চ্যাপো গুজম্যান- জেল পালানো যার কাছে ডালভাত!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
কর্তৃপক্ষ জানতো, ধরা পড়লে যেখানেই রাখা হোক, পালানোর চেষ্টা অবশ্যই করবে গুজম্যান। কিন্ত জেনেও ঠেকানো গেল না তাকে! জেলের ভেতরে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে সেখান দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল সে!
মেক্সিকোর সবচেয়ে সুরক্ষিত কারাগার আলতিপ্লানো ফেডারেল প্রিজন। বন্দীদের জন্যে দুর্ভেদ্য এক দূর্গ, এখান থেকে পালানোর নেই কোন উপায়। কারাগারজুড়ে সাজ সাজ রব চলছে ক’মাস ধরেই, মেক্সিকো তথা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মাদক পাচারকারী ধরা পড়েছেন, তাকে বদলী করে রাখা হয়েছে এখানেই। নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে দ্বিগুণ, শুধু এই মানুষটার সেলের সামনেই পালা করে পাহারা দিচ্ছেন আঠারো জন নিরাপত্তাকর্মী। বাইরে মজুদ আছে ট্যাঙ্কও, এই অপরাধীকে ছিনিয়ে নিতে তার দলের লোকেরা হামলা করতে পারে এই আশঙ্কায়!
রাত এগারোটার দিকে উঠলেন মানুষটা। সেলের এক কোনায় দেড় ফুট বাই দেড় ফুটের মতো একটা জায়গা, দুপাশে ঘের দেয়া তিন ফুট উঁচু কাঠের দেয়াল। সেটাই বন্দীর বাথরুম। টলোমলো পায়ে আড়ালটায় গিয়ে বসলেন তিনি। পাঁচ-দশ-পনেরো করে মিনিট পেরিয়ে যাচ্ছে, ওঠার কোন নামগন্ধ নেই তার!
পাক্কা আধ ঘন্টা পরে হুশ হলো নিরাপত্তারক্ষীদের; আরে! লোকটা গেল কোথায়? এতক্ষণ কেউ বাথরুম করে নাকি! ভিডিও অপারেটরের রুম থেকেও মেসেজ এলো, বন্দী কোথায়, দেখা যাচ্ছে না কেন! ডেকে সাড়া পাওয়া গেল না, রাইফেলের ব্যারেল তাক করা হলো সেলের দরজা বরাবর। তালা খুলে ভেতরে ঢুকেই আক্কেলগুড়ুম সবার! কোণার দিকে ছোট্ট জায়গাটায় কমোডটা ভেঙে উপড়ে ফেলা হয়েছে, ভেতরে নিঃসীম অন্ধকার। সেলে বন্দীর কোন পাত্তাও নেই, বোঝাই যাচ্ছে পালিয়েছে কমোডের ভাঙা অংশটা দিয়ে। কিন্ত কিভাবে?
কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোয়, এখানে কমোড খুঁড়তেই বেরুলো সুড়ঙ্গ! তাও যা তা সুড়ঙ্গ নয়, শেষ মাথাটা বেরিয়েছে কারাগারের সীমানা থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে একটি নির্মাণাধীন ভবনে গিয়ে! সুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে মিশে এগিয়েছে সুড়ঙ্গ। মাটির দশ মিটার (৩৩ ফিট) নিচে দিয়ে গিয়েছে সুড়ঙ্গটা, ভেতরের পৃষ্ঠের উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি, আর চওড়ায় ত্রিশ ইঞ্চির মতো। শুধুমাত্র এই লোকটাকে কারাগার থেকে বের করার জন্যেই বিশেষভাবে বানানো হয়েছে এটা, তার উচ্চতা পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি! ভেতরে ছিল কৃত্রিম আলো, এয়ারকন্ডিশনিংয়ের ব্যবস্থা, সুড়ঙ্গের দেয়াল বানানো হয়েছিল উন্নত এবং মজবুত কাঁচামাল দিয়ে, যাতে ধ্বসে পড়ার কোন ঝুঁকি না থাকে। ভেতরে ছিল একটা মোটরসাইকেলও, নির্মাণসামগ্রী আনা নেয়া করা হতো সেটি দিয়ে, এমনকি বন্দী নিজেও সুড়ঙ্গের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত সেটিতে চড়েই গিয়েছেন বলে পুলিশের ধারণা!
সিনেমার কাহিনীকেও হার মানানো এই ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে চার বছর আগে, মেক্সিকোতে। ড্রাগ লর্ড এল চ্যাপো গুজম্যানকে অনেক চেষ্টার পর এক হোটেল থেকে আটক করেছিল মেক্সিকান নেভি, সঙ্গে ছিল ইউএস মার্শাল সার্ভিস। গালফ কার্টেল রিঙের অঘোষিত ঈশ্বর, যার নামে এক ঘাটে জল খায় উত্তর আমেরিকার বাঘ-মহিষ সবাই, হাজার হাজার মানুষের রক্ত লেগে আছে যার হাতে, সেই গুজম্যানকে গ্রেফতার করাটা অবশ্যই কঠিন কাজ, তবে গ্রেফতারের পর তাকে চৌদ্দ শিকের ভেতরে আটকে রাখার কাজটা আরো কঠিন, বলা চলে প্রায় অসম্ভব!
১৯৯৩ সালে গা বাঁচাতে নিজেই প্রথমবার ধরা দিয়েছিলেন, আট বছর জেল খেটেছেন। ২০০১ সালে নিরাপত্তারক্ষীকে ঘুষ দিয়ে খুলিয়ে নিয়েছিলেন সেলের ইলেক্ট্রোফায়েড অটোমেটিক গেট! পরে কারাগারে আসা লন্ড্রীর ভ্যানের পেছনে লুকিয়ে বেরিয়েছিলেন জেলের চৌহদ্দি থেকে। সেই দফায় পালিয়ে কাটিয়েছেন তের বছর। মার্কিন সরকার তখন গুজম্যানের মাথার দাম নির্ধারণ করেছিল পাঁচ মিলিয়ন ডলার!
২০১৪-তে ধরা পড়ে পরের বছর পালানোর ঘটনা তো বলা হলোই। তদন্তকারী কর্মকর্তারা নিশ্চিত, জেলের ভেতরকার ব্লু-প্রিন্ট এবং নিরাপত্তাব্যবস্থার সব তথ্যই ছিল গুজম্যানের কাছে। কর্তৃপক্ষ জানতো, ধরা পড়লে যেখানেই রাখা হোক, পালানোর চেষ্টা অবশ্যই করবে গুজম্যান। কিন্ত জেনেও ঠেকানো গেল না তাকে! টাকা দিয়ে সবাইকে কিনে নিয়েছিল এই ড্রাগলর্ড। পর্যবেক্ষকরা ধারণা করেন, টানের তৈরী এবং জায়গায় জায়গায় ঘুষ দিয়ে খুশী রাখতে পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলারের বেশী খরচ করেছেন গুজম্যান!
এরমধ্যেও থেমে থাকেনি মাদকের ব্যবসা। দিনে দিনে প্রসার বাড়িয়েছে, নিজের কদর্য রূপটা দেখিয়েছে সবাইকে। মেক্সিকোতে প্রতি বছর শুধু মাদকসেবী আর বিক্রেতাদের বিভিন্ন দল-উপদলের মধ্যে বিবাদে প্রাণ হারায় শত শত মানুষ। আহতদের সংখ্যা তো গোনার বাইরে, পথে বসে যায় কত পরিবার! বলা হয়, এসব ঘটনার নব্বই শতাংশই ঘটে গুজম্যানের ইশারায়। মাদকের চোরাচালান জায়গামতো পৌঁছে দিতে যখন খুশি যাকে দরকার মনে করে, মেরে ফেলার নির্দেশ দিতে একটুও ভাবে না এই পিশাচরূপী লোকটা।
সত্তর দশকের শেষ দিকে তার উত্থান, আশির দশকে আমেরিকায় হেরোইন আর মারিজুয়ানা পাচার করে অর্থ আর দুর্নাম- দুটোই কামিয়েছিল বেশ। নিজের পাশবিক হিংস্রতাই তাকে অপরাধ জগতের শীর্ষে তুলে দেয়, সিনাওলা ড্রাগ কার্টেলের শীর্ষ পদে যেতে সময় লাগেনি বেশী। এরপর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে সে, হয়ে উঠেছে উত্তর আমেরিকার ড্রাগ রিঙের সর্বেসর্বা। প্রথম জীবনে কমলা বিক্রি করে পেট চালাত, জন্মেছিল এক হতদরিদ্র পরিবারে, এই মানুষটাই কিনা মাদক পাচার করে সম্পত্তির পাহাড় গড়েছে! তার নামে বৈধ সম্পত্তিই আছে এক বিলিয়ন ডলারের বেশী মূল্যের, অবৈধের হিসেব তো বাদই দিলাম। পালিয়ে ছিলেন পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে, তবে মিডিয়াতে চেহারা দেখিয়েছে মাঝেমধ্যেই।
আলতিপ্লানো থেকে পালানোর পরে হলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা শন পেনকে একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছিল গুজম্যান। সেখানে দম্ভ নিয়ে বলেছিল, ‘যদি ভোক্তারা মাদক না কিনত, তাহলে তো মাদক বিক্রি হতো না। আমি যেদিন থাকব না, সেদিনও মাদকাসক্তের সংখ্যা কমবে না।’ যার পাচার করা মাদকের ছোবলে ধ্বংস হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম, সেই ঘৃণ্য অপরাধীর মুখে এমন গা বাঁচানো কথা অস্বাভাবিক নয় মোটেও।
তবে সুখের খবর এটাই যে, ২০১৬ সালের ৮ই জানুয়ারি নিজের শহর সিনাওলার একটি বাড়ী থেকে এই ড্রাগলর্ডকে গ্রেফতার করেছে মেক্সিকোর মেরিন কমান্ডো এবং ফেডারেল পুলিশ। এক মেরিন কমাণ্ডো প্রাণ হারান ‘অপারেশন ব্ল্যাক সোয়ান’ নামের সেই অভিযানে, নিহত হয়েছিল গুজম্যানের পাঁচ দেহরক্ষী। গুজম্যান এখন আমেরিকার জেলে, মামলা চলছে তার বিরুদ্ধে। তবে কত দিন তাকে আটকে রাখা যাবে, সেটাই দেখার বিষয়। জেল পালানোটা তো তার মতো সাক্ষাৎ শয়তানের কাছে ছেলেখেলা!