জ্যাক মা খানিকটা ঘাড়ত্যাড়া। তার নীতি হল, সে যদি করতে পারে, আমিও পারব। সে কারা? বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট। কিংবা তারই সমসাময়িক জুকারবার্গ। জ্যাক মা পিতার রেখে যাওয়া সম্পদে বিলিয়নিয়ার হননি। তিনি সেলফমেড।
ছোটখাটো শরীর। দেখতে নায়কের মতো নন। চোখমুখ দেখতে বাচ্চাদের মতো। বেবী ফেইস। জীবনের শুরুটা ছিল ব্যর্থতায়। ভার্সিটিতে ভর্তি হতে গেলেন। মাসে দশ ডলার বেতন। সামান্য বেতন দেবার অবস্থা নাই। কিন্তু পড়তে হবে। দশ ডলারের জন্য চাকরি খুঁজতে গেলেন। ত্রিশবার জব এপ্লাই করলেন। রিজেক্ট করে দেওয়া হল। কেএফসিতে গেলেন। চব্বিশ জন ভাইভা দিল। তেইশজনকে নেওয়া হল। তাকে নেওয়া হল না। তিনবার চায়নায় ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির চেষ্টা করলেন। তিনবারই না করে দেওয়া হল। বলা হল- You are not good enough. দশবার হার্ভার্ডে এপ্লাই করলেন। দশবারই না। বিখ্যাত মানুষদের ব্যাপারে সত্য কম, মিথ বেশি। একটা মিথ আছে। তিনি হার্ভার্ড থেকে রিজেক্টেড হবার পর সংকল্প করলেন, একদিন এই হার্ভার্ডেই এসে পড়াবেন।
চায়নিজদের একটা বিশাল অংশ ইংরেজি জানে না। ভদ্রলোক সবার মতো হতে চাইলেন না। ইংরেজি শিখতে হবে। শেখা শুরু করলেন। ভাষা শেখার চাইতে মানুষকে ভাষার ক্যারিশমায় মুগ্ধ করা জরুরি। তাই দক্ষতা বাড়ানোর জন্য তিনি হয়ে গেলেন ট্যুর গাইড। আমেরিকান-ইউরোপিয়ানরা চায়নায় আসত। তিনি খুঁজে খুঁজে তাদের ট্যুর গাইডের কাজ শুরু করলেন। শিখে ফেললেন চমৎকার ইংরেজি। চাকরি শুরু করলেন।
আমেরিকা তাকে এতটাই তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্ম দিল, তিনি চায়নায় ফিরে আসলেন। একটা প্রতিষ্ঠানে পড়াতেন। প্রতিদিন সকালে একই রুটিন। ঘুম ভাঙ্গে। পড়াতে যান। পড়ান। আবার ঘরে ফিরে আসেন। ব্যাপারটা তিনি মেনে নিতে পারলেন না।চব্বিশজন কলিগকে বাসায় দাওয়াত করলেন। খাবার পর তাদের সামনে স্পীচ দিলেন। স্পীচের সারমর্ম হল- ব্যবসা করবেন। ব্যাপারটা অনেকটা দালালী ব্যবসা টাইপের। কাস্টমারদের পণ্য দিবেন। পণ্য হবে কোম্পানীর। তিনি মাঝামাঝি একটা কাঠামো দাঁড় করাবেন। এই কাঠামোর ভেতর দিয়ে ক্রেতারা পণ্য কিনবে। পণ্যের মূল মূল্য থেকে খুব অল্প একটা অংশ তারা পাবে। সাধারণ একটা তত্ত্ব। চব্বিশজনের মধ্যে তেইশজন সরাসরি ‘না’ করে দিল।
ভদ্রলোক থেমে গেলেন না। অল্প কয়েকজনকে নিয়ে একটা ওয়েবসাইট দাঁড় করালেন। এরপর শুরু হল নকল প্রোডাক্ট বিক্রি। নকল প্রোডাক্ট মানে খারাপ কিছু নয়। চায়না হল বিখ্যাত প্রোডাক্টদের (এপল, গুচি, নাইকি) ক্লোনিং এ দক্ষ। ব্র্যান্ডের প্রোডাক্টের ক্লোন কপি তাদের চেয়ে কেউ ভাল তৈরি করতে পারে না। এমন কিছু ক্লোন আছে যেগুলো মূল প্রোডাক্টের চেয়েও ভাল মানের কিন্তু দাম অল্প। এসব বিক্রি হত তার ওয়েবসাইট থেকে। ব্যাবসা দাঁড় করানোর পর সবাই সাফল্য পায় না। তিনিও পেলেন না।
সাফল্য তো পেতেই হবে। সাফল্য পাবার জন্য মরিয়া হয়ে কয়েকটা রুলস নিজের ভেতর ধারণ করলেন। ১। অন্যরা যখন ঘুম থেকে জাগে, তিনি তাদের আগেই জাগবেন। সবার চেয়ে দীর্ঘ সময় কাজ করবেন। ২। অন্যরা যা ভয় পায়, তিনি সেখানে সাহস দেখাবেন। রিস্ক নেবেন। সাধারণ দুটো ব্যাপার তিনি দিনের পর দিন অনুসরণ করলেন। প্রথম তিন বছর তার বিজনেস থেকে এক পয়সাও রেভিনিউ পেলেন না। বেতন আর খরচ করতেই সব লেভেল হয়ে যেত। এক পয়সায় হাতে থাকত না। কিন্তু তিনি থামলেন না। তার একমাত্র লক্ষ্য হলো- কোম্পানির কাছ থেকে কাস্টমারদের কাছে যাবেন না। কাস্টমার লেভেলে থেকে কোম্পানি থেকে প্রোডাক্ট আনবেন। কাস্টমারদের ইচ্ছেই সবকিছু। কাস্টমারদের স্যাটিসফ্যাকশন সবার আগে।
এবার শুরু হল রেভিনিউ। এত অস্বাভাবিক হারে তার ব্যবসায় লাভ হতে থাকল যে তাকে বলা হল- পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্রকায় ক্যারিশমাটিক ব্যক্তি। বিজনেসের সেরা সেরা ম্যাগাজিনে তার ছবি আসল। ফোর্বসে লেখা হল- পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষের একজন। ফরচুন লিখল- পৃথিবীর ৫০ জন গ্রেট লিডারের একজন। তার নাম ছিল- মা ইয়ুন। কঠিন নাম। উচ্চারণ করতে অসুবিধা হত বলে এক ট্যুরিস্ট তার নাম বদলে ডেকেছিল- জ্যাক। উপরের ক্যারিশমাটিক ‘মা ইয়ুন’ মানুষটির পুরো নাম হয়ে গেল- জ্যাক মা। তার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীর নাম- আলিবাবা গ্রুপ।
জ্যাক মা-র বিজনেস শুরুর সময়টা ছিল অদ্ভুত। একদিন তিনি ইন্টারনেটে চায়না সম্পর্কে সার্চ করছিলেন। অথচ কিছুই পাচ্ছিলেন না। ব্যাপারটা এখানেই থেমে যেতে পারত। কিন্তু থামেনি। তিনি বুঝে ফেললেন, ইন্টারনেট ব্যাপারটা ম্যাজিক্যাল। কাজে লাগাতে পারলেই ম্যাজিক ঘটিয়ে দেওয়া সম্ভব। স্ত্রী এবং এক বন্ধুকে নিয়ে ২০ হাজার ডলার দিয়ে কোম্পানি খুলেছিলেন। নাম রেখেছিলেন- চায়না পেইজ। তার কাজ ছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ওয়েবসাইট বানিয়ে দেওয়া। ব্যবসাকে ডিজিটালাইজেশন করে ফেলা। এটাই হল ই-কমার্স। তিন বছর রেভিনিউ শূণ্য প্রতিষ্ঠান তিন বছরের মাথায় রেভিনিউ পেল ৫০ লাখ ইউয়ান। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হল না। ১৬ বছরের মাথায় তার ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ দাঁড়াল ৩৯ বিলিয়ন ডলার। চায়নার দ্বিতীয় ধনী মানুষ।
ধনী মানুষরা খেয়ালি হোন। তিনি খেয়ালি নন। যার শুরু শূন্য থেকে, তার ব্যক্তিগত দর্শন হয় অন্যদের থেকে আলাদা। তিনি ফেন্সি কার, ইয়ট, হোম বিবিধ কিনতে শুরু করলেন। হংকং এ ১৯১ মিলিয়ন ডলারে বাড়ি কিনলেন। লাক্সারিয়াস জীবন যাপন শুরু করলেন। নায়কের মতো না হলেও জ্যাক মা নায়ক হয়েও, বেবী ফেইস নিয়েও তিনি একটা কুংফু মুভি করলেন। তার সাথে ছিল বিখ্যাত কুংফু অফিনেতা জেট লি। ব্যাপারটা তিনি বর্নণা করলেন তার মতো করে।
অর্থকে ইনভেস্ট করতে হয়। পরের জন্য, নিজের জন্যও। একজন লাক্সারিয়াস মানুষই পারে স্টক মার্কেটে বিশাল পরিবর্তন আনতে। টাকা নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি বেশ অদ্ভুত এবং পরিষ্কার। টাকার পেছনে ছুটতে হয় না। টাকা ছুটবে মানুষের পেছনে। মানুষ ছুটবে স্বপ্নের পেছনে। এটাই হল জ্যাক মা-র বিজনেস ইকোসিস্টেম। তার অর্থের পরিমাণ স্বাভাবিক চোখে অসীম। শেষ করবার মতো খরচের খাত নেই। মানুষ যখন মানুষের জন্য ইনভেস্ট করছে, তখন তিনি ইনভেস্ট শুরু করলেন সমুদ্রের পেছনে, পরিবেশের পেছনে।
আমেরিকাকে তিনি ভোলেননি। মজার ব্যাপার হলো, আমেরিকা তাকে তিক্ত অভিজ্ঞতা দিলেও তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমেরিকান বিজনেস মডেল পছন্দ করতেন। যেহেতু স্বতন্ত্র কিছু জন্ম দেবার আগে কাউকে ফলো করতে হয়, শুরুতে তিনি আমেরিকান বিজনেস মডেলকে ফলো করতেন। টেক দুনিয়ার স্বর্গ সিলিকন ভ্যালিতে কোম্পানি খুললেন। কিছু অস্পষ্ট ব্যাপারে সফল হলেন না। গুটিয়ে ফিরে আসলেন চায়নায়। তাই বলে কী আমেরিকা ভুললেন?
ঘাড়ত্যাড়া মানুষ সফল হয়। অতীতের সাথে তাদের চরম শত্রুতা। তাড়িয়ে তাড়িয়ে অতীতের প্রতিশোধ নিতে আনন্দ পান। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি টার্গেট করলেন আমেরিকাকে। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। করলেন ‘ডিল উইথ ডেভিল’। আমেরিকায় ব্যবসা সম্প্রসারণ করবেন। কৌশল হলো- তিনি ২০২১ সালের মধ্যেই আমেরিকায় দশ লক্ষ লোককে নিজের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিবেন। শুরু হলো কলম্বাসের পর দ্বিতীয় নন-আমেরিকানের আমেরিকা বিজয়। অথচ ততদিনে চায়নাতে তার প্রতিষ্ঠানে কর্মচারীর সংখ্যা ত্রিশ লক্ষ। হার্ভার্ড তাকে কাছে নেয়নি। সেই হার্ভার্ডই তাকে ডাকল স্পীচ দেবার জন্য।
সফল হতে সবাই চাই। জ্যাক মা নিজেও সফল। কিন্তু জানতেন সফলতার জন্য দরকার জ্ঞান। পড়ালেখা। ২০০৬ সালে তিনি বিজনেসে গ্রাজুয়েট করে ফেললেন। অথচ ততদিনে তিনি বিজনেস টাইকুন। বিলিয়নিয়ার। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ীদের একজন। যার আলিবাবা গ্রুপের অধীনেই আছে LAZADA (দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম ই-কমার্স মার্কেট। ভিয়েতনাম, মালোয়শিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড), South China Morning Post (হংকং কেন্দ্রিক ইংরেজি পত্রিকা। ২৬৬ মিলিয়ন মূল্যমান। উদ্দেশ্য পশ্চিমা পত্রিকাগুলোর নেগেটিভ প্রচারনার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। পত্রিকার জনপ্রিয়তা দিনদিন বাড়ছেই), AutoNavi (চায়নার ম্যাপ। এরা গুগলকে দশ বছর ধরে ইনফরমেশন প্রোভাইড করে। অ্যাপলের সাথেও সংযুক্তি আছে), TaoBao (অ্যামাজন, ই-বে এর মতই। অ্যামাজন এবং ই-বে চেয়ে এদের সেবা আলাদা । সেলার টু সেলার নীতির জন্য চায়নায় এখন তারা টপ চলে এসেছে), AliPay (পে-পালের মত। যাদের ইউজার সংখ্যা ৪০০ মিলিয়ন), Alibaba Pictures Group (চায়নার সবেচেয়ে বড় ইন্টারটেইনমেন্ট প্রতিষ্ঠান), Aliwangwang & Laiwang (চায়নার দ্বিতীয় বৃহত্তম রিয়েল-টাইম ইন্টারেকশন মেসেজিং সার্ভিস। সাধারণত সেলার ও কাস্টমারদের জন্য করা। wechat এর বাজার শিঘ্রই দখল করে ফেলবে), Ali Health Information Technology (হেলথ সার্ভিসের জন্য)।
জ্যাক মা খানিকটা ঘাড়ত্যাড়া। তার নীতি হল, সে যদি করতে পারে, আমিও পারব। সে কারা? বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট। কিংবা তারই সমসাময়িক জুকারবার্গ। জ্যাক মা পিতার রেখে যাওয়া সম্পদে বিলিয়নিয়ার হননি। তিনি সেলফমেড। প্রায়ই বলেন, ত্রিশের মধ্যে যদি ধনী হতে না পারো, এটা তোমার দূর্বলতা (If you aren’t rich by 30, It’s your fault)। বিখ্যাতরা অনেককিছু নিয়ে জন্মায় না। শূন্য থেকেই উঠে আসে। তাদের নায়কের মতো হয়ে জন্মাতে হয় না। তারা সমস্যা দেখে। কিন্তু কমপ্লেইন করে না। নিজে এগিয়ে গিয়ে নিজের কৌশলে সমস্যার সমাধান করে। যত সামান্য ব্যাপারই হোক। যে চিন্তাটায়, যে কাজটায় তারা সেরা, সেটার পেছনে লেগে থাকে। কচ্ছপের মতো।
সাফল্য তো আসেই। একদিনে না। একদিন একদিন করে অনেকগুলো দিন পর। শেষ সুযোগটাও শেষ সুযোগ নয়। শেষ দিনটাও শেষ দিন নয়। সুযোগ বারবার আসে। একটা দিন শেষ হলে আরেকটা দিন আসে। প্রতিটা দিনই চব্বিশ ঘন্টা। সেই সফল, যে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় নিজের জন্য ব্যয় করে। সবচেয়ে নিখুঁতভাবে ব্যয় করে।