মাহফুজ আনাম জেমস- আমাদের দুর্বার তারুণ্যের দুরন্ত উচ্ছ্বাস!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
পড়ালেখায় মনোযোগ ছিল না, তাই বাবা বের করে দিয়েছিলেন বাড়ি থেকে, ঠাঁই হয়েছিল আজিজ বোর্ডিংয়ে। রাগী সেই ভদ্রলোক জানতেন না, অনেক বছর পরে গিটারে ঝংকার তুলে তার 'বখে যাওয়া' ছেলেটা গাইবে- বাবা কতদিন, কতদিন দেখি না তোমায়!
হ্যাংলা একহারা গড়ন ছেলেটার, ক্লাস নাইনে পড়ে, বয়সের তুলনায় খানিকটা লম্বা। দুচোখের সীমানায় গোপন কিছু স্বপ্ন উড়ে বেড়ায় সারাক্ষণ, একপলক তাকিয়েই বোঝা যায়, মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অগ্নিকুণ্ডের খানিকটা আভা সেই চোখে জ্বলছে। বাবা চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান, আর তার ছেলে নিয়মিত পরীক্ষায় গোল্লা নিয়ে বাসায় ফেরে। ক্লাসে মন নেই, পড়ালেখায় তীব্র অনীহা, পরীক্ষার আগের রাতে বন্ধুর বাসায় লুকিয়ে রাখা গিটার নিয়ে গান গাইতে ছুটে যাওয়া- বাবা বুঝে গেলেন, এই ছেলেকে দিয়ে আর যা’ই হোক, পড়াশোনা অন্তত হবে না।
মেজাজী ওই ভদ্রলোক রাগের মাথায় ছেলেকে বের করে দিলেন ঘর থেকে! তাতে ছেলে যে বাবার ওপর খুব অভিমান করেছিল, এমনটা বলা যাবে না। বাবা জানতেন না, অনেকগুলো বছর পরে, ছেলেটা তখন পরিপূর্ণ যুবক, দেশের কোটি মানুষ তাকে চিনবে, গিটারে ঝংকার তুলে সে গাইবে- “বাবা কতদিন কতদিন দেখি না তোমায়!” সেই ছেলেটার নাম জেমস, মাহফুজ আনাম জেমস- ভক্তরা যাকে ভালোবেসে গুরু বলে ডাকে!
বাবাকে কখনও সেই গানটা শোনাতে পারেননি জেমস, বাবা ততদিনে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ঘর ছাড়ার পরে এসে উঠেছিলেন আজিজ বোর্ডিং- এ, ‘ফিলিংস’ নামের একটা ব্যান্ডের হয়ে পারফর্ম করতেন তখন। বোর্ডিঙের বারো ফিট বাই বারো ফিটের ছোট্ট একটা কামরায় চাষবাস হতো গানের, সেখানেই জন্ম হতে লাগলো বাংলাদেশের সঙ্গীত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় তারকাদের একজনের।
জেমসের ক্যারিয়ারে এই আজিজ বোর্ডিঙের অবদান অনেক, এই মধ্যবয়সেও জেমস স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন সেই দিনগুলোর কথা ভেবে। গান লেখা হচ্ছে, কোরাসে গান গাইছেন দলের সদস্যেরা, বোর্ডিঙের কামরা ঢেকে যাচ্ছে সস্তা সিগারেটের ধোঁয়ায়- রাতে নাইটক্লাবে গানের অনুষ্ঠান, কি কি গাওয়া হবে সেগুলোরই রিহার্সেল চলছে, আর এরমধ্যেই সময় গড়িয়েছে প্রকৃতির নিয়মে, নিজের অজান্তে বেড়ে উঠেছেন তিনি।
আশির দশকের মাঝামাঝিতে ঢাকায় চলে এলেন সাগরপাড়ের শহরটা ছেড়ে, সেটাও সঙ্গীতের টানেই। ছিয়াশিতে প্রথম অ্যালবাম ‘স্টেশান রোড’ প্রকাশিত হলো, কিন্ত খুব বেশী সাড়া পেল না সেটা। পরের বছর আসিফ ইকবালের লেখা গান নিয়ে বের করলেন নিজের প্রথম একক অ্যালবাম ‘অনন্যা’। প্রত্যেকটা গানই শ্রোতাপ্রিয় হলো, বিশেষ করে ‘অনন্যা’ আর ‘ওই দূর পাহাড়ে’ গানগুলো ঘুরে ফিরতে শুরু করলো লোকের মুখে মুখে।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সালে ‘জেল থেকে বলছি’ অ্যালবাম দিয়ে সঙ্গীতাঙ্গন মোটামুটি কাঁপিয়ে দিলেন জেমস। লতিফুল ইসলাম শিবলীর লেখা আর জেমসের ভরাট গলায় গাওয়া গানগুলো লুফে নিলো সবাই, বস্তি থেকে পাঁচতারা হোটেল- সব জায়গায় শুধু জেমসের গান! নন মেটালিক গানগুলো যে এত জনপ্রিয়তা পাবে, সেটা ভাবেনি কেউই। ১৯৯৫’ তে এলো ‘প্রিয় আকাশী’, এই গানটা ছিল সেই সময়ের তরুণদের কাছে নেশার আরেক নাম।
এরপরের গল্পটা এগিয়ে যাওয়ার, একটার পর একটা হিট গান উপহার দেয়ার, নতুন নতুন মাইলফলক তৈরী করার। ‘মীরা বাঈ’, ‘পাগলা হাওয়ার তোড়ে’, ‘যদি কখনও ভুল হয়ে যায়’ ‘মা’, ‘বাবা’ কিংবা ‘ফুল নেবে না অশ্রু নেবে বন্ধু’, ‘বাংলাদেশ’ অথবা লাকী আখন্দের লেখা ও সুরে ‘লিখতে পারি না কোন গান’- এসবে তখন বুঁদ হয়ে আছে তরুণ প্রজন্ম। এরমধ্যে নিজেদেরকে বিশুদ্ধবাদী দাবী করা একদল বলতে শুরু করলো, ব্যান্ডসঙ্গীতের নামে জেমস বাংলা গানের ধরণটাকেই নষ্ট করে দিচ্ছেন! তাদের জন্যেই সম্ভবত তিনি নিয়ে এলেন শামসুর রাহমানের ‘সুন্দরীতমা’ কবিতা থেকে- ‘আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেবো’, এই এক গানেই ভেসে গেল সমালোচনার বালির বাঁধ। এর মাঝে ‘দুঃখিনী দুঃখ করো না’ দিয়ে সবাইকে মাতালেন আবার।
তারপর ভাটা পড়লো ক্যারিয়ারে। জনপ্রিয়তার হাত ধরেই নাকি বিতর্ক আসে, জেমসও বিতর্কে জড়ালেন। ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে নানা ঝামেলায় গানবাজনা থেকে দূরে ছিলেন বেশ কিছুদিন। এরপর ফিরলেন, তবে দমকা হাওয়াটা বাংলা নয়, হিন্দি গান দিয়েই নিয়ে এলেন জেমস। গ্যাংস্টার সিনেমার 'ভিগি ভিগি' গানটা আলোড়ন তুলেছিল বলিউডে, টপচার্টে শীর্ষেও ছিল অনেকদিন। এরপরেও সেখানে প্লেব্যাক করেছেন, লাইফ ইন এ মেট্রো সিনেমায় তার গাওয়া 'আলভিদা' গানটাও শ্রোতাদের পছন্দের তালিকায় ছিল। মুম্বাইতে সবশেষ ২০১৩ সালে ওয়ার্নিং সিনেমায় তিনি প্লেব্যাক করেছিলেন।
এখন আর নতুন গান বানানো হয় না তেমন, পুরনো গানগুলোতে জেমস তার 'নগরবাউল' নিয়ে কনসার্ট আর টিভি শো মাতিয়েই ব্যস্ত সময় কাটান। নতুন করে গাওয়ার মতো কিছু খুঁজে পান না বলেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে- “যা গাওয়ার ছিল, গেয়ে ফেলেছি। অনেক তো হলো। আর কত? এখন শুধু সেই গানগুলোই গেয়ে যাচ্ছি, যা সবাই শুনতে চায় বারবার। তাই আর নতুন কিছু করার তাগিদ নেই। আবার যখন তাগিদ আসবে গাইব...”
দুই মেয়ের ভেতরেই তার প্রাণপাখি বসত করে। মেয়েদের নিয়ে স্ত্রী থাকেন আমেরিকায়, সময় পেলেই তিনিও উড়াল দেন সেখানে। সেইসঙ্গে ফটোগ্রাফির ঝোঁকটাও নতুন করে জেঁকে বসেছে মাথায়, সেটা তার ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রাম একাউন্টে ঢুঁ মারলেই বোঝা যায়। ক'দিন আগেই সত্ত্বা সিনেমায় গাইলেন 'তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম' শিরোনামের একটা গান, সেটা মরুভূমিতে প্রখর তৃষ্ণায় একফোঁটা জলের মতোই ছিল আমাদের কাছে!
আশি আর নব্বই দশকের তরুণদের, এমনকি যারা এই শতাব্দীর শুরুর সময়টাতেও কিশোর বা তরুণ ছিলেন, তাদের কাছে জেমস একটা অদ্ভুত উন্মাদনার নাম, বুকের ভেতর পুষে রাখা এক আবেগের নাম। সেই ফিতার ক্যাসেটের যুগে জেমসের অ্যালবাম বের হবে জেনে অডিও দোকানের সামনে লাইন ধরে অনন্ত অপেক্ষার মধুর স্মৃতি অনেকেরই সঙ্গী। ওই দিনগুলো পার হয়েছে অনেক আগেই, আগের সেই ক্রেজ এখন বিস্মৃত অতীতের কল্পনা। কিন্ত এখনও কোন কনসার্টে যখন এই মানুষটা গিটারে ঝংকার তুলে গেয়ে ওঠেন- “পাগলা হাওয়ার তোড়ে...”, এরপরের লাইনটা তাকে আর গাইতে হয় না, উপস্থিত শ্রোতাদের তুমুল চিৎকারে ঢাকা পড়ে যায় জেমসের কণ্ঠস্বর!
আমাদের সঙ্গীতাকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রদের একজন মাহফুজ আনাম জেমস, ১৯৬৪ সালের এই দিনে জন্মেছিলেন নওগাঁ জেলার পত্নীতলায়। আমাদের কৈশরের পাগলা হাওয়া আর তারুণ্যের বাধভাঙা উচ্ছ্বাসের একটা অংশ হয়ে ছিলেন যিনি, সেই জেমস আজ পা দিলেন ৫৬-তে। শুভ জন্মদিন জেমস, আপনার বয়স বেড়েছে, আমরা বড় হয়ে গেছি, কিন্ত বদলায়নি সেই গানগুলোর আবেদন, কমেনি আমাদের আবেগও। চোখ বুজলেই আমরা ফিরে যাই সেই নস্টালজিক সময়টায়, আপনার গান আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় সেই সোনাঝরা কৈশরের রোদ্দুরমাখা দিনগুলোতে!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন