একজন অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাস দেশের জন্য আলো হয়ে ঠিকই জ্বললেন, অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিলেন, আর আমরা.. আমরা সামান্য নামফলকে তার অসামান্য নামটি লিখে রাখতে পারলাম না!

মাঝেমাঝে মনে হয় একটা মসৃণ ডাহুকের জন্য বাঁচি। রাতভর ডাকাডাকি।
মাঝেমাঝে মনে হয় রক্তিম শালুকের জন্য থাকি। থেকে যাই দিনমান খয়েরি ঝিলের পাশে।
মাঝেমাঝে ভাবি নেরুদা হিকমতের কবিতার জন্য বাঁচি। শতাব্দী প্রাচীন অতল ঘর।
মাঝেমাঝে মনে হয় থেকে যাই প্রিয় সিনেমার জন্য। বারিমান কুরোসাওয়া তারকোভস্কি।
মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় ‘দাস পার্টির খোঁজে’ যাই। দলে ভিড়ি। জগৎজ্যোতি দাস, আপনি কোথায়? 

ডাবল ডেকার বাসে করে রোজকার বাড়ি ফেরার পথে মাঝেমধ্যে চোখ পড়ত খিলগাঁও ‘কেএফসি’র সামনের খালি অংশটাতে। সেখানে অনেক বছর ধরে ছবিটি সাঁটানো ছিল। যখনই ছবিটিতে আমার চোখ পড়ত, টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত গালে। চোখ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে যেত। গলার স্বর আটকে যেত। বেদনায় হৃদয় কেবলই আর্দ্র হত। কয়েক মুহূর্ত আমি কথা বলতে পারতাম না। ঘন ঘন চশমার কাঁচ মুছতাম। পাশে বসা বন্ধুটি বলত– বড্ড অকৃতজ্ঞ আর ভুলোমনা জাতি আমরা!

একাত্তরে ঈদের দিনে রাজাকাররা এভাবেই জগৎজ্যোতির দেহ বেঁধে রাখে বিদ্যুতের খুঁটির সাথে

ছবিটি শহীদ জগতজ্যোতি দাসের, একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকি বাহিনী ও তাদের দোসররা জ্যোতিকে মেরে সুনামগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ বাজারে নিয়ে আসে। মুক্তিকামী মানুষের বুকে ভয় ধরাতে জনসন্মুখে তার লাশের উপর চলে মধ্যযুগীয় পৈশাচিক বর্বরতা। মুক্তিযোদ্ধাদের করুণ পরিণতি এলাকার মানুষকে দেখাতে ঈদের দিন তার মৃতদেহ বেঁধে রাখে বাজারের বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে।

কিন্তু কয়জন জানেন এই জগৎজ্যোতি দাস সম্পর্কে? তার ‘দাস পার্টি’ সম্পর্কে?

১৯৭১ সালে বৃহত্তর সিলেটের হাওর অঞ্চল দাপিয়ে বেড়ানো অসীম সাহসী গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা এক দল ছিল ‘দাস পার্টি’। এর কমান্ডার ছিলেন শহিদ জগৎজ্যোতি দাস। ৩৬ জন সাহসী যোদ্ধাদের এই গেরিলা দল নিয়ে হাজার পাকিস্তানী-রাজাকার বাহিনীর বুকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন জগৎজ্যোতি দাস। ‘দাস পার্টি’র যোদ্ধাদের নিয়ে জীবনকে তুচ্ছ করে একের পর এক গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করে জগৎজ্যোতি দেশকে অমর জ্যোতি উপহার দিয়েছিলেন। নিজের জীবন দিয়ে শক্রুমুক্ত করেছিলেন প্রাণের চেয়ে প্রিয় স্বদেশভূমি।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য সেক্টরের মতো কিন্তু ‘দাস পার্টি’র সমীকরণ খুব একটা সহজ ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্র ছিল ভাটি অঞ্চলে। দুর্গম, প্রতিকূল ও বিপদসংকুল অঞ্চল। সাহস, বুদ্ধিমত্তা আর দেশপ্রেম পুঁজি করে জগৎজ্যোতি দাস ও তার ‘দাস পার্টি’ প্রত্যন্ত এলাকাকে করে তুলেছিল তীর্থভূমিরূপে। একের পর এক তাদের সাঁড়াশি আক্রমণে ভিত কেঁপে উঠেছিল হানাদার বাহিনীর। অবশেষে ১৬ নভেম্বর ১৯৭১, দশ-বারো জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আর সামান্য গোলাবারুদ নিয়ে জ্যোতি তাড়া করেন রাজাকারদের। অদূরেই ছিল পাকিদের ক্যাম্প।

স্থানীয় রাজাকাররা কৌশলে তাদের সেখানে নিয়ে যায়। তারা আটকা পড়েন। নিমিষেই বুঝে যান যে, চক্রব্যূহ সৃষ্টি করে তাঁদের ফাঁদে ফেলা হয়েছে। তবু লড়াই করতে থাকেন বীরের বেশে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ম্যাগাজিন লোড করে শত্রুর অবস্থান দেখতে মাথা উঁচু করতেই মুহুর্তে শত্রুপক্ষের ১টি গুলি জগৎজ্যোতির চোখে বিদ্ধ হয়। মেশিনগান হাতে উপুড় হয়ে পাশের বিলের পানিতে ঢলে পড়েন জ্যোতি। শরীরজুড়ে স্প্লিন্টার বয়ে বেড়ানো জ্যোতি শেষ বারের মতো বলে ওঠেন– ‘আমি যাই গা…’। তারপরের ইতিহাস উপরের ছবিটি।

মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য মুজিবনগর সরকার প্রথম ব্যক্তি হিসেবে জগৎজ্যোতিকে মরণোত্তর সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ পদক প্রদানের ঘোষণা করে। এর প্রেক্ষিতে ‘স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র’, ‘আকাশবাণী’ তাঁকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ জগৎজ্যোতি দাস’ নামে প্রচার করে। পরবর্তীতে, স্বাধীনতার যুদ্ধে বিজয়ী বাংলাদেশে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাব পরিবর্তন করে তাঁকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। কেন এই খেতাব বদল, তার সুস্পষ্ট কোন কারণ জানা যায়নি। শহিদ জগৎজ্যোতি দাস ও তার দাস পার্টি বিষয়ে গবেষণামূলক বই লিখেছেন লেখক হাসান মোরশেদ। বইয়ের নাম ‘দাস পার্টির খোঁজে'। তিনি বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে যে, তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দিতে সম্ভবত এরকম ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু 'বীরশ্রেষ্ঠ' উপাধি পরবর্তীতে শুধু সামরিক অফিসাররাই পাবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়। তাই জগৎজ্যোতি দাসকে দেশ স্বাধীন হবার পরে 'বীর বিক্রম' উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লেখক অঞ্জলি লাহিড়ীর শিলঙের বাড়ীতে জগৎজ্যোতি ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় পেয়েছিলেন। এতো এতো মুক্তিযোদ্ধাদের ভিড়ে একজন কিশোর যোদ্ধার কথা তিনি কখনোই ভুলতে পারেননি। তাঁকে নিয়ে পরবর্তীতে লিখেছেন ‘জগৎজ্যোতি’ নামে একটি উপন্যাস।

তিনি বলেন, ‘এর আগে জগৎ ১৭ বার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসে। তার শরীরে কয়েকটি স্প্লিন্টারও ছিল। শেষবার যাওয়ার সময় সে আমার বাসায় আসে। এসে তারা কয়েকজন বলে– দিদি, খেতে দাও। পাকিস্তানি বার্জ আসছে। আক্রমণ করতে হবে। আমি তাকে বারণ করলাম। সে শুনল না। পরে আক্রমণে গিয়ে ধরা পড়ে জগৎ। তাঁকে মেরে মরদেহ আজমিরীগঞ্জ বাজারে একটি বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল।’

দেশ স্বাধীন হবার পর বর্তমান আজমিরীগঞ্জের নাম রাখা হয়েছিল ‘জগৎজ্যোতিগঞ্জ’। কিন্তু পরবর্তীতে ‘জগৎজ্যোতিগঞ্জ’ পরিবর্তিত হল ‘আজমিরীগঞ্জ’ নামেই। জগৎজ্যোতি মানে পৃথিবীর আলো। একজন অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাস দেশের জন্য আলো হয়ে ঠিকই জ্বললেন, অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিলেন, আর আমরা.. আমরা সামান্য নামফলকে তার অসামান্য নামটি লিখে রাখতে পারলাম না!

 

আমি আমার পূর্বপুরুষের নীল রক্তের ঋণ অস্বীকার করি
আমি সূর্যের মাথায় ঠ্যাকা বন্দুকের নল অস্বীকার করি
আমি অস্বীকার করি গণকবরের ভেতর থেকে গজিয়ে ওঠা একটি রক্তজবা
আমি অস্বীকার করি বর্ণিল বাগানের আশ্চর্য রকম সফেদ বিদ্রোহী মালিদের

আমি অস্বীকার করি ভায়ের মায়ের এতো স্নেহ চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা
আমি অস্বীকার করি শাপলা শালুক পদ্ম ঝিনুক হাওর বাওর বালুকাবেলা
নাবালক কবিতার গোটা ত্রিশেক পংক্তি আমি অস্বীকার করি
মেঘের জরায়ু ছিঁড়ে নামা জলের রংধনু আমি অস্বীকার করি

'প্রয়োজন নেই কবিতার স্নিগ্ধতা'
আমি ক্রমশ ভুলে যেতে ভালোবাসি
আমি অস্বীকার করতে ভালোবাসি…
তবু করাল রাতে সাহসী হয়ে ওঠে সহজাত আলিঙ্গন
তুফান তোলে বারবার, কণ্ঠে ভুখণ্ডে ঠিকই

"শুয়োরগুলো আলোয় এলে আঁতর মাখে
অন্ধকারে ভাগাড়জুড়ে শুয়োরই থাকে।" 
 

তথ্যসূত্র— 

  • দাস পার্টির খোঁজেঃ হাসান মোরশেদ
  • শিলং পাহাড়ের সেই বীরাঙ্গনাঃ শুভাশিস চক্রবর্তী, আনন্দবাজার পত্রিকা
  • শহীদ জগৎজ্যোতি দাসঃ অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার, একতা
  • ইতিহাসের বিস্মৃত এক মুক্তিযোদ্ধাঃ একেএম শামসুদ্দিন, যুগান্তর
  • আজমিরিগঞ্জের নাম 'জগৎজ্যোতিগঞ্জ' পুনর্বহাল করা হোকঃ পি.সি.দাশ.পীযূষ, সুনামগঞ্জের খবর

আরও পড়ুন- জগতজ্যোতি দাস: মুক্তিযুদ্ধের প্রথম বীরশ্রেষ্ঠ হবার কথা ছিল যার! 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা