আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শুধুমাত্র একজনই দুইবার বীরত্বভূষণ পদবী পেয়েছেন। তাঁর নাম জহুরুল হক মুন্সী, অসীম বীরত্বের নিদর্শন হিসেবে তিনিই পেয়েছেন এই বিরল সম্মাননা...

জহুরুল হক মুন্সী। বয়স কতই হবে, ১৯-২০! নারায়নগঞ্জ ডক ইয়ার্ডে কাজ করা সামান্য শ্রমিক। ১৯৬৪ সালে হঠাৎ কি খেয়াল হলো সে সামরিক প্রশিক্ষণ নিবে। যে ভাবা সেই কাজ। ডক ইয়ার্ড থেকে তিন মাসের ছুটি নিয়ে চলে গেল আনসার ক্যাম্পে। অবশ্য ছুটি নেয়াতে খুব একটা আর্থিক ক্ষতিও হয়নি। কারণ প্রশিক্ষণকাল তিন মাসে মাসিক পঁয়তাল্লিশ টাকা করে দেয়া হয় তাকে। পরের বছর ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় সেপ্টেম্বর মাসে আবার এক মাসের সামরিক প্রশিক্ষণ নেয় ছেলেটা। 

২৭ শে মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীরা নারায়নগঞ্জ দখল করতে এলে সামান্য ৩০৩ রাইফেল দিয়ে মুন্সীসহ আরো কিছু শ্রমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাকিস্তানিরা এরকম কিছুর জন্য তৈরি ছিল না বলে সেদিন নারায়নগঞ্জ ঢুকতে না পেরে পিছু হটে। পর দিন আরো সৈন্যসহ আসে নারায়নগঞ্জ দখলে। এবার আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার হওয়া এইসব ৩০৩ রাইফেলগুলো পাকিস্তানি আধুনিকতম অস্ত্রের মুখে পেরে উঠলো না। আর এ যুদ্ধে কোন পরিকল্পনাও ছিল না। যার ফলে সেদিনই নারায়নগঞ্জ দখল করে নেয় হানাদারেরা। জহুরুল হক মুন্সী সহ সকলেই পিছু হটে। 

১০ এপ্রিল মুন্সী নারায়নগঞ্জ ত্যাগ করে আড়াইহাজার চলে যান। সেখান থেকে ঘোড়াশাল ফ্ল্যাগ, শফিপুর, মাওয়া, টাঙাইল, জামালপুর,  বাকসিগঞ্জ হয়ে শত মাইল পায়ে হেটে ইন্ডিয়া পৌছে ১৪ই এপ্রিল। সেখানেই বিএসএফের কাছে নিতে থাকেন যুদ্ধ প্রশিক্ষণ। এপ্রিলের শেষদিকে একদিন জহুরুল হক মুন্সী সহ আরো কয়েকজন মিলে বিএসএফের চারটি জিপ নিয়ে বাংলাদেশের ভিতর টাঙাইল পর্যন্ত চলে আসেন। পথে ৭-৮টি ব্রিজ এবং অনেক যায়গার রাস্তা কেটে আবার ইন্ডিয়ায় ফিরে আসেন। 

২৯ এপ্রিল ইস্টার্ন আর্মি কমান্ডকে দায়িত্ব দেয়া হয় মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য সহযোগিতার জন্য। বিএসএফকেও ইস্টার্ন আর্মি কমান্ডের আন্ডারে নিয়ে আসা হয়। এখানে মুন্সী সহ আরো কিছু নির্বাচিত মুক্তিযোদ্ধাকে মাইন এবং বিস্ফোরক সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তারপর মুন্সীকে দায়িত্ব দেয়া হয় শেরপুরে মাইন বসানোর জন্য। আর এইসব মাইনের আঘাতে ব্যাপক আকারে ক্ষতি হয় পাকিস্তানিদের। সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে মুন্সীসহ আরো এগারো জনকে পাঠানো হয় তেলঢালায়। যেখানে মেজর জিয়াউর রহমান তার জেড ফোর্স গঠন করে। 

বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সী

১১ এপ্রিল লে.মাহবুবুর রহমানের দায়িত্বে মুন্সীসহ ১১ জনকে পাঠানো হয় গাইবান্ধার ঘাঘট নদীর স্লুইস গেট ধ্বংস করার জন্য। মুন্সীকে দেয়া হয় অন্য আরেকটা বেশি কাজ। মুন্সীর কাধে ৪০টি কলা, যার মধ্যে ৩০টিতে বিষ দেয়া আর বাকি ১০টিতে হালকা চুনের দাগ দেয়া দিয়ে পাঠানো হয়, যে করেই হোক এগুলো পাকিস্তানিদের কাছে বিক্রি করে আসার জন্য। মুন্সী কলাগুলো নিয়ে গেলে পাকিস্তানিরা সন্দেহ করলে মুন্সীকেও সেগুলো খেতে বলা হয়। পাক্কা অভিনেতাদের মতো করে মুন্সী বিভিন্ন যায়গা থেকে চুন দাগসহ কলাগুলো খায়। আর পাকিস্তানিদেরও সন্দেহ দূর হয়। তারা সবগুলো কলাই নিয়ে নেয়। টাকা চাইতে গেলে স্বভাবমত কয়েকটা লাথি দেয়া হয়। লাথি খেয়েও মুন্সী হাসিমুখে ফিরে আসে। সেদিনই সেই কলা খেয়ে প্রায় পঁচিশজনের মতো পাকিস্তানি সৈন্য মারা পরে। যদিও প্রধান অপারেশন স্লুইস গেটটা ধ্বংস করা যায়নি মজবুতি গঠন আর সঠিক স্থানে মাইন বসানো হয়নি বলে।

৯ ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার হারদেব সিং ক্লে তার তিন ব্যাটেলিয়ন ও আর্টিলারি এবং মুক্তিবাহিনী নিয়ে জামালপুর পৌছায়। এদিকে পাকিস্তানের কমান্ডার লে.কর্নেল.সুলতান মাহমুদ প্রায় পনেরশ সৈন্য, এক ব্যাটারি ভারি মর্টার ও ছয় পাউন্ডার গান নিয়ে জামালপুরে দুর্গ প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে। এ দুর্গ না সরিয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব। আর এর আগেই কামালপুরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে ব্রিগেডিয়ার ক্লে লে.কর্নেল সুলতান মাহমুদকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আহবান জানিয়ে চিঠি লিখেন। চিঠে নিয়ে কে যাবে, এ প্রশ্ন করায় কেউই হাত তুলেনি। এক ব্যতিক্রম ছিল জহুরুল হক মুন্সী। সে-ই চিঠি নিয়ে যাবে বলে হাত তুলে। একটা সাইকেলে সাদা পতাকা উড়িয়ে আর পকেটে আত্মসমার্পন এর চিঠি নিয়ে মুন্সী রওনা হয় পাকিস্তানি দুর্গের দিকে। 

ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিঠি নিয়ে এসেছে শুনেই পাকিস্তানিদের মাথা গরম হয়ে গেল। সাদা পতাকা দিয়ে তার চোখ বেধে, গামছা দিয়ে কোমর বেধে গাড়ির পিছনে বসিয়ে গাড়ির স্পেয়ার টায়ারের সাথে তাকে শক্ত করে বেধে সুলতান মাহমুদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এই চিঠি দেখে সুলতান মাহমুদ এতোটাই রেগে যায় যে সাথে সাথেই এলএমজির বাট দিয়ে জহুরুল হকের সামনের চারটা দাঁত ভেঙে দেয়। পরে বেয়নেট দিয়ে পুরো শরীরে আঘাত করতে থাকে। তারপরও যখন জহুরুল হক কিছুই স্বীকার করেনি, তখন তাকে উল্টো করে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দেয়। কিন্তু জহুরুল হক বরাবরের মত বলে আসে সে সামান্য কৃষক। সে চিঠির ব্যাপারে কিছুই জানে না। তাকে ভারতীয় সৈন্যরা গুলির ভয় দেখিয়ে এখানে পাঠিয়েছে। পরে পাকিস্তানিরাও বিশ্বাস করে তার কথা। 

সুলতান মাহমুদ মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করে তারা আত্মসমর্পন করবে না বলে চিঠি দিয়ে পাঠায়। বলে দেয় পরের বার যখন দেখা হবে তখন যেন ব্রিগেডিয়ার ক্লের হাতে স্টেন থাকে। মারের চোটে দেহটায় আর চলার মতও শক্তি ছিল না। তারপরও ভাঙা এই শরীরটা দিয়েই আস্তে আস্তে সাইকেলে করে মুন্সী যখন তার ক্যাম্পে পৌছায় তখন মাঝরাত। সবাই ধরেই নিয়েছিল তাকে এতক্ষনে মেরে ফেলা হয়েছে। এসেই নিজের স্টেনটা চায় এবং ব্রিগেডিয়ার ক্লে কে তার চিঠিটা দিয়ে হঠাৎই বলে বসে, কাল ১০ ডিসেম্বরের মধ্যেই জামালপুর স্বাধীন হবে। 

ছবিতেই লেখা আছে বিস্তারিত

ব্রিগেডিয়ার পানওয়ারের মতে পর দিন মানে ১০ ডিসেম্বর জহুরুল হক আর রক্তে মাংসের মানুষ ছিল না। যেন কোন দৈবশক্তি ভর করেছে তার উপর। কে বলবে মারের চোটে কাল রাতে এ ছেলেই হাঁটাচলা তো দূরের কথা, কথাই বলতে পারতো না ঠিকমত। আর এর ফলাফল হল মাত্র ২৩৫ টা পাকিস্তানি লাশ, ৬১ যুদ্ধবন্দি আর আহতাবস্থায় বন্দি আরো ২১ জন। জামালপুর স্বাধীনও হয় ডিসেম্বরের ১০ তারিখ। 

এই হচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সী(বীরপ্রতিক) (বার) এর কাহিনী। তাঁর নামের বীরত্ব ভূষণ পদবীর পর (বার) কেন? কোন যুদ্ধে কোন সৈন্য একাধিকবার কোন বীরত্বভূষণ পদবী পায়, তাহলে তার নামের শেষে বার যোগ হয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শুধুমাত্র একজনই সেই সম্মানের অধিকারী। আর তিনিই হলেন জহুরুল হক মুন্সী। ১৯৭৩ সালের গেজেটে তাকে দুইবার বীরপ্রতীক উপাধি দেয়া হয়। তার বীরপ্রতীক সনদ নাম্বার ৩৯১,এবং ৪০০। এখন কোথায় কেমন আছেন, জানা নেই। তবে শেষবার যখন তাকে নিয়ে পত্রিকায় পড়েছিলাম তখনো সবসময় শার্টের পকেটে বীরপ্রতীক মেডেলটা ঝুলিয়ে রাখতেন। আর বার বার তাতে হাত দিয়ে গর্ব করে বলতেন,

"আমারে সবাই খুব সম্মান করে, আমি বীরপ্রতীক না? আমারে তো হাইজেকারেও ধরে না, আমি বীরপ্রতীক বইলা।"


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা