয়ে দিয়েছেন, মুসলমানদের সঙ্গেই আছেন তিনি এবং পুরো দেশ। প্রধানমন্ত্রীর খোলস ভেঙে তিনি সাধারণের কাতারে নেমে এসে জড়িয়ে ধরছেন ক্ষতিগ্রস্থদের, একদিকে তাদের স্বান্তনা দিচ্ছেন, আবার পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, অপরাধী শাস্তি পাবেই। কোমলতা আর কঠোরতার অসাধারণ এই মিশ্রণটাই জেসিন্ডাকে অনন্য করে তুলেছে। সেই অনন্যসাধারণ জেসিন্ডার কাছে হার মেনেছে করোনাভাইরাসের ভয়াবহতাও।
জেসিন্ডার বয়স মাত্র ৩৯ বছর, খুব বেশি অভিজ্ঞ নন তিনি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দিক থেকেও হয়তো অনেক পিছিয়ে থাকবেন বিশ্বনেতাদের চেয়ে। কিন্ত মানুষের প্রতি মমতা আর ভালোবাসার বিশাল এক ভাণ্ডার বুকের ভেতর বয়ে নিয়ে চলেন জেসিন্ডা, সেজন্যেই তিনি সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেয়ার তাড়না অনুভব করেন, যাতে তার বা সরকারের ভুলে একটা প্রাণও ঝরে না যায়।
জেসিন্ডা প্রমাণ করে দিয়েছেন, শুধুমাত্র যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমেই করোনার সংক্রমণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব, দেশ থেকে ভাইরাসটাকে গায়েব করে দেয়াও সম্ভব। আর সেকারণেই ৩৯ বছরের সাধারণ একজন নারী জেসিন্ডা আরদার্নকে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত 'আটলান্টিক ম্যাগাজিন' 'পৃথিবীর সবচেয়ে উপযোগী নেতা'র খেতাব দেয়, যে খেতাব ট্রাম্প-পুতিনরাও পান না!