জিতেন্দ্র কুমার: আইআইটির মেধাবী ছাত্র থেকে 'জিতু ভাইয়া' হবার গল্প
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
আইআইটি খড়গপুরে পড়েছেন, ভারতের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সবাই যখন ভেবে নিয়েছে ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে, গুগল-মাইক্রোসফটে চাকরি করবে, তখনই ছন্দপতন হলো। ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে না ঢুকে তিনি ঢুকলেন ইউটিউবে, তারপর তো সিনেমায়...
অভিনেতা মানেই সুঠামদেহ হতে হবে, চেহারার মধ্যে বাড়াবাড়ি জৌলুশ, চেকনাই থাকতে হবে, জলদগম্ভীর একটা ব্যারিটোন টাইপ ভয়েস থাকতে হবে- এই ন্যারেটিভ থেকে অনেকটাই সরে এসেছে এখনকার দর্শকেরা। ভারতে 'টিভিসিরিজের ডায়মন্ড-যুগ' বইছে। অসাধারণ সব টিভিসিরিজ দখল করেছে নেটফ্লিক্স, এ্যামাজন প্রাইম, সনি'র প্লাটফর্ম। উঠে আসছে ভালো ভালো অনেক অভিনয়শিল্পীও। তাদের মধ্যেই উল্লেখযোগ্য একজন জিতেন্দ্র কুমার। জিতু ভাই। জনপ্রিয় বেশ কিছু টিভিসিরিজে অভিনয় করে যিনি ইতোমধ্যেই চলে এসেছেন লাইমলাইটে।
এ্যামাজন প্রাইমের মিনি টিভিসিরিজ 'পঞ্চায়েত' এ আমি প্রথম দেখি জিতেন্দ্র কুমার কে। গড়পড়তা চেহারা, শুকনো প্যাকাটি এক ছেলে। কিন্তু কথায় তো আছেই- 'ডোন্ট জাজ এ বুক বাই ইটস কাভার', সেটাই আমরা লক্ষ্য করি তার অভিনয়ে। চেহারা খোলতাই না হলেও অভিনয়টা বেশ দুর্দান্ত করলেন তিনি এখানে। এই সিরিজে রঘুবীর যাদব, নীনা গুপ্ত'র মতন দুঁদে অভিনয়শিল্পীদের সাথে পাল্লা দিয়ে তার অভিনয় ছিলো চোখে পড়ার মতনই। 'পঞ্চায়েত' শেষ করার পরে আমার বেশ পছন্দ হয়ে যায় সিরিজটিকে। সে সাথে সরকারী চাকুরে 'অভিষেক ত্রিপাঠি'রূপী জিতেন্দ্র কুমারকেও।
জিতেন্দ্র'র জন্ম রাজস্থানের খৈরতালে। ছোটবেলা থেকেই মিমিক্রি বেশ আয়ত্তে ছিলো তার। নানা পাটেকার থেকে অমিতাভ বচ্চন... সবার গলাই নকল করতে পারতো সে। মানুষজন প্রশংসাও করতো। যখন পড়াশোনা করতে জিতেন্দ্র আসে আইআইটি খড়গপুরে, এখানেও এই মিমিক্রি করেই সবার পরিচিত মুখ হয়ে যায় সে। যেহেতু জিতেন্দ্র ছিলেন আইআইটি খড়গপুরের স্টুডেন্ট, সে হিসেবে তার হওয়ার কথা ছিলো ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু পাকেচক্রে নাম লেখালেন অভিনেতার খাতায়! ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে থাকাকালীনই মঞ্চনাটকে নিয়মিত অভিনয় করতেন জিতু ভাই৷ ইংরেজি ভালো পারতেন না বলে হিন্দি ক্লাবে মঞ্চনাটক করতেন। সেখানে নিয়মিত অভিনয় করেই পোক্ত হয়ে উঠছিলেন। এরকম সময়েই তার দেখা হয় বিশ্বপতি সরকার এর সাথে, যিনি জিতুকে অফার দেন টিভিএফ (দ্য ভাইরাল ফিভার) এ কাজ করার জন্যে। বিশ্বপতি সরকার কে যারা চেনেন না, তাদের বলি, তিনি হচ্ছেন 'দ্য ভাইরাল ফিভার' এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক।
এই অফার লাইফে একবারই আসে। এটা ছেড়ে দেয়া ঠিক হতোনা। জিতেন্দ্র অফার হাতছাড়া করলেনও না। যুক্ত হয়ে গেলেন টিভিএফ এর সাথে। 'মুন্না জাজবাতি' দিয়ে প্রথমবার এলেন পর্দায়। ভাইরালও হয়ে গেলো 'মুন্না জাজবাতি।' কয়েক মিলিয়ন মানুষ দেখলোও এটা। এরপর আরো কয়েকটা চরিত্রে দেখা গেলো তাকে। সে চরিত্রগুলোর মধ্যে 'অরবিন্দ কেজরিওয়াল'কে নকল করে করা চরিত্রটি তাকে আবার ভাইরাল করে দেয়। তবে গোটা ভারতব্যাপী এবং ভারতের বাইরেও জনপ্রিয়তা পান যে টিভি সিরিজে অভিনয় করে, তার নাম- কোটা ফ্যাক্টরী। 'কোটা ফ্যাক্টরি'তে অভিনয় করেই তিনি হয়ে গেলেন সবার প্রিয় 'জিতু ভাইয়া।' যে জিতু ভাইয়া, কোচিং এর সবার প্রিয় শিক্ষক, সবার মোটিভেশন গুরু। আমি যখন 'কোটা ফ্যাক্টরী' দেখি, এর আগেই আমি 'পঞ্চায়েত' দেখে ফেলেছিলাম। তাই, জিতেন্দ্র'র অভিনয়-ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ ছিলোনা। তবে যেটা অবাক করেছিলো, 'পঞ্চায়েত' এর 'অভিষেক ত্রিপাঠি' আর 'কোটা ফ্যাক্টরী'র 'জিতু ভাইয়া' দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন রোল। অথচ দুটিতেই তিনি ছিলেন প্রচণ্ড সাবলীল।
'টিভিএফ পিচার্স' এ 'জিতেন্দ্র মহেশ্বরী' নামের বিষাদগ্রস্ত হতাশ কর্পোরেট এমপ্লয়ার হিসেবে দেখানো হলো তাকে, যে মানুষটি এক স্টার্টাপ নিয়ে পাগলের মত ছুটছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। যারা 'পিচার্স' দেখেছেন, তারা ভাল করেই জানেন, অনেকগুলো চরিত্রের মধ্যেও জিতু ভাইয়া বেশ আলাদা করেই নাম করেছিলেন। এছাড়াও টিভিএফ ব্যাচেলার্স, পার্মানেন্ট রুমমেটস, ইম্যাচিউর... বেশ কয়টি টিভিসিরিজে অভিনয় করেন। বলা বাহুল্য, প্রত্যেকটাতেই ভালো।
তবে শুধু সিরিজেই যে থেমে আছেন তিনি, মোটেও তা না। এরমধ্যে আয়ুস্মান খুরানার সাথে এক সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন। 'শুভ মঙ্গল জায়াদা সাবধান' নামের এ সিনেমা মুক্তি পেয়েছে এ বছরেই। এছাড়াও 'চমনবাহার' নামের এক সিনেমাতে প্রোটাগনিস্ট রোলেও অভিনয় করেছেন জিতেন্দ্র। গন কেশ, শুরুয়াত কা ইন্টারভ্যাল সিনেমাতেও দেখা গিয়েছে তাকে।
তখন সদ্য সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছেন জিতেন্দ্র। ক্লাস করছেন। এরকম সময়েই মুখোমুখি হলেন কলেজ-জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয়ের৷ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের দুর্ধর্ষ র্যাগের ব্যাপারে আমরা তো জানিই। সেই ভয়ানক র্যাগের জন্যে জিতেন্দ্রকে ডাকলেন কলেজের কিছু সিনিয়র। দুরুদুরু বক্ষে সিনিয়রদের রুমে গেলেন তিনি। সিনিয়রেরা বললেন, ইংরেজি লাইন বলতে হবে। আগেই বলেছি, জিতেন্দ্র'র ইংরেজি-জ্ঞান মোটেও ভালো নয়। সে ইংরেজি বলে অনেকটা হিন্দির মতন। কাঁচুমাচু মুখে নিজের ইংরেজি-বিষয়ক অক্ষমতাকে প্রকাশ ফেললেন জিতেন্দ্র। এটা শুনে সিনিয়রেরা বেঁকে বসেন আরো। এবার তো জিতেন্দ্রকে ইংরেজি বলতেই হবে। নিস্তার নেই। আল পাচিনোর বিখ্যাত সিনেমা 'সেন্ট অফ এ উইম্যান' এর একটা লাইন বলতে বলা হয় তাকে। সে দেখে দেখে বলা শুরু করে। দেখে দেখে বললেও বেশ দরদ দিয়ে লাইনগুলো বলেছিলো সে। সিনিয়রেরা অবাক হয়ে যান জিতেন্দ্র'র এই অসাধারণ ডায়লগ ডেলিভারি দেখে। তাকে জোর করেই এরপর নাটকের হিন্দি ক্লাবে ভর্তি করান সিনিয়রেরা। সেখান থেকেই টিভিএফ এর সাথে পরিচয়। জিতেন্দ্র'র উঠে আসা।
জিতেন্দ্র'র অভিনয়ের সবচেয়ে বড় গুন বোধহয় তার অভিনয়ের সারল্য ও ছিমছাম আমেজটাই। এটাতে সওয়ার হয়ে সে যে আরো অনেকদূর যাবে, এ ভবিষ্যদ্বাণী করতে খুব বেশি দূরদর্শী হতে হয় না। জিতুভাইয়ের জন্যে ভালোবাসা ও শুভকামনা তো থাকবেই। আরো সুন্দর সুন্দর কাজ নিয়ে তিনি সামনে আসুক, সস্তা সবকিছুর স্রোতে না ভেসে গিয়ে আলাদা একটা শক্তপোক্ত অবস্থান তৈরী করুক তিনি, এটাই প্রত্যাশা।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন