মা মারা গেছেন বিনা চিকিৎসায়, স্ত্রী ছেড়ে চলে গেছে। জজ মিয়ার জীবন থেকে অনেকগুলো বছর হারিয়ে গেছে, তার মস্তিস্কে জড়ো হয়েছে ভয়াল সব স্মৃতি। কী অপরাধ ছিল জজ মিয়ার?

একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার রায় হয়েছে ২০১৮ সালে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর সহ ১৯ জনকে ফাঁসি আর তারেক রহমান ও হারিস চৌধুরী সহ মোট উনিশ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দিয়েছে আদালত। নৃশংস সেই হামলার ঘটনায় আহত আর নিহত মানুষগুলো বিচার পেয়েছেন, ঘটনার চৌদ্দ বছরেরও বেশি সময় পরে! কিন্ত একজন মানুষ এখনও বিচার পাননি। তার সাথে ঘটে যাওয়া জঘন্য কিছু ঘটনার বিচার হয়নি এখনও। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার সঙ্গে নিরীহ এই মানুষটার কোন সম্পর্কই ছিল না, অথচ সরকারী মদদে তাকে আসামী বানানো হয়েছিল এই মামলায়, তার জীবনটাকে নরক বানিয়ে দেয়া হয়েছিল, স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্যে তার ওপর দিনের পর দিন ধরে চালানো হয়েছিল অবর্ণনীয় অত্যাচার। তার নাম জজ মিয়া। 

২০০৪ সালে জালাল উদ্দিন নামের এক যুবক থাকতেন ঢাকার নাখালপাড়ায়। ইনিই আমাদের জজ মিয়া, তবে তার জালাল উদ্দিন নামটা ঢাকা পড়ে গেছে ঘটনার আড়ালে। নাখালপাড়ায় ভাঙাড়ির দোকান ছিল তার। ব্যবসা খারাপ যাওয়ায় সেটা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এরপরে গুলিস্তানের ফুটপাতে সিডি-ক্যাসেট বিক্রি করতেন। একুশে আগস্ট যখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হলো, জজ মিয়া তখন তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালিতে। সেখানেই বিকেলে বাজার করতে গিয়ে শুনলেন এই ঘটনা। 

স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মীরা তখন এলাকায় প্রতিবাদী মিছিল বের করেছে, তিনিও যোগ দিয়েছিলেন সেই মিছিলে। ঘটনার দিন দশেক বাদে ঢাকায় এলেন জজ মিয়া। কিন্ত মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে কিছুদিন পরেই তাকে আবার গ্রামে যেতে হলো। 

নোয়াখালির সেনবাগ থানার বীরকোট গ্রামে জজ মিয়ার পৈত্রিক বাড়ি থেকে হামলার প্রায় দশ মাস পরে, ২০০৫ সালের ৯ জুন গ্রেফতার করা হয় জজ মিয়াকে। তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। গ্রেনেড হামলার ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তারা দাবী করেন, জজ মিয়াই একুশে আগস্টের ঘটনার মূল হোতা! জজ মিয়ার মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়েছে। কী থেকে কী হয়ে গেল, ঘটনা কোনদিক থেকে কোন দিকে গড়াচ্ছে কিছুই তখন বুঝতে পারছিলেন না তিনি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, সরকার মূল ঘটনা আড়াল করার জন্যে নীরিহ জজ মিয়াকে গ্রেফতার করে নাটক সাজাচ্ছে।

জজ মিয়া

আসলে কিন্ত সেটাই হয়েছিল। নোয়াখালীতে জজ মিয়াকে আটক করা হয়েছিল মাদকের মামলা দেখিয়ে। তারপর ঢাকায় এনে একুশে আগস্টের ঘটনায় অভিযুক্ত করা হয় তাকে। সিআইডির কার্যালয়ে এনে রাখা হলো দশদিন, ভয়ভীতি দেখানো হলো, স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্যে। আদালতে রিমান্ড মঞ্জুর করা হলো, রিমান্ডে তার ওপর চালানো হলো অকথ্য নির্যাতন। তাকে বারবার বলা হলো, একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার সঙ্গে তিনি জড়িত- এমন স্বীকারোক্তি দিলেই শুধু প্রাণে বাঁচতে পারবেন জজ মিয়া। মেরে তার হাত পা ভেঙে দেয়া হয়েছিল। জজ মিয়া বলছিলেন-

“আমাকে প্রথমে বলা হয়েছে, এই হামলা আমিই করেছি। কারা কারা জড়িত তাদের নাম জানতে চাইতো। আমি বরাবরই অস্বীকার করতাম। এক সময় তারা আমাকে ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা স্বীকার করার জন্য নির্যাতন করা শুরু করল। এমনও দিন গেছে তারা আমাকে দীর্ঘক্ষণ ফ্যানের সিলিংয়ের সাথে ঝুলিয়ে রাখত আর পায়ের তালুতে পেটাত। সিআইডির কর্মকর্তারা বলতেন, এই ঘটনার সুরাহা করতে উপর থেকে যথেষ্ট চাপ আছে, স্বীকার না করলে আমাকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হবে। আমাকে মেরে ফেললে মা-বোনের ক্ষতি হয়ে যাবে ভেবেই পুলিশ কর্মকর্তাদের কথায় রাজি হয়ে যাই। মিথ্যা বলে যদি বাঁচা যায় সেটাই ভালো মনে করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে হয়েছে আমাকে। তারা বলত, পুলিশের কথায় রাজি হলে সারা-জীবন টাকা-পয়সা নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।”

আটক জজ মিয়াকে লিখিত বক্তব্য মুখস্ত করানো হতো, ঘটনার ভিডিও দেখানো হতো বারবার। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে রাজী হবার পরে তার ওপর অত্যাচার চালানো বন্ধ হয়, তখন তাকে শেখানো হয় কীভাবে আদালতে নিখুঁতভাবে জবানবন্দী দিতে হবে। জবানবন্দিতে সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ ও মুকুলসহ বেশ কয়েকজনের নাম বলতে বলা হয়েছিল জজ মিয়াকে। যদিও তিনি কোনদিন এদেরকে দেখেননি। শুধু সিআইডির হেফাজতে থাকার সময় এদের ছবি দেখানো হয়েছিল তাকে। সিআইডি পুলিশের শিখিয়ে দেওয়া জবানবন্দিতে জজ মিয়া এসব সন্ত্রাসীদের নাম উল্লেখ করে বলেছিলেন, পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে ওই সব ‘বড়ভাইদের নির্দেশে’ তিনি গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিলেন। 

জবানবন্দীতে জজ মিয়া যাদের নাম উল্লেখ করেছিলেন, তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে জেলেই দেখা হয়ে গিয়েছিল জজ মিয়ার। সেই সন্ত্রাসী তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন তিনি জবানবন্দীতে তার নাম বলেছেন। 'পুলিশ শিখিয়ে দিয়েছে' ছাড়া আর কিছু বলার ছিল না জজ মিয়ার। মামলা চলাকালে জজ মিয়ার পরিবারকে সিআইডির পক্ষ থেকে অর্থসাহায্য দেয়া হতো। প্রতিমাসে জজ মিয়ার মা'কে ঢাকায় এনে তার হাতে তিন/চার হাজার টাকা তুলে দিতেন সিআইডির কর্মকর্তা আবদুর রশিদ, রুহুল আমিন এবং আরও কয়েকজন। জজ মিয়াকে আটকের সেই নাটক সাজিয়ে এরা এক কোটি টাকার সরকারী পুরস্কার হাতিয়ে নিয়েছিলেন। 

২০০৮ সালে জজ মিয়াকে আসামী করে এই মামলার চার্জশীট দেয়া হয়। পরে অবশ্য চার্জশীট থেকে তার নাম প্রত্যাহার করে নেয়া হয়, তাকে রাজসাক্ষী বানানো হয় এই ঘটনায়, আসামী করা হয় তাকে আটককারী পুলিশ অফিসারদের, সেইসঙ্গে আরও আসামী হন ঘটনার মূল হোতা তারেক রহমান, হারিস চৌধুরী এবং লুৎফুজ্জামান বাবরেরা। প্রায় পাঁচ বছর জেল খাটার পরে মুক্তি পান জজ মিয়া, এরমধ্যে বেশিরভাগ সময় তাকে কাটাতে হয়েছে কনডেম সেলে, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর মতো। তার হাতে-পায়ে বেড়ি বাঁধা থাকতো তখন। 

২০১৪ সালে আদালতে সাক্ষ্য দেন তিনি 

সময় কেটে গেছে। জজ মিয়া এখন মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেন। আর যারা তাকে ফাঁসিয়ে দিতে চেয়েছিল, তার ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়েছিল, তারাই এখন জেলের চৌদ্দশিকের ভেতরে। কারো ফাঁসির রায় হয়েছে, কেউবা বিদেশে পালিয়ে আছে। জজ মিয়া এখন মোটামুটি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন। ঢাকায় ড্রাইভিং করে সংসার চালান তিনি। অতীতের স্মৃতিগুলো তিনি আর স্মরণ করতে চান না। তবুও সেগুলো ফিরে ফিরে আসে। 

কোন এক রাতে হয়তো দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় জজ মিয়ার, সেই দুঃস্বপ্নে তিনি নিজেকে আবিস্কার করেন কনডেম সেলের ছোট্ট কুঠুরীটার ভেতরে। নিরীহ নিরপরাধ একটা মানুষকে ধরে দিনের পর দিন অত্যাচার করা হয়েছে, যে অপরাধ তিনি করেননি সেটা স্বীকার করার জন্যে মারধর করা হয়েছে তাকে, মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়েছে তাকে এবং তার পরিবারের সদস্যদের। এই ঘটনার বিচার কি হয়েছে? রাষ্ট্র কি জজ মিয়াকে কোন ক্ষতিপূরণ দিয়েছে? 

জজ মিয়া বিয়ে করেছিলেন চাঁদপুরে। নিজের জালাল উদ্দিন নামে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। তিনিই একুশে আগস্টের ঘটনায় আটক জজ মিয়া- এটা জানতে পেরে তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। নামের কারণে তাক নিয়ে হাসি-তামাশা করা হয়েছে। এলাকা ছাড়তে হয়েছে তাকে। জজ মিয়ার মা মারা গিয়েছিলেন বিনা চিকিৎসায়, নিজের ছেলের মুখটাও শেষবারের মতো দেখতে পাননি ভদ্রমহিলা। 

জজ মিয়ার জীবন থেকে অনেকগুলো বছর হারিয়ে গেছে, তার মস্তিস্কে জড়ো হয়েছে ভয়াল সব স্মৃতি। সেই দিনগুলো কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না, কিন্ত রাষ্ট্র তো পারে জজ মিয়ার পাশে দাঁড়াতে। বাকী জীবনটা যাতে তিনি সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করা তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সেই দায়িত্বটা রাষ্ট্র ঠিকঠাকভাবে পালন করুক, এটাই আমরা চাই।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা