জা কউম আজ টেকনোলজি দুনিয়ার অন্যতম বিগ শটদের একজন, একদম সেলফ মেড বিলিওনিয়ার। যে ফেসবুক একদিন তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিল, জা কউম নিজের উদ্ভাবিত হোয়াটস অ্যাপকে ১৯ বিলিয়ন ডলারে বিক্রি করেছেন তাদের কাছেই! এই অসামান্য অনুপ্রেরণাদায়ী মানুষটার গল্প কি আমরা জানি?

দুনিয়া কাঁপানো স্মার্টফোন ম্যাসেঞ্জার হোয়াটস এ্যাপের প্রতিষ্ঠাতা জা কউম এর সাথে কি ছেলেবেলায় আপনার পরিচয় ছিলো? আপনি যদি নব্বইয়ের দশকে ইউক্রেনের কিয়েভের অদূরে জা কউম এর গ্রামে বেড়ে উঠে থাকেন, তাহলে এটা নিশ্চয়ই জানবেন যে স্কুলের হোমওয়ার্ক জানার জন্যে তার বাসায় ফোন করাটা কত ঝঞ্ঝাটের ব্যাপার ছিলো! সে সময় ইউক্রেনবাসীরা খুব কমই ফোনে কথা বলতে পারতেন। সবাই ছিলেন কঠিন নজরদারীর মধ্যে। আশঙ্কা ছিলো সরকারের তরফ থেকে ফোনে আড়ি পাতার। 

পান থেকে চুন খসলেই কঠিন শাস্তি। ছিলো না কথা বলার স্বাধীনতা, নিজস্ব মত প্রকাশ করার অধিকার। নতুন কোন কাজের উদ্যোগ নেয়া তো রীতিমত স্পর্ধার শামিল ছিলো! গরম জলের ব্যবস্থা ছিলো না, টাকা-পয়সা ছিলো না, জীবনের মানোন্নয়নের কোন সুযোগ ছিলো না, ছিলো না কোন ভবিষ্যৎ। তার ওপর তারা ছিলেন ইহুদি। ইউক্রেনে তখন চলছে চরম ইহুদি বিদ্বেষ। সব মিলিয়ে একটা ভীষণ হতাশাচ্ছন্ন জীবন কাটাচ্ছিলেন তিনি সেখানে। অবশেষে একদিন তার বাবা-মা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না। নতুন জীবন শুরু করতে হবে। অন্য কোথাও, দূরে। 

১৯৯২ সালে তিনি, তার মা এবং দাদী আমেরিকায় চলে গেলেন নতুন জীবনের প্রত্যাশায়। কিছু জটিলতার কারণে তার বাবা ইউক্রেনে থেকে যান, এবং সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি কিছুদিন পরে তাদের সাথে যোগ দেবেন। সেই কিছুদিন আর এলো না। তার বাবা মারা যান দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে। আমেরিকায় তাদের নতুন আবাসস্থল হয় ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন ভিউয়ে। তবে স্বপ্নের দেশে এসেই যে তারা সুসজ্জিত সুখময় আয়েশী জীবন যাপন করতে পারলেন, তা নয়। তার মা বেবি সিটিংয়ের কাজ নিলেন, আর জা কউন মুদী দোকানে ঝাড়ুদারের কাজ করে অবতীর্ণ হলেন জীবনের নতুন সংগ্রামে। তারপরেও, ইউক্রেনের মত তেমন দম বন্ধ করা স্বৈরাচার শাসিত জীবন নির্বাহ করতে হচ্ছে না, এটাই যা স্বস্তি ছিলো তাদের জন্যে। 

তবে এমন জীবন যাপন থেকে আসলেই কি কিছু পাওয়ার আছে? এভাবেই চলে যাবে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর? যে অযুত সম্ভাবনা এবং নিযুত স্বপ্ন ভেতরে লালন করে একজন মানুষ তার দেখা কখনও কি পাবে তারা? পাবে কী করে! স্কুলে জা কউনের মোটেও মন টিকতো না। তিনি কিছুতেই তার প্যাশনের জায়গাটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এরকম এক দোলাচলের মাঝেই জীবনে ফিরে আসে এক অপ্রত্যাশিত উপহার। বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেই প্যাশন! তিনি আগ্রহী হয়ে উঠলেন প্রোগ্রামিং এর ওপর। স্কুলের পাঠ্যসূচিতে প্রোগ্রামিং তেমন ভাবে ছিলো না। কিন্তু ততদিনে তার মধ্যে আগ্রহটা রীতিমত খাই খাই করা শুরু করেছে। ভীষণ ক্ষুধা তার। আরো চাই, আরো অনেক অনেক বেশি! কিন্তু এত বই কেনাটাও তো বিশাল খরচের ব্যাপার। কোথা থেকে তিনি পাবেন এত টাকা? 

নিজেকে প্রমাণ করার জন্য মুখিয়ে থাকতেন জা কউম

ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়! অল্প দামে বই ভাড়া করে পড়তে শুরু করলেন তিনি। পড়া শেষে ফেরত দিতে হতো। তাতে কী! তার শেখা ঠিকই এগুচ্ছিলো দুর্বার গতিতে। টগবগ করে ফুটছিলেন তিনি নিজেকে প্রমাণ করতে। এই সুবিশাল পৃথিবীর কোন এক মঞ্চে নিজের পারফরম্যান্স দেখানোর জন্যে উদগ্রীব হয়ে পড়েছিলেন। ১৮ বছর বয়সে স্কুল ছাড়ার সময় তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন স্বশিক্ষিত কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার। ভর্তি হলেন স্যান জোসে ইউনিভার্সিটিতে। একটি প্রেস্টিজিয়াস জবও পেলেন। ইয়াহুতে সিকিউরিটি টেস্টার হিসেবে শুরু করলেন নতুন কাজ। ইয়াহুর কথা শুনে আবার নড়ে চড়ে বসবেন না যেন! এই সময়ের টেক জায়ান্ট ইয়াহু তখন হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে কেবল যাত্রা শুরু করেছে। 

এতক্ষণ ধরে তার জীবন বৃত্তান্ত পড়ে নিশ্চিতভাবেই তাকে একজন মুখচোরা এবং একা ব্যক্তি হিসেবে ঠাওরে নিয়েছেন নিশ্চয়ই? সেরকম টা ভাবাই স্বাভাবিক। তার তেমন কোন বন্ধু ছিলো না কখনই যার সাথে তিনি তার স্বপ্ন এবং সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলতে পারেন, যার সাহচর্যে জীবনের খোলনলচে বদলে দেবার সাহস পান। ইয়াহুতে কাজ করতে গিয়ে অবশেষে তেমন একজন জুটে গেলো তার ভাগ্যে। নাম তার ব্রায়ান এ্যাকটন। ইয়াহুর জন্ম লগ্ন থেকেই কাজ করতেন সেখানে। ব্রায়ানের সাথে নিজের অনেক কিছুই মিল পেলেন। শেয়ার করলেন তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, কর্মদর্শন। ক্লান্ত কর্মদিনের পর বারে বসে দুই ক্যান বিয়ার নিয়ে তারা একসাথে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। বার থেকে বেরিয়ে উৎফুল্ল মনে “ইয়ে দোস্তি হাম নেহি ছরুঙ্গে...” গাইতে গাইতে ফিরে গেলেন ঘরে। 

এর মাঝে কউমের মা মারা গেলেন। তার আর কোন পিছুটান থাকলো না। অশ্রূসিক্ত চোখে কিয়েভের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে করে জীবন সম্পর্কে নতুন ভাবনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সে সময় ব্রায়ানের স্পর্শ না পেলে তার পক্ষে পরিস্থিতি মোকাবেলা করাটা খুবই কঠিন হয়ে যেত। একদিনের কথা। কউম তখন ভার্সিটিতে ক্লাশ করছেন। সে সময় তাকে ইয়াহু থেকে জরুরী ভিত্তিতে তলব করা হলো এক বিশাল সিস্টেম ব্রেকডাউনের সমস্যা সামাল দেবার জন্যে। সেদিন তিনি উপলব্ধি করলেন একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসে গেছে। ভার্সিটি এবং ইয়াহু’র মধ্যে যে কোন একটি বেছে নিতে হবে। অনেক ভাবনা চিন্তা করে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ভার্সিটি ছেড়ে দেবেন। 

ইয়াহুতে বন্ধু ব্রায়ানের সাথে সময়টা মন্দ কাটছিলো না। ইয়াহুর ব্যবসা ততদিনে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। টাকা পয়সাও ভালোই আসছে হাতে। কিন্তু স্বপ্নাদিষ্ট মানুষদের কবেই বা টাকা পয়সার নিশ্চয়তা এবং বাঁধা ধরা কাজ আটকে রাখতে পেরেছে? এক সময় তারা বোরড হয়ে গেলেন। নতুন কিছু করা দরকার। এভাবে ছাপোষা ভীড়ের মানুষ হয়ে আর কত দিন? ততদিনে ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। নতুন সম্ভাবনা, নতুন চ্যালেঞ্জ! তারা ভাবলেন, ইয়াহুর মাধ্যমে এমন কাজে যুক্ত হলে কেমন হয়? কিন্তু ইয়াহু মোটেও উৎসাহ দেখালো না। তাই দীর্ঘ নয় বছর চাকুরি করার পর কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতেই হলো। 

ইয়াহুর লোভনীয় চাকরি ছেড়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হোয়াটস অ্যাপ

ছেড়ে দিলেন ইয়াহু। সাথে হরিহর আত্মা ব্রায়ান তো ছিলোই! বেকার দুই বন্ধু নতুন প্রজেক্টে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে সাউথ আফ্রিকা ঘুরে আসলেন। চোখে তাদের আনন্দের আলোকছটা, মনে দৃঢ় সংকল্প, এবার দারুণ কিছু হবেই। আমেরিকায় ফিরে এসে দুজন মহা উৎসাহে ফেসবুক এবং টুইটারে পরীক্ষা দিলেন। এবং... দুজনেই প্রত্যাখ্যাত হলেন! এরপর বেশ কিছু দিন কেটে গেল অলস এবং নিরানন্দ ভাবে। হাতে কাজ নেই, মাথায় ও তেমন কিছু খেলছে না, ইয়াহুর চাকুরিটা ছেড়ে ভুলই করে ফেললেন না কি, এমন সংশয়ও কাজ করছে। নতুন কেনা আইফোনটা বিরস মনে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে একদিন কউন পেয়ে গেলেন মহা আকাঙ্খিত সেই আইডিয়া! স্মার্টফোনের জন্যে একটা কমিউনিকেশন এ্যাপস বানালে কেমন হয়!

সাথে সাথে জানালেন প্রাণের দোস্ত ব্রায়ানকে। তারও খুব পছন্দ হলো আইডিয়াটা। এর পর ধর তক্তা মার পেরেক স্টাইলে গড়ে ফেললেন দুজনার স্বপ্নের কোম্পানি “হোয়াটস এ্যাপ”। বিচিত্র এক কারণে জা কউম রঙচঙা বিজ্ঞাপন খুব অপছন্দ করতেন। ইউক্রেনের সেই ছোট্ট বালকটির মনে তখনও সেই শান্ত, সৌম্য জীবনের মায়া প্রোথিত ছিলো। আমেরিকার পপুলার কালচারে অভ্যস্ত হতে পারেন নি তখনও। তার একান্ত অনুরোধে তাদের নবগঠিত কোম্পানির নীতি ঠিক করা হলো- “বিজ্ঞাপন থেকে তারা কোন আয় করবেন না”। এভাবেই গঠিত হলো আজকের প্রসিদ্ধ হোয়াটস এ্যাপ কোম্পানি। তারিখটা ছিলো ২০০৯ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি। 

২০১০ সালের প্রথমাংশে হোয়াটস এ্যাপ আনুষ্ঠানিক ভাবে মুক্তি পেলো। তখন স্মার্টফোনের জন্যে এ ধরনের এ্যাপস এর তেমন প্রচলন না থাকায় কিছু বিক্রিবাট্টাও হলো। তবে তা ছিলো কাঙ্ক্ষিত লেভেলের চেয়ে অনেক নিচে। ধীরে ধীরে নানারকম সমস্যা দেখা দিলো। ক্রমাগত ক্র্যাশ হতে লাগলো। ইউজাররা মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কউম ভীষণ ভেঙে পড়লেন। প্রাণের বন্ধু ব্রায়ানকে বললেন, “দোস্ত, আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। আমি কুইট করার কথা ভাবছি”। ব্রায়ান তাকে সাহস যোগালেন। অক্লান্ত কাজ করে অবশেষে তারা বাগ গুলো ফিক্স করতে পারলেন। 

জা কউম আজ টেকনোলজি দুনিয়ার বিগ শটদের একজন

এই পর্যায়ে সাফল্য আসতে লাগলো দ্রুত। প্রচুর ইউজার পেলেন। র‍্যাংক বাড়তে থাকলো। টেকি ওয়ার্ল্ড অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো ইউক্রেনের সেই মুখচোরা গ্রাম্য ছেলেটা কী হুলুস্থুলই না শুরু করেছে! সাফল্যের তখন কেবল মাত্র শুরু! ২০১৩’র ফেব্রুয়ারির মধ্যে ইউজার সংখ্যা দুইশ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেলো। যে ফেসবুক একবার তাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলো, সেই ফেসবুকই ২০১৪ সালে তাদের অধিগ্রহণ করে নিলো ১৯ বিলিয়ন ডলারে! আর এখন, এই ২০১৮ সালে হোয়াটস এ্যাপ এর গ্রাহক সংখ্যা ১.৩ বিলিয়ন বা একশ ত্রিশ কোটি। 

স্মার্টফোনের এ্যাপস জগতে এর সমতূল্য কিছু নেই। জা কউম আজ টেকনোলজি দুনিয়ার অন্যতম বিগ শটদের একজন। তার মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। জা কউম আমাদের শিখিয়েছেন, কাজ শুরু করার জন্যে ইচ্ছে এবং একাগ্রতার পাশাপাশি প্যাশনটাও কত গুরুত্বপূর্ণ। তার অসাধারণ জীবনালেখ্য আমাদের শেখায় বন্ধুত্বের গুরুত্ব, একত্রে কাজ করার সুফল। উন্নতির শিখরে উঠেও তিনি ভোলেন নি ফেলে আসা ছিমছাম গ্রামের স্মৃতি, সাদাসিধে জীবন। কর্ম এবং আবেগের অপূর্ব সমন্বয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন স্বপ্নবান মানুষদের অগ্রদূত...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা