গত চল্লিশ বছর ধরে একটানা ছয়শোরও বেশি বাঁশের সেতু বানিয়েছেন জাহিদুল ইসলাম। নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে পঞ্চাশ হাজার গাছ লাগিয়েছেন, কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা-মা'র পাশে আর্থিক সাহায্য নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। মানুষকে সাহায্য করার অদ্ভুত পাগলামি আছে তাঁর মধ্যে...

তিতুমীরের 'বাঁশের কেল্লা'র কথা তো আমরা সবাই পড়েছি। আমরা জানিও তাকে নিয়ে। তবে বাঁশের সাথে জড়িয়ে আছে বগুড়ার আরেকজন মানুষের নামও। তাকে দেশের অনেকেই চেনে। নিজের ঐকান্তিক অক্লান্ত শ্রমে মানুষের উপকারের জন্যে শয়ে শয়ে বাঁশের সেতু নির্মাণ করার এই কারিগরের নাম জাহিদুল ইসলাম। মানুষটির এই অভিনব উদ্যোগ ইতোমধ্যেই অজস্র মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে, আলোড়িত করেছে। মুগ্ধও করেছে। আজ জানা যাক এ মানুষটির গল্পই।

গত ৪০ বছর ধরে বগুড়ার বিভিন্ন এলাকার নদী, খাল-বিলে বাঁশের সেতু বানিয়ে যাচ্ছেন জাহিদুল। যখনই যেখানে খবর পেয়েছেন সেতুজনিত কারণে মানুষের দুর্ভোগের, সেখানেই হাজির হয়েছেন তিনি। পুরোনো একটা সাইকেল আছে তার। তিনি সেটি নিয়েই হাজির হয়ে যান। সেখানের মানুষদের সঙ্গে নিয়ে বাঁশ-কাঠ দিয়ে শুরু করেন সেতু বানানোর কাজ।

প্রশ্ন আসতে পারে, সেতু করতে যে টাকাপয়সা লাগে, সেগুলোর যোগান কে দেয়? দিচ্ছি সে প্রশ্নের উত্তরও। সেতু করতে যে টাকাপয়সা লাগে, সরঞ্জাম লাগে, যে কায়িক পরিশ্রম লাগে, সেগুলোতে জাহিদুলের সাথে গ্রামবাসীরা সঙ্গ দেন। সবাই মিলে একসাথে উৎসবমুখর পরিবেশে সেতু বানানোর কাজ করতে থাকেন। এভাবে করতে করতে এ পর্যন্ত তিনি ছয়শোরও বেশি বাঁশের সেতু নির্মান করেছেন!  এর মধ্যে তার বানানো অনেক জায়গায় বাঁশের সেতুর জায়গায় পরে পাকা সেতুও হয়েছে।

জাহিদুল শুধু যে বাঁশের সেতু বানিয়েই থেমে থাকেন, বিষয়টি তাও না। তিনি সমাজের নানা সমস্যার বিরুদ্ধেও নিয়মিত কথা বলেন। কাজও করেন। বাল্যবিবাহের বিপক্ষেও  সোচ্চার তিনি। ইউনিয়ন বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির সদস্যপদেও রাখা হয়েছে তাকে।কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা-মা'কে আর্থিক সাহায্য করারও যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। তাছাড়া তিনি গাছও লাগান। এ পর্যন্ত তিনি ৫০ হাজার তালগাছের চারা, ফলদ, বনজ ও ভেষজ গাছ লাগিয়েছেন। রাস্তার পাশে, স্কুলে,  খালি জমিতে... যেখানেই পেরেছেন, গাছ লাগিয়েছেন। সেই গাছও লাগিয়েছেন নিজের টাকাতেই। এভাবেই মানুষকে সাহায্য করে যাচ্ছেন তিনি। নিজের মত করে। নিজের উদ্যোগে।

একটা গল্প বলি। জাহিদুলের বয়স তখন বারো। বাড়ির পাশের খাল সাঁতার কেটে পার হয়ে স্কুলে যেতে হতো। একটা নড়বড়ে নৌকাও ছিলো খালে। পারাপার করা যেতো সেটাতেও। তবু খুব কষ্টকর ছিলো এ পারাপার। এলাকাবাসীরও খুব ঝামেলা হতো এই খাল পারাপারে। তখন কিছু বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে খালের উপর বাঁশের সেতু বানিয়ে ফেললেন জাহিদুল। তখন থেকেই শুরু। এরপরে সেতু বানানোর কাজ আর থামাননি। নানা কাজের মাধ্যমে মানুষের উপকার করতে পারলে ভালোই লাগে তার। মানুষকে সাহায্য করার জন্যে গাঁটের পয়সাও খরচ হয় মাঝেমধ্যেই। নিজে খুব স্বচ্ছল, তাও না। তবুও টাকাপয়সার বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না তিনি। কেউ ডাকলেই পুরোনো সাইকেল নিয়ে ছুটে যান সেই মানুষের কাছে।

পরিবারের তীব্র আর্থিক অনটনের জন্যে ক্লাস ফাইভের পরে আর পড়াশোনা করা হয়নি জাহিদুলের। সেই জাহিদুল ঘরের ছাগল, হাঁস, মুরগি বিক্রি করে গাছ কিনে লাগান রাস্তার পাশে, সেতু বানান, কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা-মা'কে সাহায্যের চেষ্টা করেন। ঘরের বাজারের টাকা দিয়ে অন্য কাউকে সাহায্য করেন। এরকমই পাগলাটে সাদা মনের মানুষ তিনি। সম্প্রতি হানিফ সংকেতের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান 'ইত্যাদি'তে ডাকা হয়েছিলো তাকে। উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছে মোটর সাইকেল। এই মোটর সাইকেল নিয়েই এখন তিনি ছুটে চলেন মানুষকে সাহায্য করার জন্যে। এই লেখাটি যখন লিখছি, পঞ্চাশোর্ধ এ মানুষটি হয়তো কোনো জায়গায় বাঁশের সেতু বানানোর কাজ শুরু করে দিয়েছেন আবার। কে জানে! হতেও তো পারে!

হানিফ সংকেতের 'ইত্যাদি'তে দেখা যাবে জাহিদুলকে অচিরেই!

এই মানুষগুলো আছে বলেই পৃথিবীটা এখনো  শান্তির, ভরসার বিশ্বাসের

শুভকামনা, বাঁশের সেতুর কারিগর।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা