যে পাইলট একাই লড়ে জিতেছিলেন ৩০টি নাৎসি যুদ্ধবিমানের সাথে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
সেদিন মৃত্যুর সঙ্গে হা-ডুডু খেলেছিলেন জেমস হাওয়ার্ড! এমন ঘটনা স্রেফ সিনেমাতেই ঘটে না, বাস্তবেও হয়েছিল- এটাই তো অবিশ্বাস্য!
তাওসীফ তান:
আকাশযানে করে উড়তে উড়তে একাই প্রতিপক্ষের পর প্রতিপক্ষ ঘায়েল করে যাচ্ছেন হিরো, কিন্তু তাঁর কোন ক্ষতি কেউ করতে পারছে না! রুপালি পর্দার “স্টার ওয়ার্স” জাতীয় চলচ্চিত্র বা প্লেস্টেশনের ভিডিও গেমে অহরহ দেখা মেলে এসমস্ত কীর্তির। তবে এইসব কল্পনা কিন্তু বাস্তব থেকেই অনুপ্রাণিত হয়! যুদ্ধক্ষেত্রে একা হাতে শত্রু ঠেকিয়ে সহযোদ্ধাদের গোটা দলকে প্রানে বাঁচিয়ে দেওয়ার ঘটনা ইতিহাসে কম নয় এবং প্রতিটা ঘটনাই অসম্ভব বীরত্ব এবং অকুতোভয়তার সাক্ষ্য বহন করে!
যেমন বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর বা মুন্সী আব্দুর রবের ঘটনা তো সবারই জানা তাই না? এদের ঘটনাবলি হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠতম বীরগাঁথা! কিন্তু মানব ইতিহাসের সবচাইতে ভয়াবহ যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্বীকৃত শ্রেষ্ঠতম আকাশ-বীরত্বের কথা কি জানেন? তাহলে আসুন আজ শুনাই মেজর জেমস হাওয়েল হাওয়ার্ড নামের এক পাগলাটে কিন্তু অসমসাহসী পাইলটের কথা! যিনি তাঁর পি-৫৩ বিমান উড়িয়ে গড়েছিলেন অবিশ্বাস্য এক কীর্তি! একা যুদ্ধ করে ভুপাতিত করেছিলেন ৩০ টি নাৎসি যুদ্ধবিমান!
প্রথম জীবনে ইউএস নৌবাহিনীর পাইলট হাওয়ার্ডের বীরত্ব আর সাহসিকতার উদাহরণ আলোচ্য ঘটনার পূর্বেও যথেষ্ট বিদ্যমান। বার্মায় ডিউটিরত বিখ্যাত দুর্ধর্ষ আমেরিকান ফাইটার পাইলট গ্রুপ “দা ফ্লাইং টাইগার্স” এর হয়ে ৫৬ টি এয়ার মিশন সফলভাবে সম্পন্ন করা এবং একবার ছয়টি জাপানী বিমান একা গুলি করে উড়িয়ে দেবার অসমসাহসী কীর্তির জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ও সেনাবাহিনী কর্তৃক সম্মানিত হয়েছিলেন হাওয়ার্ড। তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে। ১৯৪২ সালে ফ্লাইং টাইগার্স গ্রুপ ভেঙ্গে দেওয়া হলে হাওয়ার্ড বিমানবাহিনী জয়েন করেন ক্যাপ্টেন হিসেবে। ১৯৪৩ সালে তাঁকে “মেজর” পদে উন্নীত করা হয় এবং ৩৫৪তম ফাইটার গ্রুপের একটি স্কোয়াড্রনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই স্কোয়াড্রনে থাকাকালীনই ১৯৪৪ সালের ১১ই জানুয়ারী তিনি এমন এক অবিশ্বাস্য কীর্তি গড়েন যা তাঁকে ইতিহাসে অমর করে দেয়! যে ঘটনার জন্য True Magazine তাকে “One man Air Force” উপাধি দিয়ে দিয়েছিল!
জার্মানির Oschersleben শহরের আকাশসীমায় একটি আমেরিকান বি-১৭ বোয়িং ফ্লাইং ফরট্রেস বোম্বিং গ্রুপের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছিলেন সেদিন হাওয়ার্ড ও তার পি-৫১ যুদ্ধবিমান স্কোয়াড। নাৎসি ভূমিতে বোমাবর্ষণ ছিল তাদের মিশন। মাতৃভূমিকে বাঁচাতে তাদের উপর আক্রমন করে ঝাঁকে ঝাঁকে জার্মান “Luftwaffe” যুদ্ধবিমান। হাওয়ার্ড ও তার দল বি-১৭ টিকে রক্ষা করতে পাল্টা আক্রমন করতে থাকে এবং সফলতার সাথে একটি জার্মান এমই ১১০-কে বিধ্বস্তও করে দেন হাওয়ার্ড নিজে!
কিন্তু এরপরেই ঘটে বিপদ। কোন কারণে সঙ্গী বিমানদের সাথে তার বিমানের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি লক্ষ্য করেন জার্মানদের একটি দল তার বাকি সাথীদের দূরে যুদ্ধে ব্যস্ত রেখেছে এবং আরেকটি দল এই সুযোগে পুনরায় আক্রমণ করছে ফ্লায়িং ফরট্রেস! তিনি চাইলে তার সাথীদের ফিরে আসার অপেক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু না! সিনেমার হিরোদের মতো ফ্লায়িং ফরট্রেসের বিপন্ন ক্রুদের বাঁচাতে একাই দৃশ্যপটে আবির্ভাব হন মেজর জেমস হাওয়েল হাওয়ার্ড তাঁর পি-৫১ মাস্ট্যাং বিমান উড়িয়ে! বি-১৭ ফ্লাইং ফোরট্রেসের ক্রুরা বিস্ফোরিত চোখে সাক্ষ্য বহন করলো কিভাবে একা একজন আমেরিকান পাইলট হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ৩০ টি জার্মান যুদ্ধবিমানের যম!
পরিনতির কথা না ভেবে একাই শত্রুর ঝাঁকের দিকে উড়ে যান, নিজের সুরক্ষা মিশনের প্রোটোকল কোনকিছু চিন্তা না করেই একতরফাভাবে মুহুর্মুহু গুলি করতে থাকেন তিনি তার সামনে থাকা নাৎসী বিমানের ঝাঁকের উপর! ছত্রভঙ্গ করে দেন তাদের। ছয়টির বেশি নাৎসি বিমান তাঁর গুলিতে বিধ্বস্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে মাটিতে ভুপাতিত হয়! টানা গুলি করতে করতে এক পর্যায়ে তার তিনটি বন্দুক অকেজো হয়ে যায় এবং ফুয়েলের কাঁটা নেমে আসে বিপদজনকভাবে নিচে! কিন্তু তাও তিনি বারবার শত্রুদের দিকে ডাইভ দিচ্ছিলেন, অনেকটা হাডুডু খেলায় যেভাবে প্রতিপক্ষকে শাসানো হয় সেভাবে!
হ্যাঁ, মৃত্যুর সঙ্গে হাডুডুই খেলেছিলেন সেদিন জেমস হাওয়ার্ড! এবং মজার ব্যাপার হলো, একা বি-১৭ এর সমস্ত ক্রুম্যানদের বাঁচিয়ে দিলেও তাঁর নাম পরিচয় সবকিছুই কিন্তু ছিল তাদের কাছে অজানা! তারা অনেকদিন পর্যন্ত জানতে পারেনি তাদের রক্ষাকারী দেবদূতের নাম-পরিচয়। এমনকি ইন্টেলিজেন্সের কিছু বড় কর্তা ছাড়া আসলে হাওয়ার্ডের এই মিশনের কথাও কেউ জানতো না! দেশবাসীর কাছে সন্তর্পণে গোপন রাখা হয়েছিল হাওয়ার্ডের বীরত্বগাঁথা।
অবশেষে ফাইটার কমান্ড অফিসারদের তদন্তের ফলে আলোয় আসে তার নাম! এই ঘটনাটিকে “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শ্রেষ্ঠতম বিমানযুদ্ধ বীরগাঁথা” হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়, আর মেজর জেমস হাওয়েল হাওয়ার্ড হয়ে যান ইতিহাসে বিখ্যাত এবং অমর!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন