এই তোমাদের আধুনিকতা? এই তোমাদের বিজ্ঞানমনস্কতা? আমি যে অশুভ নই, আমি যে চণ্ডীর অভিশাপ নই, আমি যে তোমাদের ঈশ্বরের বানানো মেন্যুফ্যাকচারিং এর বাই ডিফল্ট প্রবলেম নই, তা জেনেও কেন তবে নিজেদের ঘরে আমাদের জায়গা দিচ্ছ না?
প্রিয় মা-বাবা,
একই অঙ্গে নারী পুরুষের সাদৃশ্যতা থাকা কি আমার অপরাধ? নাড়ী ছিঁড়ে এই পৃথিবীর মুখ দেখেছি, সেটা কি আমার অপরাধ? প্রত্যেকটা প্রাণের বৈশিষ্ট্য কি নির্দিষ্ট করে কখনো মাপা হয়? যে প্রকৃতি থেকে জন্মায় তাকে কখনো কোনো নির্দিষ্ট ছাঁচে কি ফেলা যায়? কারো জন্মটা কি কখনো তার নিজের হাতে গড়া? তার মাঝে আমার যে মনটা, তাকেও কি কোনো জোরপূর্বক বাঁধনে বেঁধে রাখা যায়?
আমার কিসে ভালো লাগে, আমার কোনটা ভালো লাগে তার ভারটা তো আমি বইবো। আমাকে তবে কেন নির্দিষ্ট করে, আলাদা করে একটি পৃথক মানুষ হিসেবে ভাবা হয় না? কে দিয়েছে এসব পৃথক করার অধিকার? কেন করবেন আমায় আলাদা, কে আপনারা? আপনি আমায় জন্ম দেবেন, তারপর আমায় অচ্ছুৎ আর পিশাচের দলভুক্ত করে অজানা এক নির্মম ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসবেন! কেন? কার দায় এই জন্ম?
আমার জন্ম তো মানুষের দেহেই হয়েছে, সৃষ্টির স্বাভাবিক নিয়ম তো আমার শরীরও, একই দেহে একটু ভিন্নতাকে আপনিই জন্ম দিয়েছেন, তাই বলে আমার ভিন্নতা দেখে আমায় আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে দেবেন? কিসের ভয়ে আমায় ফেলে দিচ্ছেন, কাদের ভয়ে?
আমি তো যে মায়ের পেটে জন্মেছি, তারই রুপ ধারণ করেছি, আমাকে তবুও শিকড়হীন কেন করবেন? নিজেই জন্ম দেবেন, তারপর নিজ হাতে শেকড়টাও ছিঁড়ে ফেলে দেবেন! কী অপরাধ আমার, মানুষ তো আমিও আপনাদের মতন। বাবা, আমি তোমার রক্ত, মায়ের রক্ত। তবুও আমায় মিথ্যে কুসংস্কারের অমঙ্গল ভেবে সমাজের কুৎসা আর অশিক্ষিত কুশিক্ষিত কয়েকটা সস্তা উপহাসকারীর হাসি ঠাট্টার ভয়ে আমাকে রাতের আঁধারে মায়ের শেষ ফোঁটা অমৃত আর পরম মমত্ব থেকে ছিন্ন করে একটা কচুরিপানার দলে ফেলে দিয়ে আসবে? আমার লিঙ্গটা কি আমার স্ব-ইচ্ছাকৃত জন্মগত অপরাধ?
আমি জানি না আমার মা কে, আমি জানি না কে ছিল আমার বাবা.. আমি দিতে পারি না আর দশজন মানুষের মতন আমার জন্মের ঠিকানা। নাই আমার কোনো ভাই, নাই কোনো বোন, বন্ধু কিংবা স্বজন। আমি মানুষ হয়েও, আমাকে কেন বাঁচতে হয় অনুগ্রহ এবং নিগ্রহের জীবন?
বলতে পারেন কেউ আপনারা, মায়ের আদরের স্পর্শ কেমন হয়? কেমন করে বাবা শাসন করে? কেমন করে একটা সাধারণ পরিবার তাদের দিনরাত যাপন করে! ঐ যে তারা এক সঙ্গে যে ভাত খেতে বসে তিন বেলা, সেটা আমি প্রায়ই টিভির নাটক ছবিতে দেখি, আচ্ছা বাস্তবেও কি এমন হয়? রাতে জ্বর এলে শুনেছি মা নাকি রাত জেগে বসে থাকে আদর করে, জানেন এরকম যদি সত্যিই হয় তবে আমি সারাজীবন শরীরে জ্বর নিয়ে বাঁচতে চাই। শুনেছি আমাদের নাকি উপরওয়ালা এখানে পাপের শাস্তি দিচ্ছেন। জানি না ঠিক কার পাপের জন্য আমাদের এই শাস্তি, আপনারা একটু কম পাপ করতে পারেন না, এরকম না হলে কি আমাদের শাস্তি পেতে হতো!
আমি না প্রত্যেকদিন আমার মা'কে স্বপ্ন দেখি, কিন্তু কিছুতেই তিনি বাস্তবে ফিরে আসতে চান না, শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন শেষে তাকে আমি আমার কাছে ধরেও রাখতে পারি না। আরো শুনেছি বোন আর ভাইগুলো নাকি বন্ধুর মতন হয় ছোটবেলায়, বড় হলে বিয়ে করলে নাকি শত্রু হয়ে যায়, আমি এসব সিনেমায় দেখেছি কিন্তু বাস্তবে এ কথা বিশ্বাস করতাম না। আচ্ছা তোমাদের সকলের পাপের জন্য এবং ভালোর জন্য নাকি আমাদের এই শাস্তি, তবে খবরে শুনি তোমরা নাকি এখনো ভীষণ অসুখী আর পাপী.. কেন?
জানো, আমার স্কুলে পড়ার খুব ইচ্ছে ছিলো, একদিন গিয়েছিলামও ভর্তি হবার জন্য। লিঙ্গ পরিচয় আর বাবার নাম না বলতে পারায় তাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাবার নাম জোগাড় করেও ক্লাস ফাইভের বেশি যেতে পারিনি, আমাদের জন্য নাকি পড়াশোনা না। লাথি দেয়নি, তবে দানব এবং নর্দমার কীট বলে তাড়িয়ে দিয়েছে।
সবকিছু থেকে কেমন জানি নিজেকে আলাদা করতে পারি না নিজেকে। তোমাদের মতন শরীর, মন এবং রক্তের গ্রুপেও মিল। তবুও কেন আমাদের দেখলে তোমরা বমি করে দেবে এমন ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন দাও? প্রথমে রাগ হতো তোমাদের উপর, এখন মানিয়ে নিয়ে হাসি দেই, তোমরা যারা আধুনিক সংস্কারমনা লোক হয়ে উঠেছো বলে গর্ব করে বেড়াও, আমার তখন সেই নোংরা গর্বিত গন্ধে বমি আসে।
এই তোমাদের আধুনিকতা, এই তোমাদের বিজ্ঞান মনস্কতা? আমি যে অশুভ নই, আমি যে চণ্ডীর অভিশাপ নই, আমি যে তোমাদের ঈশ্বর আর খোদার বানানো মেনুফ্যাকচারিং এর বাই ডিফল্ট প্রবলেম নই, তা তো এখনো স্বীকার করে নিজের ঘরে আমাদের জায়গা করে দিচ্ছ না! আমাদের তো এখনো রাতের আঁধারে নর্দমায় ভাসিয়ে দিয়ে আসো, এর চেয়ে নাহয় গলা টিপে রাক্ষসগুলোকে তখুনি মেরে ফেলো। এমন নির্মমভাবে বাঁচিয়ে রেখে তিলে তিলে তিক্ততার এই কচুরিপানার জীবনটা ভিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন তো নেই।
তোমরা নাকি অনেক দুঃখী, জীবনে নাকি তোমাদের অনেক কষ্ট, কখনো আমার কষ্টটা দেখেছো তোমরা? তোমাদের এই পরিবার পরিবার আর সমাজ সমাজ খেলাটা দেখলে খুব রাগ হয়; ইচ্ছা করে তোমাদের জন্য সত্যিই রাক্ষস হয়ে যাই। সব দেখে শুনে, মান অভিমানের দরজায় খিল দিয়ে সেই দয়াময়ের কাছে যাওয়ার জন্য মন ঠিক করি, শুনেছি যিনি কিনা পরম দয়ালু, পরম মমতাময়ী, পরম করুণাময়..
জানো তো তোমাদের মতন আমরা ঈশ্বরকে লোভ দেখাই না, আর উনার লোভেও পা দিই না। এই যে তোমরা সমাজে মসজিদ-মন্দির-গীর্জা করে রেখেছো, এটা তো অনেকাংশেই লোক দেখানো। যদি এগুলোতে ঈশ্বর তুষ্টই হতেন, তাহলে তোমাদের এত অসুবিধা কেন? তোমরা এত ক্রুদ্ধ কেন, এত রক্তের পিপাসা কেন তোমাদের? একে অপরের থেকে মহৎ হতে যাবার সে প্রতিযোগিতায় এত হিংসে কেন? আমি যখন খোদাকে ডাকতে মসজিদে যেতে চাই আমাকে ঢুকতে দাও না, তাড়িয়ে দাও; আমি যখন গীর্জায় যাই সেখানেও আমার ঠাই নাই; মন্দিরে গেলেও কোনো মূল্যায়ন নাই।
একবার বলবে, তোমাদের সমাজ আমাদের এই জীবনটাকে নরক বানিয়েছে কেন? তোমরা আমাদের জীবনের সবকিছু ঠিক করে দেবার কে? আমরা কোথায় যেতে পারবো আর পারবো না, তা যদি ঈশ্বরের ঘর হয়, উনি ঠিক করবেন উনি বাঁধা দেবেন। তোমরা বাঁধা দেওয়ার কে? প্রতিনিধি, নাকি সুবিধাবাদী?
এখন আর ঝামেলায় জড়াই না, কোনো উপাসনালয়েও যাই না। কারণ ঈশ্বর যদি আমার অর্ঘ্য নেন তবে তা আমার রক্তের দাগে ভেজা চাদরে বসে ডাকলেও নেবেন, কিংবা আমার শরীরে ময়লা থাকলেও নেবেন। ডাকাটাই আসল, উনাকে ভক্তি করার জন্য দল বাঁধতেও হয় না নিয়ম করে, নির্দিষ্ট কোনো পবিত্র স্থানও লাগে না তাঁকে ডাকার জন্য। পুরো জগৎটাই তো তাঁর।
তোমাদের দেয়া এই জীবনে আমাদের কোনো মোকাম নাই, সাকিন নাই। আমাদের নাই মা, আমাদের নাই বাবা, আমাদের নাই কোনো সমাজের নির্ধারিত ধর্ম পালনের অধিকার। তাই আমি ঐ উপরওয়ালাকে তোমরা যেভাবে প্রচার করো, সেভাবে তাঁকে ডাকিও না, বিশ্বাসও করি না। আমি জানি প্রত্যেকের অন্তরের অন্দরে যে মনটা আছে, তার ভিতরেই এক মহান স্রষ্টা বাস করে; যে দেখায় ভালো পথ, যে থামায় অন্যায়।
কিন্তু আজন্ম আফসোস, আমরা রক্ত মাংসে ঠিক তোমাদের মতন অনুভূতিশীল মানুষ হয়েও হেরে গেলাম, হেরে যাচ্ছি, হেরেই যাবো। এই তোমাদের সমাজ ব্যবস্থা সব সময় লিস্ট নিয়ে বসে থাকে কে জন্মালে কী হবে, কে জন্মালে পরিবারে থাকবে আর কে বেশ্যা পাড়ায় যাবে। এই তোমাদের সমাজই ঐশ্বরিক ভয় ভীতি দেখিয়ে ছিনিয়ে নেয় আমাদের জন্ম পরিচয়, তারপর রাতের আঁধারে আমাদের ময়লার ভাগাড়ে রেখে তারা নাকি পুত-পবিত্র জীবন যাপন করে।
আমরা ভেসে আসিনি এখানে, ভাসিয়ে দিয়েছো তোমরাই। বিনা অপরাধে আমাদের কিসের সাজা দিচ্ছো জানি না, শুধু এটুকু নিবেদন- আমাদের তোমরা হিজড়া বলো না। একটা সুন্দর নাম দাও আমাদের, এর বেশি আমরা তো চাইতেও পারি না। কারণ তোমাদের কারো না কারো ঘর থেকেই তো আমাদের ফেলে দেওয়া হয়েছে, তাই এত দিনে তোমাদের কাছে আর মায়া-মমত্ব-মনুষ্যত্বের পাওনা চেয়েও লাভ নেই, জানি। হে মহান নিখুঁত মানুষেরা, আমাদের সাথে অন্তত অন্যায়-অবহেলার আচরণটুকু করো না, কথায় কথায় হিজড়া বলো না। ভালোবাসা নিও অচেনা অজানা মা ও বাবা।
ইতি,
তোমাদের ফেলে দেয়া ঝিনুক
-
* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে
আরও পড়ুন-