জীবনের শেষ সিনেমা লক্ষ্মীর সংসারে তার সংলাপ ছিল- 'ভাই আজিমপুর যাবো কিভাবে?' সিনেমা মুক্তির এক মাসের মাথায়, মাত্র ৪১ বছর বয়সে মারা যান জাফর ইকবাল, তাকে দাফন করা হয় আজিমপুর গোরস্থানেই। কি কাকতালীয় ব্যাপার!

“হয় যদি বদনাম হোক আরো, আমি তো এখন আর নই কারো । অন্ধ গলির এই যে আঁধার বন্ধু হলো আজ আমার...” 

বাংলা সিনেমা “বদনাম” এর বিখ্যাত একটি গানের কয়েকটি লাইন দিয়ে লেখাটা শুরু করতে হলো। অথচ, গানটা যিনি গেয়েছেন তার ব্যাপারে বদনাম করবার সুযোগ নেই। বাংলা সিনেমার সাথে যারা একটু পরিচিত তারা হয়ত ধরে ফেলেছেন গানটির গায়ক কে। তিনি শুধু গায়ক নন, তিনি নায়কও। শুধু নায়ক বললে আসলে তার মাহাত্ম্য ঠিক বোঝা যাবে না। আশির দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়কদের একজন, কারো কারো মতে তিনিই সবচেয়ে জননন্দিত ছিলেন তখনকার সময়ে। তার অভিনয় তো বটেই, ফ্যাশনেও তিনি যোগ করেছিলেন এক ভিন্ন মাত্রা। তাকে বলা হতো তখনকার সময়ের ফ্যাশন আইকন। শুধু তা-ই নয়, তিনি ছিলেন বাংলা সিনেমার রাজপুত্তুর। 

বলছিলাম, তুমুল জনপ্রিয় ও অসংখ্য হিট সিনেমা ও গানের অলরাউন্ডার জাফর ইকবালের কথা। গানের ঘরে জন্ম তার। ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বরের ২৫ তারিখে ঢাকায় জন্মেছিলেন জাফর ইকবাল। বড় বোন প্রখ্যাত শিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহ। ভাই আনোয়ার পারভেজও সুপরিচিত শিল্পী। তাই গান তার রক্তে থাকবে এটাই হয়ত স্বাভাবিক। গানের প্রেমেই প্রথম পড়লেন জাফর ইকবাল। স্কুলে থাকতে গিটার শিখতেন, গিটারটা নাকি বেশ ভালো বাজাতে পারতেন। গান যদিও কারো কাছে শেখেননি। এলভিস প্রিসলির গান তাকে বেশ প্রভাবিত করেছিলো। গুনগুন করে প্রিসলির গান গাইতেন সারাক্ষণ। স্কুলের বিভিন্ন ফাংশনে ইংরেজি গান করতেন। মানুষটার গানের দিকে ঝোঁক যে কতটা তীব্র সেটা বোঝা যায় মাত্র ১৬ বছর বয়সে ব্যান্ড প্রতিষ্ঠার ঘটনায়। রোলিং স্টোন নামে ১৯৬৬ সালে গানের দল করেন জাফর ইকবাল। 

গায়ক থেকেই সুযোগ এলো নায়ক হবার। ১৯৬৯ সালের কথা। স্টেজে গান গাইছিলেন গায়ক জাফর ইকবাল। খান আতাউর রহমান বসে বসে দেখছিলেন একজন সুদর্শন সম্ভাবনাময় তরুণকে। চলচ্চিত্র পরিচালক খান আতার মনে ধরে জাফর ইকবালের মিষ্টি রোমান্টিক লুকের চেহারা।

-ফিল্মে অভিনয় করবে? 

হুট করে আসা সুযোগে কিছুটা অপ্রস্তুত জাফর ইকবাল। তবে সিদ্ধান্ত জানাতে দেরি করলেন না। 

-ইচ্ছে আছে। সুযোগ পেলে কেনো নয়? 

সেই বছরই সুযোগ এলো। “আপন পর” সিনেমায় প্রথম অভিনয়ের অভিষেক। ছবিতে তার নায়িকা ছিলেন কবরী। এই সিনেমার “যারে যাবি যদি যা” গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়। 

বোন শাহনাজ রহমতউল্লাহর সঙ্গে জাফর ইকবাল

তখন সময় উত্তাল। ঊনসত্তরের বছরটায় জাফর ইকবালের প্রথম ছবি মুক্তি পেলেও দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ছিলো থমথমে। ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিলো তা ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। আইয়ুব সরকারের পতনের দাবিতে সবাই রাস্তায় নেমে এসেছিলো। ঊনসত্তরের এই গণঅভ্যুত্থান ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা-পরবর্তীকালের সর্ববৃহৎ গণজাগরণ। ৬৯’ এর গনঅভ্যুত্থান এ পাকিস্থানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে বাঙ্গালির যে জনরোষানল সেটির প্রতিফলন ঘটেছে একাত্তরে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। 

জাফর ইকবাল ইংরেজি গান গাইতেন, গিটার বাজাতেন। চলনে বলনে ড্যাশিং একজন পুরুষ। তার উপর সিনেমার নায়ক। তবে মুক্তিযুদ্ধের শক্তি বোধহয় এটাই যে এই যুদ্ধ সব বাঙ্গালিকে এক সুতায় বেঁধে দিয়েছিলো। মনের কোথাও একটা তাড়না অনুভব করেছিলেন জাফর ইকবাল। হয়তো স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন দেশের মাটিতে মুক্ত বাতাসে গান গাইবেন, মুক্ত জগতে অভিনয় করবেন। তাই, দেশ স্বাধীন করতে মুক্তিযুদ্ধে যান জাফর ইকবাল। সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেন। কি অসাধারণ মানসিকতার অধিকারী ছিলেন নায়ক জাফর ইকবাল,একজন সত্যিকারের নায়কের ভূমিকা তিনি পালন করেছিলেন একাত্তরে। 

মানুষটা বোধহয় খানিকটা পাগলা ধরণের ছিলেন। সব কিছুতেই নিজের সর্বোচ্চটুকু দেয়ার পাগলামি ছিলো তার। অভিমানবোধ যেমন প্রবল, ভালবাসতেন তেমনি শতভাগ উজাড় করে। তার রোমান্টিকতার কথা সেসময়ের এক আলোচিত বিষয়। চিত্রনায়িকা ববিতার সাথে তার প্রেমের গুঞ্জন চিত্রপাড়ায় নাকি ওপেন সিক্রেটের মতো ছিলো। সবাই জানতো। আজহারুল ইসলাম খান পরিচালিত “অবুঝ হৃদয়” সিনেমায় “তুমি আমার জীবন” গানে ববিতার সাথে তার রোমান্টিক দৃশ্যগুলো ভীষণ আলোচনা আর সমালোচনার জন্ম দেয়। তবে, কানাঘুষা হলেও এই প্রেমের পরিণতি ছিলো না। ববিতা বিয়ে করেছেন তার পছন্দমতো। জাফর ইকবালও বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু, কোনো এক অজানা কারণে সংসার জীবনটা তার সাথে গেলো না। 

পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন ভীষণ অশান্ত। বোহেমিয়ান টাইপের হয়ে পড়েন জাফর ইকবাল। নিজের প্রতি ভীষণ অবহেলা তার। মদ্যপানের কথা শোনা যায়। শোনা যায় তার অনিয়মতান্ত্রিক জীবনের কথা। বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন জাফর ইকবাল। অল্প বয়সে বাঁধিয়ে ফেলেন দুরারোগ্য ব্ল্যাড ক্যান্সার। মাত্র ৪১ বছর বয়সে তিনি সংক্ষিপ্ত জীবন ত্যাগ করেন। তবে তার আগেই মাতিয়ে গিয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্রকে। 

ববিতার সঙ্গে তার জুটিটা তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল

তিনি যে সময়ের নায়ক, তখন বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালী সময়। তখন বাংলা সিনেমায় অভিনয় করতেন রাজ্জাক, ফারুক, আলমগীরসহ অসাধারণ সব হিরো। তাদের মধ্যে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই ব্যাতিক্রম কিছু করতেই হতো জাফর ইকবালকে। জাফর ইকবাল সেটি ভালো ভাবেই করতে পেরেছেন। নিত্য নতুন ফ্যাশন, রোমান্টিক আর স্যাডিস্ট লুক, অসাধারণ অভিনয় সব মিলিয়ে তিনি বাংলা সিনেমায় নতুন কিছু সংযোজন করতে সক্ষম হলেন। ফলাফল অসংখ্য হিট সিনেমা। জাফর ইকবাল-ববিতা জুটি তখনকার সময়ে বেশ জনপ্রিয় জুটি। এই জুটি একসাথে ত্রিশটির মতো সিনেমায় অভিনয় করেছে। প্রায় সবকটি সিনেমা দারুণ সফল ও আলোচিত হয় সেসময়। জাফর ইকবালের ক্রেজ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। প্রচুর নারী ভক্ত হয় তার। সবমিলিয়ে সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ারে দেড়শো’র মতো ছবিতে অভিনয় করেন তিনি।

অভিনয়ের পাশাপাশি করেছেন চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাকও। অসম্ভব সুন্দর কন্ঠের অধিকারী এই নায়ক উপহার দিয়েছেন অনেক জনপ্রিয় গান। এমনকি নিজের একটা গানের অ্যালবাম ও ছিলো তার। “কেন তুমি কাঁদালে” শিরোনামে জাফর ইকবাল নিজের অ্যালবামটি প্রকাশ করেছিলেন আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে গাওয়া তার একটি গান বেশ শ্রোতাপ্রিয়তা পায়। “সুখে থাকো নন্দিনী” টাইটেলের গানটার কয়েক লাইন লিরিকস বলি- 'সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী হয়ে কারো ঘরনী। জেনে রাখো প্রাসাদেরও বন্দিনী প্রেম কভু মরেনি...' 

তারপর আরো একটি গান গেয়েছিলেন, যে গানটি পরে শিল্পী রফিকুল আলমও গান। 'এক হৃদয়হীনার কাছে হৃদয়ের দাম কী আছে সে আছে নিজেকে নিয়ে আমি তো আপন দোষে পেলাম শুধু অথৈ যন্ত্রণা।' খুব সম্ভবত এই গানটিই জাফর ইকবালের কন্ঠে গাওয়া শেষ গান। গানটি প্রচার হওয়ার পর অনেক ভক্তের ধারণা হয়েছিলো ববিতার সাথে বিচ্ছেদের কারণে জাফর ইকবাল এমন গান গেয়েছেন। 

জাফর ইকবাল এর ব্যক্তিগত জীবনকে ঘিরে ভক্তদের আসলে কৌতূহলের কমতি ছিলো না। ভক্তদেরকে চূড়ান্ত কৌতূহলের মধ্যে রেখে নিজেই সব কৌতূহলের উর্ধে চলে যান। ১৯৯১ সালে। ২৭ এপ্রিলের এক মনমরা দিনে সবাইকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন মুক্তিযোদ্ধা, নায়ক, গায়ক, গিটারিস্ট সহ অসংখ্য গুণে গুণান্বিত এই সব্যসাচী মানুষটি। 

মৃত্যুর আগে জীবিত অবস্থায় তার শেষ ছবি ছিলো ”লক্ষ্মীর সংসার”। ছবির একটি দৃশ্য ছিলো এরকম- জাফর ইকবাল গ্রাম থেকে ঢাকায় নতুন এসেছেন। তার গন্তব্য ঢাকার আজিমপুর। তাই তিনি আজিমপুর যাওয়ার রাস্তা খুঁজছিলেন। ছবিটি মুক্তির এক মাসের মাথায় জাফর ইকবাল মৃত্যুবরণ করেন। তার লাশ আজিমপুরের গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস। বার বার মনে পড়ে যায় শেষ ছবিতে তার বলা “ভাই আজিমপুর যাবো কিভাবে” সংলাপটির কথা। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে যুগ থেকে যুগান্তর ধরে আপনি থাকবেন। আপনি থাকবেন মুক্তিযুদ্ধের গল্পে, থাকবেন গিটারের টুং টাং শব্দে, আপনাকে থাকতে হবে গানের সুরে, আপনি থাকবেন বাংলা সিনেমার বর্নিল ইতিহাসে। ভালো থাকুন সত্যিকারের নায়ক।

ছবি কৃতজ্ঞতা- ঢাকা ট্রিবিউন, ডেইলি বাংলাদেশ

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা