জামায়াতে ইসলামী থেকে আমার বাংলাদেশ: নতুন খোলসে পুরনো সাপ!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
একাত্তর যদি এদের চেতনায় থাকে, এরা যদি জামায়াতের ছায়া থেকে বের হতেই চায়- তাহলে একই প্ল্যাটফর্ম থেকে দেইল্লা রাজাকারের মুক্তি কেন চাওয়া হয়- এই প্রশ্নের কোন জবাব আছে?
সাপের খোলস বদলানোর দৃশ্য দেখেছেন কখনও? না দেখলে এখন দেখে নিতে পারেন। জামায়াতে ইসলামী নামের একটা বিষধর সাপ ছিল এদেশে, বাংলাদেশের জন্মে বাধা দিয়েছিল যে দলটা। গত কয়ে বছরে যেটার বিষদাঁত ভেঙে দেয়া হয়েছে প্রায়। কিন্ত শক্তি সঞ্চয় করে সেই সাপ আবার ফিরে আসার চেষ্টায় রত, ছোবল বসানোর মিশন থামছে না তার। আদালতের রায়ে জামায়াত নিষিদ্ধ হবার পরে নতুন নামে, পুরনো নেতাকর্মীদের গায়ে 'সংস্কারপন্থী' ট্যাগ লাগিয়ে আবারও রাজনীতির মাঠে আত্মপ্রকাশ করেছে তারা! সাড়ম্বরে সংবাদ সম্মেলন করে গতকাল আমার বাংলাদেশ পার্টি বা এবি পার্টি নামের এই দলের ঘোষণা দিয়েছে জামায়াত এবং শিবিরের একঝাঁক নেতা।
গতকাল থেকেই শিবির এবং জামায়াত ভাবাপন্ন লোকজনের ফেসবুক ওয়ালে ঈদের আনন্দ চোখে পড়ছিল। তারা 'কোরআনের পাখি' দেলওয়ার হোসাইন সাঈদী, ওরফে দেইল্লা রাজাকারের মুক্তি দাবী করছিল 'আমার বাংলাদেশ পার্টি'র ব্যানারে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, নতুন এই প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক 'বহিষ্কৃত' জামায়াত নেতা মুজিবুর রহমান মঞ্জু। নতুন দলের নাম ঘোষণার পাশাপাশি ২২২ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটিও ঘোষণা করা হয়েছে গতকালের সংবাদ সম্মেলনে। এই দলে আহ্বায়ক হিসেবে আছেন জামায়াতে ইসলামী থেকে 'পদত্যাগকারী' এএফএম সোলায়মান চৌধুরী, যিনি একজন সাবেক সচিব। আর ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মঞ্জু এই কমিটির সদস্য সচিব।
খেয়াল করে দেখুন, ওপরের অনুচ্ছেদে বহিস্কৃত, এবং পদত্যাগকারী- এই দুটো শব্দকে কোটেশনের ভেতরে রেখেছি। কেন? জামায়াত এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির এমন একটা সংগঠন, যেখানে ঢোকার রাস্তা আছে, বের হবার পথ নেই। অন্তত ছাত্র শিবিরের সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করা একজন, বা মজলিশে শুরার কোন সদস্যকে জামায়াত কখনোই দল থেকে বহিস্কার করবে না। কারণ বছরের পর বছর ধরে এদেরকে গড়ে তোলা হয়, দলীয় আনুগত্যের সর্বোচ্চ পরীক্ষায় পাশ করেই এসব পদে স্থান পায় কেউ। এমন লোকজনকে জামায়াত ছেড়ে দেবে, তারাও নতুন পার্টি বানিয়ে ফেলবে- এসব রূপকথার গল্প প্রাইমারী স্কুলের বাচ্চাকে শোনালে তারাও হাসবে।
যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজ চলার একটা পর্যায়ে যখন জামায়াতের হাইকমান্ড মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকেও শাস্তি বা নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হবে- তখনই তারা বিকল্প প্ল্যান সাজিয়ে রেখেছে। জামায়াত সাধারণ কোন রাজনৈতিক দল না, এই দলের গঠণতন্ত্র আওয়ামী লীগ বা বিএনপির চেয়ে অনেক বেশি মজবুত। যে কেউ চাইলেই জামায়াত বা শিবিরে যোগ দিয়ে নেতা হয়ে যেতে পারবে না। এখানে পরিবারতন্ত্র বা তোষেমোদির জায়গা নেই, পরিস্কার আনুগত্যের প্রমাণ দিয়েই উঠে আসতে হয় ওপরের ধাপে। একটা মাফিয়া সংগঠনের মতোই সুগঠিত এরা, প্রথাগত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জামায়াতকে মেলানো যাবে না।
শিবিরের সমর্থক এবং কর্মী বাছাইয়ের শুরুটা হয় একদম রুট লেভেলে। স্কুল-কলেজের বাচ্চাদের ধর্মের নামে ব্রেইনওয়াশ করানো হয়, ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়ুয়া ছেলেদের ফুলকুঁড়ি আসরে গান বা আবৃত্তি শেখানো, কিশোর কণ্ঠ পড়তে দেয়া, ধর্মীয় বইয়ের পাশাপাশি জামায়াতের আধ্যাত্মিক নেতা আবুল আলা মওদূদীর বই পড়ানোর মাধ্যমে তাদেরকে দলে টানার চেষ্টা শুরু হয়। অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল ছাত্রদের এরা সাহায্য করে, মেধাবী ছাত্ররা থাকে এদের প্রাইম টার্গেট। স্কুলজীবনে এসব খুব কাছ থেকে দেখেছি, এদের সঙ্গে মিশেছি, খেলেছি, সময় কাটিয়েছি- তাই তাদের কৌশল সম্পর্কে বেশ ভালোই ধারণা আছে।
এখন সাবেক শিবির সভাপতি মঞ্জু এবং সাবেক মজলিশে শুরার সদস্য সোলায়মান সাহেবের গড়া দল নিয়ে যদি আপনার আপত্তি না থাকে, এদেরকে জামায়াতের চেয়ে আলাদা কিছু বলে যদি ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিতে চান- তাহলে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন, নয়তো জামায়াতের এই নতুন রূপটাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঢুকতে দেয়াত পক্ষপাতী আপনি।
সংবাদ সম্মেলনে শিবিরের সাবেক সভাপতি মঞ্জুর কথা শুনে হাসি পেলো। তিনি বলেছেন- “আমরা মনে করি, একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিজয় আমাদের জাতীয় ঐক্যের অন্যতম পাটাতন। এবি পার্টি সেই পাটাতনকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে বদ্ধ পরিকর।” শিবির সভাপতির মুখে মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর- এসব শোনা আর ভূতের মুখে রাম নাম শোনার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। একাত্তর যদি এদের চেতনায় থাকে, এরা যদি জামায়াতের ছায়া থেকে বের হতেই চায়- তাহলে একই প্ল্যাটফর্ম থেকে দেইল্লা রাজাকারের মুক্তি কেন চাওয়া হয়- এই প্রশ্নের কোন জবাব আছে?
আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, জামায়াতের নেতা ব্যারিস্টার তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার যোবায়ের আহমদ ভুঁইয়া, ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদসহ বেশ কয়েকজন এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল। এরা প্রত্যেকে যুদ্ধাপরাধীদের হয়ে মামলা লড়েছে, নিজামী-মুজাহিদ-সাঈদীদের নির্দোষ হিসেবে দাবী করেছে, ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কলঙ্কৃত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। এবং এরা কেউ কিন্ত জামায়াত থেকে পদত্যাগ করেনি। নতুন দলকে শুভকামনা জানানোর জন্যে এদের আসার কারণ খুঁজতে গভীরে যেতে হবে না নিশ্চয়ই!
এসব বহিস্কার, পদত্যাগ, নতুন দল গঠন করা- এই নাটক করে লাভ নেই। যে দলটা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছিল, বাংলাদেশের জন্মে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের কাফের আখ্যা দিয়ে তাদের 'কতল' করার মিশনে নেমেছিল, বুদ্ধিজীবি হত্যায় সরাসরি যুক্ত ছিল, লাখ লাখ শহীদের রক্ত আর লাখো বীরাঙ্গনার আর্তনাদে যাদের হাত রঞ্জিত হয়েছে- তারা নাম পাল্টে এলেও কি নিজেদের রূপটা বদলে আসতে পারবে? খোলস বদলালে সাপ তো আর টিকটিকি হয়ে যাবে না, সাপই থাকবে। সেই সাপ ছোবল দেয়ার আগেই তার বিষদাঁত ভেঙে দেয়াটা যে জরুরী, সেটা সরকারের বোঝা উচিত।
পাদটীকা- একাত্তরের মাস্টারমাইন্ড, সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী এবং সাবেক জামায়াত নেতা গোলাম আজমের লেখা একটা বইয়ের নাম হচ্ছে আমার বাংলাদেশ। সেই বই থেকেই সম্ভবত নতুন এই দলের নামটা ধার নেয়া হয়েছে। তবে এবি পার্টির পুরো নাম আসলে হওয়া উচিত ছিল আল বদর পার্টি- একাত্তরের সাথে সেটাই সবচেয়ে মানানসই হতো। অথবা আবার বানাবো পাকিস্তান, কিংবা অ্যান্টি বাংলাদেশ পার্টি- এটাও খারাপ হতো না। জামায়াতের আসল এজেন্ডা তো বাংলাদেশের বিরোধিতা, দেশকে পাকিস্তান বানানোই...
ফিচার্ড ইমেজ কৃতজ্ঞতা- পাশা