যে লোক ফুটবলকে উজাড় করে অনেককিছু দিয়েছেন। তিনি কখনো বিশ্বকাপ জেতেননি। জানি না, মৃত্যুর পর ফুটবল ঈশ্বরের কাছে ৭৪ এর বিশ্বকাপ হেরে যাওয়ার ক্ষতের গল্প শুনিয়েছিলেন কিনা, তার প্রতি নির্মমতা ও অবিচারের কারণ জানতে চেয়েছিলেন কিনা।

সত্তরের দশক, পুরো ফুটবল বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলো 'টোটাল ফুটবল' নামক এক কঠিন দর্শন, মাঠে যার যথার্থ প্রয়োগ করে চলছিলো হল্যান্ড জাতীয় দল। হঠাৎ করে পুরো বিশ্বই যেন বুঁদ হয়ে গেলো এই দর্শনে। বিষ্ময়, প্রশংসা, গবেষণা, মন্তব্য সর্বত্রই। এমনকি ১৯৭০ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলিয়ান দলের কার্লোস আলবার্তো পাহেইরাও বলেছিলেন, 'ফুটবলটা যদি খেলতেই হয়, তাহলে ওদের মতো খেলো।' আর হল্যান্ড এর সকল খেলোয়াড়কে মাঠে এর দর্শনটির বাস্তবিক প্রয়োগে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন স্যার ইয়োহান ক্রুইফ, যা পরবর্তীতে একপ্রকার নব বিপ্লবেই পরিণত হয়। তিনি হয়তো এই দর্শনের জনক নন, কিন্তু মাঠে তা যথাযথভাবে কার্যকর করতে পেরেছিলেন কেবল তিনিই।

ভয়ানক বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপজুড়ে তখন জীবিকার জন্য নিন্ম-মধ্যবিত্তদের অবিরত সংগ্রাম চলছে। এমন এক পরিবারে জন্ম ইয়োহান ক্রুইফের। মুদির দোকানদার বাবা, আর মা ছিলেন সামান্য পরিচ্ছন্ন কর্মী। কে জানতো সেই পরিবারের কোল আলো করে আসা দ্বিতীয় সন্তান, একদিন বিশ্ব ফুটবলে অনুকরণ ও গবেষণায় পরিণত হবে। আয়াক্স তখনো নেদারল্যান্ডসের ক্লাবে শীর্ষ পর্যায়ে ছিল। কিন্তু ততটা উচ্চভিলাষী ক্লাব মোটেও নয় যে ইউরোপ জুড়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু ওই একজন ক্রুইফ যে কোথেকে জুটে গেলেন। আধা পাগল গুরু মিশেল, ক্লাবের খেলোয়াড়দের সামনে টোটাল ফুটবলের দর্শন রাখলেন। এটাই তিনি মাঠে প্রয়োগ করতে চান। কিন্তু বললেই কি হলো! এই কাজ কে করবে, কিভাবে করবে! একসাথে ফ্রন্টে উঠো, একসাথে ডিফেন্সে নামো, আবার নাকি অবিরত পজিশন পরিবর্তন করতে হবে। এতোটা মনোযোগ মাঠে দেয়া কি সত্যিই সহজ, যেখানে সেকেন্ডের পার্থক্যে পজিশন পরিবর্তন করে চলে যেতে হবে?

প্রশ্নটা বোধহয় আয়াক্সের প্রত্যেককেই নিজের মধ্যে করতে হয়েছিলো। তবে মাঠে ক্রুইফ তা সত্যিই করে দেখালেন। যতই কঠিন এই দর্শনকে ভাবা হতো, ক্রুইফ যেন ততোই সাবলীল ছিল মাঠে। ক্রমাগত ডান-বাম ফ্ল্যাংকে পজিশন পরিবর্তন করে খেলছেন, অথচ খেলার মানে কোনো তফাৎ নেই। ডানে বামে, নিচে-সামনে সবদিকে তিনি একইরকম। এই প্রসঙ্গে বলা হয় এভাবে, "Total Football would never have revolutionary movement without the perfect player to implement it and inspire his teammates to do the same. And that perfect player was Johan Cruyff." পরবর্তীতে ক্রুইফের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে আয়াক্স ইউরোপের মঞ্চেও দাঁপিয়ে বেড়াতে লাগলো। ১৯৭৩ সালে যখন ক্লাব ছাড়ার দাঁড়প্রান্তে ক্রুইফ, তখন আয়াক্স হ্যাট্রিক ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরে আছে। যা এক দশক আগেও কল্পনাতীত ছিল। আজও আয়াক্স তাঁকে ভুলেনি। নিজস্ব স্টেডিয়ামের নামকরণ 'ইয়োহান ক্রুইফ এরিনা' করে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছে তাঁকে।

দুই মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে বার্সালোনার কন্ট্রাক্ট সাইন করেছিলেন ক্রুইফ

দুই মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে বার্সালোনার কন্ট্রাক্ট সাইন করেছিলেন ক্রুইফ। আজকের জমানায় অনেক খেলোয়াড় ক্রয় বিক্রির পর যা বেমালুম চা পানির খরচ হিসেবেই বিবেচিত হয়। বার্সালোনায় যোগ দেয়ার আরেকটি কারণ ছিল ক্রুইফের। রিয়াল মাদ্রিদের অতি আভিজাত্য, ক্লাবের প্রতি ধনিক শ্রেণী ও শাসনকর্তাদের অতি তোষামোদি পছন্দ করতেন না ক্রুইফ। অনেকে বলেন, স্পেনের একনায়ক ফ্রাংকোর বিপরীতে থাকার জন্যই বার্সালোনায় গিয়েছিলেন তিনি। একজন পেশাদার ফুটবলের কাছে যেখানে খেলা ও অর্থ মুখ্য, ক্রুইফ এতে ব্যতিক্রম ছিলেন। একধরনের রাজনৈতিক চেতনাও যে তার মধ্যে প্রবলভাবে ছিল এবং সেটি নিয়ে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন, তাই যেন প্রমাণ করে।

বার্সালোনায় খেলেছিলেন মাত্র পাঁচ মৌসুম। এবং প্রাপ্তিও ঠিক উল্লেখ করার মতো নয়, সর্বসাকুল্যে দুটি মেজর ট্রফি। এরপর এদিক ওদিক শেষে, ১৯৮৮ সালে তিনি ফিরলেন বার্সালোনায়। আয়াক্স ছেড়ে এসে নিলেন ন্যু ক্যাম্পের ডাগ আউটের দায়িত্ব। তবে সেই মুহুর্তে ক্লাবের পরিবেশ ছিল যাচ্ছেতাই। নানা ঋণে জর্জরিত, পাশাপাশি ক্লাবের সাথে স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের মধ্যেও কোন্দল চলছিলো ব্যাপক। এক পর্যায়ে তো ক্লাব প্রেসিডেন্ট নুনেজ এর মাথা দাবী করে বসেন বার্সালোনার খেলোয়াড়রা। যেন রীতিমতো যুদ্ধাবস্থা চলছিলো। এর কিছুদিন পরেই ক্লাব ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ পায় ক্রুইফ। ব্যর্থতার অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া বার্সালোনা, ফেলে আসা তেরো মৌসুমে লা লীগা জিতেছিলো মাত্র একবার। কিন্তু ক্রুইফ এসেই যেন পরশপাথরের ছোঁয়ায় বদলে দিলো সবকিছু। দুই মৌসুম পরেই লালীগা শিরোপা তুললেন শোকেসে। তার এক মৌসুম পরেই প্রথমবারের মতো ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন হলো বার্সালোনা। বলতে পারেন, ক্রুইফের হাত ধরেই ইউরোপ ফুটবলের আধিপত্যের মঞ্চে বার্সালোনাও প্রবেশ করলো।

মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে চারবার ইউরোপিয়ান ফাইনাল খেললো তারা। গার্দিওলা-কোম্যান-রোমারিও-লোড্রপদের নিয়ে বানালেন বার্সালোনার স্বপ্নের দল। টানা চার মৌসুম লালীগা জিতলো বার্সালোনা। সিম্পল ফুটবলের নামে নিজের 'Touch and Possession' দর্শন পাকাপোক্ত করলেন তিনি। বলতেন, "Playing football is very simple thing but playing simple football is the hardest thing there is." আট মৌসুম পর স্যাক হওয়ার আগে এগারোটা মেজর ট্রফি ছিল তাঁর প্রাপ্তি। তবে শুধু কয়েক মৌসুমের সফলতা নয় বরং কয়েক দশক পর বার্সালোনা কোথায় দাঁড়াবে, সেই ভিত্তিই যেন তিনি গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। আজ তিন দশক পর বার্সালোনা সত্যিই বিশ্ব ফুটবলে অন্যতম সফল ক্লাব, দামী ক্লাব। সব রকমের তকমা নিয়েই চলছে সেই ক্রুইফের 'Charismatic Approach' এর কারণেই। এ প্রসঙ্গে জাভি বলেছেন, "Cruyff established a very clear philosophy at Barcelona, he gave birth to that philosophy, he created Barça's DNA." আজও অনেকে 'লা মাসিয়া'কে বার্সালোনার একাডেমী নয়, বরং 'ক্রুইফিয়ান স্কুল' বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আর তা আরো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছিলেন নিজের হাতে তৈরি করা প্রিয় শিষ্য পেপ গার্দিওলার ও তার সফলতা। গার্দিওলাও তা অপকটে স্বীকার করেছেন অসংখ্যবার।

বার্সেলোনার আজকের অবস্থানের পেছনে ক্রুইফের অবদান অনস্বীকার্য

সাল ২০১৯, আগস্ট মাস। বার্সালোনা ফুটবল ক্লাব ন্যু ক্যাম্পের সম্মুখে একটি ভাস্কর্য উন্মুক্ত করলো, দেখা গেল স্যার ইয়োহান ক্রুয়েফ দাঁড়িয়ে আছেন এবং কিছু একটা ইঙ্গিত করছেন। এই ভাস্কর্য বার্সালোনায় শুধুমাত্র তাঁর সফলতার জন্য নয়, বরং সেই ক্লাবের কাছে তিনি হলেন 'Spiritual Father'। কোচ কিংবা খেলোয়াড়ের তালিকায় কে সেরা, তা হরহামেশাই পরিবর্তন হয়। কিন্তু 'আধ্যাত্মিক পিতা' বনে যাওয়া, তাও একটি ক্লাবের। সেটি নিশ্চিতভাবেই সবার ভাগ্যে জুটে না, কিংবা শতাব্দীতে হয়তো একজনের ভাগ্যেই জুটে। তবে ক্রুইফের প্রতি বার্সালোনার ঋণ কখনো শোধ হবে না, এমনটাই মনে করেন সাংবাদিক গ্রাহাম হান্টার। তিনি ২০১১ সালে তাঁর বই 'Barça: The Making of the Greatest Team in the World' এ লিখেছিলেন, "বার্সালোনার প্রায় দুই লক্ষাধিক মেম্বার এক লাইনে দাঁড়িয়ে যদি রাতের পর ক্রুইফের পা ম্যাসাজ করে, রাতের খাবার তৈরি করে এবং বিছানা গুছিয়ে দেয়; এমনকি তাদের বাৎসরিক আয়ের পঞ্চাশ শতাংশ দানও করে দেয়, তাও তা ক্রুইফের প্রতি ঋণ শোধের ধারের কাছে যাবে না। যদি তিনি একধরনের সংস্কৃতি, দর্শন ন্যু ক্যাম্পে প্রতিষ্ঠিত না করতো তাহলে তেরো বছর বয়সে লিওনেল মেসিকে ঘরে ফিরে যেতে হতো এবং আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা হয়তো কখনো সুযোগই পেত না।"

৭৪ সালের বিশ্বকাপে ক্রুইফ টার্নের কথা মনে আছে? আজ হয়তো ইউটিউবে দেখে তা আমাদের মুখস্থ। এরকম তিনি একাই ফুটবল মাঠের অনেক মুভমেন্টের স্রষ্টা! মাঠে ক্রুইফ ছিলেন একজন ম্যাজিশিয়ান, ছিলেন জিনিয়াস, ছিলেন "কমপ্লিট প্যাকেজ"! বলতেন, মাথা দিয়ে খেলো। তাহলে পা আপনা আপনিই কাজ করবে। পেলে ছিলেন ডান পায়ের জাদুকর তো ম্যারাডোনা ছিলেন বাঁ পায়ের। কিন্তু ক্রুইফকে বলা হতো, চার পায়ের জাদুকর! আফসোস শুধু একটাই, যে লোক ফুটবলকে উজাড় করে অনেককিছু দিয়েছেন। তিনি কখনো বিশ্বকাপ জেতেননি। জানি না, মৃত্যুর পর ফুটবল ঈশ্বরের কাছে ৭৪ এর বিশ্বকাপ হেরে যাওয়ার ক্ষতের গল্প শুনিয়েছিলেন কিনা, তার প্রতি নির্মমতা ও অবিচারের কারণ জানতে চেয়েছিলেন কিনা। মহাভারতের কর্ণ কিংবা ইলিয়াডের হেক্টর আর ফুটবলের ক্রুইফ যেন একই সূত্রে গাঁথা। নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ যেন হেরেই দিতে হলো।

তারপরেও তো ফুটবল মানেই ইয়োহান ক্রুইফ। ফুটবলকে এতো সমৃদ্ধ তার মতো আর কে করেছে! তাই ফুটবল নিয়ে কষ্টটাও পেতেন বেশি। আধুনিক ফুটবলের অবস্থা নিয়ে হতাশ হতেন। বলতেন, ফুটবল এখন টাকার খেলা। তাই এর মৌলিক উপাদান ও উপলব্ধিগুলো সবাই হারাতে বসেছে।

কোনো বিশেষণই আপনার জন্য শেষ নয়। ফুটবলের ক্ষেত্রতে কোনো প্রশংসায় আপনার জন্য যথেষ্ট নয়। আমাকে যদি বিধাতা এসে কখনো ফুটবল সংক্রান্ত কিছু চাইতে বলতেন, আমি আপনাকে চাইতাম। বিশ্বাস করেন, আমি আপনার মডার্ন ফুটবলের ভক্ত না। আমি আপনার সিম্পল ফুটবলের ভক্ত না। বরং সমালোচক। অসংখ্যবার বলেছি, গার্দিওলা এসব কি খেলান, বিরক্তির উদ্রেক করে কেবল। তারপরেও আমি আপনাকেই চাইতাম। শুভ জন্মদিন স্যার ইয়োহান ক্রুইফ।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা