ছোটবেলাথেকেই কাটিয়েছেন বোহেমিয়ান জীবন। মাদক, ব্যান্ড, বাবা-মা'র বিচ্ছেদ- সবকিছুর প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। এরপর হলেন ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো। শত শত দর্শকের প্রিয় 'মি. স্ট্রেঞ্জ।' সাম্প্রতিক সময়ের বিতর্কে তিনিই আবার টালমাটাল, অনেকে বলছে ক্যারিয়ারটাই শেষ হয়ে গেছে তার। এমন রোমাঞ্চকর, অনিশ্চিত জীবন কি জনি ডেপ চেয়েছিলেন কখনও?

'জনি ডেপ' কে আমার বরাবরেই আত্মভোলা টাইপের দলছুট মানুষ মনে হয়। কিছু মানুষ এরকম আছে না, মানুষের মধ্যে থেকেও একাকী, তাকে আমার কেন যেন সেরকমই মনে হয়েছে বরাবর। তার সাথে প্রথম পরিচয় 'পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান' দেখে। তখন থেকেই তাকে চিনি 'ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো' নামে। তাঁর আসল নাম জেনেছি অনেক পরে। যখন তাকে নিয়ে আরেকটু জানলাম, জানা গেলো- তার আছে আরেকটি নাম; মি. স্টেঞ্চ। এই নামের পেছনের গল্পও অদ্ভুত৷ পাপারাজ্জিদের এড়াতে তিনি এই নাম ব্যবহার করেন সবসময়ে। উদ্ভট কাজকর্মের জন্যেও তিনি বরাবরেই বিখ্যাত। আবার তারই আছে কলঙ্কের গল্প, অনেকটা প্রদীপের নীচের অন্ধকারের মতন। জানবো সবকিছু নিয়েই। 

জনি ডেপের জন্ম কোথায়? বলছি, তার আগে একটা প্রশ্ন করি- কেএফসি'র ফুল ফর্ম টা ক'জন জানেন? কেএফসি'র সাথে জনি ডেপের জন্মস্থানের সম্পর্ক কোথায়? পালটা প্রশ্ন আসতেই পারে। সব প্রশ্নের উত্তরই দিয়ে দিচ্ছি। 'কেএফসি'র জন্মস্থান যেখানে, জনি ডেপের জন্মও সেখানে; উত্তর আমেরিকার কেন্টাকি। কেন্টাকির 'ডেপ পরিবার' এ বাবা জন ক্রিস্টোফার ডেপ ও মা স্যু পালমারের তিন সন্তানের পরে চতুর্থ সন্তান হিসেবে আসেন জনি ডেপ। 

ছোটবেলা খুব যে আহামরি ভালো কেটেছে তার, এমনটা নয়। বাবা-মা'র মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে ঝগড়াঝাটি দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা ছোট্ট জনির। হতাশাগ্রস্ত হয়ে খুব অল্পবয়সেই মাদকের পথে পা বাড়ায় সে। মাদক আর পারিবারিক কলহ যুগপৎ ভাবে এগোয়। অবশ্য মা-বাবা'র খিটিমিটি বেশিদিন তাকে দেখতে হয়নি। মা-বাবা'র বিচ্ছেদ যখন হয়, তখন জনি ডেপ স্কুলের গণ্ডিও পেরোয়নি। হুট করেই ঝোঁক চাপে, গিটার বাজাতে হবে। ব্যান্ডে নাম দিতে হবে। স্কুল বাদ দিয়ে বাড়ির গ্যারেজে ঢুকে সব বন্ধ করে গিটার বাজানো শুরু করলেন। একসময়ে এসে স্কুলও ছেড়ে দিলেন। স্কুল ছেড়ে চলে গেলেন 'দ্য কিডস' নামের ব্যান্ডে। ভ্যাগাবন্ড জনির ব্যান্ডেও বেশিদিন থাকা হলো না। খিটিমিটি শুরু হলো সেখানেও। চলে এলেন ব্যান্ড থেকে। স্কুলে আবার ভর্তি হতে গেলেন।  কিন্তু প্রধান শিক্ষক সাফ জানিয়ে দিলে, স্কুলের দরজা আর খুলবে না জনির জন্যে। 

বোহেমিয়ান জনি বাড়ির জন্যে টান পান না আর, স্কুলের কয়টা বন্ধুবান্ধব ছিলো, সেখানের দরজাও বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে জনি আবার ফিরে যান 'দ্য কিডস' ব্যান্ডের কাছে। বোহেমিয়ান জীবন শুরু করেন আবার। ব্যান্ডে বাজানো শুরু করেন। বেশ কায়ক্লেশে যাচ্ছিলো তখন জীবন। জীবিকার জন্যে এই অখ্যাত ব্যান্ডের উপর নির্ভরশীল হয়ে থেকে জীবনের উপর বিতৃষ্ণাই চলে এলো তার। 'দ্য কিডস' ব্যান্ডের কাছে শো এর অফার আসতো খুবই কম। দেখা যেতো সারারাত জেগে শো করার পরদিন সকালেই আবার অন্য কাজ করতে হচ্ছে ব্যান্ড-সদস্যদের৷ জীবিকার তাগিদে কলমও বিক্রি করতে হয়েছে জনি ডেপকে, বেশ কিছুদিন। 

অল্পবয়স থেকেই ঝড়ঝাপটা দেখে বড় হয়ে ওঠা তার! 

এভাবে কায়ক্লেশে জীবন চলছিলো। এর মধ্যেই করে ফেললেন বিয়ে, নিজের চেয়ে পাঁচ বছরের বড় লরি এলিসনকে।  বিয়ের আগে নাহয় একটা বোহেমিয়ান জীবন ছিলো। বিয়ের পরে সেই জীবনেই আসে খানিকটা শৃঙখলা। পরবর্তী দুই বছরের মাথাতেই জীবনে আসে আরেকটি দৈব পরিবর্তন। যে পরিবর্তনে ঘুরে যায় জীবনেরই মোড়। জনির সাথে পরিচয় হয় বিখ্যাত অভিনেতা ও পরিচালক নিকোলাস কেইজের। নিকোলাস কেইজ ছিলেন জনি ডেপের স্ত্রী লরি এলিসনের প্রাক্তন প্রেমিক।

নিকোলাস কেইজ যখন প্রথমবারের মতন জনি ডেপ'কে দেখেন, বুঝতে পারেন, এই ছেলের মধ্যে কিছু একটা স্বকীয়তা আছে। উদাসীনতা, দুষ্টুমি, ব্যক্তিত্ব... সবকিছু মিলিয়ে কী যেন একটা। কেইজের অনুপ্রেরণা ও সহায়তাতেই জনি ডেইপের অভিনয়ে আসা। 'দ্য নাইটমেয়ার অন এলম স্ট্রিট' দিয়ে প্রথমবার পর্দার সামনে আসেন জনি। খানিকটা খ্যাতি হয় তার। তবে 'জনি ডেপ' প্রথমবারের মতন বড়সড় পরিচিতি পান 'টুয়েন্টি ওয়ান জাম্প স্ট্রিট' সিরিজ এর মাধ্যমে৷ আস্তে আস্তে অভিনয় করেন এডওয়ার্ড সিজরহ্যান্ডস, স্লিপি হলো সিনেমায়। এরপরই ২০০৩ সাল। মুক্তি পায় 'পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান।' জনি ডেপ অথবা 'ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো' ঠিক তক্ষুণি মানুষের হৃদয়ে গেঁথে যান৷ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের একটা উপন্যাস পড়ে একবার বিমল কর মন্তব্য করেছিলেন- 

সঞ্জীবের আর কিছু না লিখলেও চলবে। মানুষ ওকে মনে রাখবে। 

অনেকটা এরকমই হয়ে গিয়েছিলো, 'পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান' এর সময়ে। জনি ডেপ এরপর আর সিনেমা না করলেও চলতো। কিন্তু জনি ডেপ চালিয়ে গেলেন৷ কারণ, চলতে থাকাই নিয়ম। কাজ করেছেন চার্লি এ্যান্ড দ্য চকোলেট ফ্যাক্টরী, অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড, র‍্যাঙ্গো সিনেমাতেও। সুইনি টডঃ দ্য ডিমন বার্বার অফ ফ্লিট স্ট্রিট এর জন্যে তিনি গোল্ডেন গ্লোব পান। 'পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ানঃ দ্য কার্স অব ব্লাড পার্ল' এর জন্যে স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড পুরস্কারও জেতেন। 

ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো; যে চরিত্রটিকে মানুষ মনে রাখবে চিরদিন! 

পর্দার সামনে তিনি ক্রমশ সফল হচ্ছেন এদিকে পর্দার পেছনে তার জীবন নিয়মিত ব্যবধানে বালির বাঁধের মতন ভেঙ্গে পড়ছে। স্ত্রী লরির সাথে ছাড়াছাড়ি হয় অভিনয়জগতে ক্যারিয়ার শুরুর একেবারে প্রথমেই। এরপর সময়ের নানা চলকে জনি ডেপের সাথে যুক্ত হয়েছে অনেক নারীর নাম। কিন্তু কেউই কেন যেন স্থায়ী হননি৷ প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় তার আত্নজীবনী 'বুম্বা, শট রেডি'তে যেমন বলেছিলেন- 

ঈশ্বর পর্দার সামনের জীবনে সবকিছু দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন আমায়। অথচ পর্দার পেছনের আমার জীবনটা বিষাদের এক পান্ডুলিপি। 

উল্লেখ্য- প্রসেনজিৎ এর বিয়ে ছিলো তিনটি। দাম্পত্যজীবন খুব একটা সুখকর হয়নি তার। একই জিনিস আমরা লক্ষ্য করি, জনি ডেপের ক্ষেত্রেও। একেকবার একেকজনের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছেন। সেই বন্ধন খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কাদা ছোড়াছুড়ি হয়েছে৷ বিস্তর। যে ক্লেদাক্ত গল্প একটু পরেই বলবো।

পর্দায় সফল, পর্দার পেছনে ঝড়ঝাপটা চলছে, তাও তিনি কিভাবে কিভাবে যেন নিজের অদ্ভুত পাগলাটে স্বভাব নিয়ে এগোচ্ছিলেন। সেই স্বভাবে আসেনি কোনো ভাটা। সিনেমার শ্যুটিং চলাকালীন হয়তো ডিক্যাপ্রিওকে পঁচা ডিমের গন্ধ শোঁকার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন। মানুষজনকে হয়তো যা পারছেন দান-সাহায্য করছেন নিজের মতন। হিথ লেজারের সম্মানে সিনেমায় অভিনয় করে প্রাপ্ত সম্মানির পুরোটাই দিয়ে দিচ্ছেন তার মেয়েকে। এভাবেই ব্যাখাতীত-অব্যাখাতীত নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় তার অদ্ভুত সুররিয়ালিস্টিক আখ্যান চলছে। 

হয়তো তিনি স্বামী হিসেবে খুব ভালো নন। কিন্তু নিজের মেয়েকে তিনি ভালোবাসতেন নিজের জীবনের চেয়েও বেশি। জনি ডেপের শরীরের ১৩টি উল্কির মধ্যে বুকের বাম পাশে হৃৎপিণ্ডের কাছের উল্কিটিতে মেয়ের নাম লিখিয়েছেন তিনি। একবার মেয়ে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে গেলে হাসপাতালেই ছিলেন পুরোটা সময়। মেয়ে সুস্থ হয়ে গেলে হাসপাতালে গিয়েছিলেন 'ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো'র কস্টিউম পড়ে। চমকে দিয়েছিলেন সবাইকে। মেয়েকে নিয়ে তার ভালোবাসা প্রকাশ পাবে, তারই বলা একটি লাইনে-

Anything I've done up till 27 May, 199 9 was kind of an illusion, existing, without living. My Daughter, the birth of my daughter, gave me life.

এই আবেগে-পাগলামো'তে মিশ্রিত মানুষটিকে নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বিতর্ক কম হচ্ছেনা। জনি ডেপ সর্বশেষ পরিণয়ে আবদ্ধ হয়েছিলেম অ্যাম্বার হার্ডের সাথে। যেই সম্পর্কও টেকেনি। ২০১৫ সালে বিয়ের পরে ২০১৬ সালেই ডিভোর্স হয়ে যায় তাদের। তবে এই সম্পর্কের বিতর্ক সবচেয়ে বেশি জলঘোলা করেছে আশপাশ। ২০১৬ সালে অ্যাম্বার কোর্টে যান৷ ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের অভিযোগ করেন স্বামী জনি ডেপের বিরুদ্ধে। জনি ডেপ তার গায়ে হাত তুলতেন, গালিগালাজ করতেন এমনকী মেরে ফেলারও হুমকি দিতেন বলে জানান অ্যাম্বার। যদিও এ অভিযোগকে 'অসত্য' বলেছিলেন জনি ডেপ। পরবর্তীতে দুইজনের বিচ্ছেদের মাধ্যমে এই বিতর্কের অবসান ঘটে।

কিন্তু চার বছর পরে আবারও সেই বিতর্ক মাথাচাড়া দেয়। অবশ্য এবারে বিতর্কের সঞ্জীবনীর পেছনে জনি ডেপ নিজেই কুশীলব৷ তিনি ব্রিটিশ নিউজপেপার 'দ্য সান' এর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন৷ ট্যাবলয়েড 'দ্য সান' বেশ ভালোভাবেই আক্রমণ করেছিলো জনি ডেপকে। তাকে স্ত্রী-নির্যাতক সহ নানা উপমাও দিয়েছিলো সংবাদপত্রটি। এটা নিয়েই খেপে গিয়েছেন জনি ডেপ। 'মানহানি'র মামলা করেছিলেন 'দ্য সান' এর বিপক্ষে। যদিও আদালত 'দ্য সান' এর সংবাদকে সত্যি  বলেই অভিহিত করেছেন। কিন্তু জনি ডেপের ভক্তরা বিশ্বাস করেন- জনি ডেপ নির্দোষ। তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী'ই মিথ্যাচার করছেন পত্রিকার সাথে মিলে। কোর্টের রায়কেও মানছেন না তারা। 

ডেপ-অ্যাম্বার বিতর্কে জলঘোলা কম হয়নি মোটেও! 

তবে যেটাই হোক, এই বিতর্ক জনি ডেপের ইমেজে যে বেশ ভালোই একটি দাগ ফেলেছে, তার সবচেয়ে বড় নিদর্শন হয়তো বিখ্যাত 'ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস' ফ্রাঞ্চাইজি থেকে তাঁর বাদ পড়ে যাওয়া।  যদিও জনি ডেপের দাবী, এই সিদ্ধান্ত তার ক্যারিয়ারকে খুব বেশি প্রভাবিত করবেনা। তিনি আবার ফিরবেন। 

জনি ডেপ এখনও হলিউডের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত অভিনেতাদের অন্যতম। এখনো তার সিনেমার জন্যে পাগলের মত অপেক্ষা করে লাখো কোটি দর্শক। এখনো জনি ডেপ বিশ্বাস করেন, তিনি ফুরিয়ে যান নি। আমরা জানি না, ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো ভাঙ্গা জাহাজের গলুইয়ে পা রেখে অকেজো কম্পাসে দিক-নির্নয়ের ব্যর্থ চেষ্টা করে আবার ফিরবেন কী না। আমরা জানি না, নিভু নিভু হয়ে থাকা ধ্রুবতারা আবার দপ করে জ্বলে উঠবে কী না। তবে আমরা চাই, সব বিতর্ক কাটিয়ে এই অভিনেতা আবার ফিরুক। পর্দার পেছনের জীবনের বিতর্ক, পর্দার সামনের মানুষটিকে গুঁড়িয়ে না দিক। সমালোচনা হোক সমালোচনার মাধ্যমেই। তিনি অপরাধ করলে তিনি শাস্তি পাক, এটাও চাই। কিন্তু সেটা যেন যতটুকু প্রাপ্য, ততটুকুই হয়। একজন শিল্পীর 'শিল্পীসত্ত্বা' কেড়ে নেয়ার মতন অমোঘ শাস্তি না হোক।

বড্ড অন্যায় হবে সেটি৷ 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা