জনপ্রিয় হয়ে গেলে নাকি অনেক মেপে কথা বলতে হয়, অনেক ইস্যু এড়িয়ে যেতে হয়। জয়া আহসান সেই ঠুনকো জনপ্রিয়তার ধার ধারেন না, অজনপ্রিয় হবার কঠিন পথ তিনি বেছে নিয়েছেন, এজন্যে আমি তাকে আরও বেশি ভালোবাসি...

জয়া আহসানের অভিনয়ের ভক্ত ছিলাম অনেক আগে থেকেই। তার কথাবার্তারও মুগ্ধ শ্রোতা ছিলাম। তবে আজ তিনি যেটা করলেন, তাতে নতুন করে তার প্রেমে পড়তে বাধ্য হলাম। বরেণ্য শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী ড. আনিসুজ্জামান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হয়েছেন গতকাল। জয়া আহসান আনিসুজ্জামান স্যারের স্মরণে তার একটা উক্তি শেয়ার দিয়েছেন নিজের ফেসবুকে অ্যাকাউন্টে। প্রথম দর্শনে সেটা দেখে খুশি, বিস্ময় এবং খানিকটা আতঙ্কের ত্রিমুখী একটা ধাক্কা এসে লেগেছে মনে। 

আনিসুজ্জামান স্যার বলেছিলেন, 'ধর্ম মানার পাশাপাশি, না মানার স্বাধীনতাও দিতে হবে।' জয়ে আহসান সেটাই শেয়ার করেছেন ফেসবুকে। প্রায় আড়াই লক্ষ ফলোয়ার সমৃদ্ধ একাউন্ট থেকে এমন কিছু শেয়ার করাটা বাংলাদেশের মতো জায়গায় যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে, তারকা হলে তো কথাই নেই, এসব ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকা লাগে। কারণ একটু উনিশ-বিশ হলেই খাপখোলা তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে ফেসবুক মুমিনের দল, কচুকাটা করে ছাড়বে সেই সেলিব্রেটিকে। 

জনপ্রিয়তার চূড়ায় থেকে এভাবে স্ট্রেট ফরোয়ার্ড কথা সবাই বলতে পারে না। ধর্মান্ধতে ভরা এই দেশে আনিসুজ্জামান স্যারের এই কোটেশান শেয়ার দেয়াটা যে কোন তারকার জন্যেই ভীষণ চ্যালেঞ্জিং একটা বিষয়। মোশাররফ করিম একবার ধর্ষণের পেছনে নারীদের পোষাকের কোন অবদান নেই- এটুকু বলেই ফেসবুক মুমিন আর তৌহিদি জনতার চাপের মুখে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছিলেন। সাফা কবীর বলেছিলেন, তিনি পরকালে বিশ্বাস করেন না। তাতেই ধর্মান্ধদের পিত্তি জ্বলে গিয়েছিল, মুসলমানের মেয়ে হয়ে তুই পরকালে বিশ্বাস করিস না মানে! রিপোর্ট করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল সাফার ফেসবুক একাউন্ট। 

জয়া আহসান

জয়া আহসানের বেলায় আক্রমণটা আরও কদর্য, আরও নোংরা হবে জানি। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, যেরকমটা আশা করা হয়েছিল, সেরকম সুবিধা জয়া আহসানের সেই পোস্টে করতে পারেনি ধর্মান্ধ লোকজন। অনলাইন নিউজের কমেন্টবক্সে ছাগুদের যেমন তীব্র উল্লাস আর আক্রমণ দেখা যায়, সেটা আছড়ে পড়তে পারেনি এখানে। প্রগতিশীল লোকজন অনেকটা দলবেঁধে পাহার দিয়েচগে কমেন্টবক্স, কেউ উল্টোপাল্টা কমেন্ট করলে তাকে উচিত শিক্ষা দিয়েছে। এই প্রথম, এমন কোন লড়াইয়ে ধর্মান্ধদের বিপক্ষে প্রগতিশীলদের ভূমিধ্বস বিজয় দেখলাম!

আমি জয়া আহসানকে ভালোবাসি, নিঃশর্তভাবে। দিনকে দিন এই ভালোবাসা বেড়ে চলে। এই ভদ্রমহিলা সময়ের সাথে সাথে আমার মনাঞ্চলের আরও বেশি জায়গা দখল করে নেন। তিনি পাহাড়ের আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন, যেটা আজ পর্যন্ত কোন সেলিব্রেটিকে আমি বলতে শুনিনি। জনপ্রিয় হয়ে গেলে নাকি অনেক বাছবিচার করে চলতে হয়, অনেক মেপে কথা বলতে হয়, অনেক ইস্যু এড়িয়ে যেতে হয়। জয়া আহসান সেই ঠুনকো জনপ্রিয়তার ধার ধারেন না, অজনপ্রিয় হবার কঠিন পথ তিনি বেছে নিয়েছেন, এজন্যে আমি তাকে আরও বেশি ভালোবাসি। 

আমাদের শিল্পীদের মধ্যে একদল সবকিছু নিয়ে নিশ্চুপ, আরেকদল রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষায় তেলবাজী করে যান। ভোটের আগে অনেককেই দেখেছি প্রচারণায়, কিন্ত দেশের যখন প্রয়োজন, মানুষের যখন সাহায্য দরকার- তখন আর তাদের খোঁজ পাওয়া যায় না কোথাও। জয়া আহসান সেখানে ব্যতিক্রম। অন্যরা যখন জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত, তখন জয়া নিজের জনপ্রিয়তাকে বুড়ো আঙুল দেখান, বরং তিনি নামেন অজনপ্রিয় হবার মিশনে, তিনি আপোষ করেন না, কাউকে খুশি করতে সেন্সর চাপিয়ে কথা বলেন না, তিনি মনের ভেতরের অনুভূতিটাই প্রকাশ করেন সাহসের সঙ্গে। জয়া, আপনি আরও অজনপ্রিয় হোন প্লিজ!

জয়া আহসান

করোনার এই ক্রান্তিকালে তিনি গ্লাভস-মাস্ক পরে কুকুরদের জন্যে রান্না করা খাবার নিয়ে রাস্তায় এসেছেন, তাদের খাইয়েছেন পরম মমতায়। সঙ্গে ক্যামেরা নিয়ে আসেননি, ছবি তুলে ফেসবুকে দেননি। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, 'জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর', জয়া আহসানের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তোলা ধর্মান্ধরা জানে না, জয়া তার কাজের মাধ্যমেই স্রষ্টার সেবা করছেন, ধর্মের নামে বিদ্বেষ ছড়িয়ে নয়। 

জানি এখানেই শেষ নয়, আরও আক্রমণ আসবে। এমন বোল্ড স্টেটমেন্ট, সংখ্যাগরিষ্ঠের বিরুদ্ধে এভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়াটা সংখ্যাগুরুরা কখনোই মেনে নিতে পারে না। আশা করি সেসব নুইয়ে পড়বেন না জয়া আহসান। ভালোবাসা নেবেন জয়া, জানবেন, আমাদের অসীম ভালোবাসা আর শুভকামনা আপনার সঙ্গী, সর্বক্ষণ, সর্বত্র। এই পোস্ট ডিলিট হয়ে গেলেও সেই একপাক্ষিক ভালোবাসাটা বজায় থাকবে... 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা