মেসি সংকট কেটে যাবে হয়তো, মেসি থাকবেন, অথবা চলে যাবেন। কিন্ত অব্যবস্থাপনা, লা মাসিয়াকে ধ্বংস করা, খেলোয়াড় কেনাবেচা বা কোচ নিয়োগে স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বার্সেলোনার ইতিহাসে সবচেয়ে অদক্ষ আর অযোগ্য প্রশাসক হিসেবে যে বার্তোমেউর নামটা লেখা থাকবে, সেটা মোটামুটি নিশ্চিত...

২০১৪ সালে নেইমারের ট্রান্সফার নিয়ে অস্বচ্ছতার অভিযোগে বার্সেলোনার ইতিহাসের অন্যতম সফল প্রেসিডেন্ট সান্দ্রা রোজেল যখন পদত্যাগ করলেন, তখন তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেপ মারিয়া বার্তোমেউ, সেটা ছিল ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব। পরের বছর পূর্ণকালীন সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হলেন। তার অধীনে প্রথম মৌসুমেই ট্রেবল সহ পাঁচটা ট্রফি জিতেছিল বার্সেলোনা। ২০১৪-১৫ মৌসুম শেষে ন্যু ক্যাম্পে এক সেলিব্রেশন পার্টিতে দাঁড়িয়ে বার্তোমেউ ঘোষণা দিয়েছিলেন, লিওনেল মেসি বার্সেলোনা থেকেই পেশাদার ফুটবলকে বিদায় জানাবেন।

অথচ অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, সেই বার্তোমেউর কারণেই মেসি আজ বার্সেলোনা ছাড়তে চাইছেন, অব্যস্থাপনা আর খামখেয়ালিপনার যে অনন্যসাধারণ নজির স্থাপন করেছেন বার্তোমেউ, তার ফল হাতেনাতে পাচ্ছে বার্সা, ক্লাবের স্ট্রাকচার বলে কিছু নেই আর, ভেঙ্গে পড়েছে সবটাই। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, মেসি এখন আর বার্তোমেউর মুখদর্শনও করতে চাইছেন না। এদিকে সমালোচনায় বিদ্ধ বার্তোমেউ বাধ্য হয়ে মেসিকে বলছেন, আমার ব্যাপারে তোমার কোন আপত্তি থাকলে সরাসরি বলো, আমি পদত্যাগ করব। তবে শোনা যাচ্ছে, বার্তোমেউর পদত্যাগও নাকি আটকে রাখতে পারবে না মেসিকে!

গত ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে বার্সেলোনার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বার্তোমেউ। তবে দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে একটা সময়ে 'মোর দ্যান এ ক্লাব' বলে যে বার্সেলোনার সুনাম ছিল, সেটাকে ধ্বংস করার জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই বার্তোমেউ করেছেন- এমনটাই বেশিরভাগ ফুটবল বোদ্ধার অভিমত। দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের বিক্রি করে দেয়া, নিজেদের একাডেমি লা মাসিয়ার গ্র‍্যাজুয়েটদের গুরুত্ব না দেয়া, বোর্ডে নিজের আলাদা বলয় তৈরি করে বাকীদের কোণঠাসা করে রাখা, খেলোয়াড় কেনাবেচা এবং কোচ নির্বাচনে নিজের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া সহ অজস্র কারণে বার্তোমেউর বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমেছে বার্সেলোনার খেলোয়াড়-কর্মকর্তা এবং সমর্থকদের মনে, মেসির ক্লাব ছাড়ার ঘোষণায় এখন তাই ফুঁসে উঠেছে সবাই, ন্যু ক্যাম্পের সামনে চলছে বার্তোমেউর পদত্যাগের দাবীতে স্লোগান, সোশ্যাল মিডিয়াতে চালু হয়েছে বার্তোমেউ আউট হ্যাশট্যাগ!

মেসি-বার্তোমেউ সম্পর্কটা এখন আর মধুর নেই

অথচ বার্তোমেউ যে বার্সেলোনার জন্য এমন অশণি সংকেত বয়ে আনবেন, সেটা প্রথম মৌসুম শেষেও বোঝা যায়নি। বুঝতে দেননি লুইস এনরিকে। সেই মৌসুমেই কোচ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন এনরিকে, বার্সেলোনার সাবেক এই ফুটবলারের অধীনে লা লিগা, স্প্যানিশ কাপ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ট্রেবল শিরোপা জিতেছিল বার্সা, ২০০৯ এ পেপ গার্দিওলার বার্সেলোনার পরে আরও একবার ন্যু ক্যাম্পে এসেছিল ট্রেবল। দলের খেলার ধরণেও ছিল জেতার তাড়না, যে কোন মূল্যে পয়েন্ট না হারানোর আকাঙ্ক্ষা। পরের মৌসুমে এনরিকে বিদায় নিতেই ভোজবাজির মতো বদলে যেতে থাকলো সব, বেরিয়ে এলো বার্তোমেউর আসল চেহারাটা।

বার্তোমেউ সম্ভবত চেয়েছিলেন রিয়ালের প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের মতো হতে। ট্রান্সফার মার্কেটে পেরেজকে বলা হয় জহুরী, রিয়ালের জন্য এমন সব দুর্দান্ত সাইনিং তিনি করিয়েছেন, অন্যের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছেন বেশ কয়েকবার- যে কীর্তি ক্লাব ফুটবলে আর কোন প্রেসিডেন্টের নেই। বলা হয়, পেরেজ একবার কোন ফুটবলারকে কিনতে চাইলে তাকে কিনে তারপরেই ছাড়েন। বার্তোমেউ হতে চাইলেন বার্সার পেরেজ, কিন্ত ভুলে গেলেন, ব্যবসায়িক প্রজ্ঞা বা ফুটবল ম্যানেজমেন্টে মেধার দিক থেকে তিনি কখনও পেরেজের ধারেকাছেও ছিলেন না।

নেইমারকে আচমকা বিক্রি করে দিলো বার্সেলোনা, নেইমার ক্লাবে থাকতে চাইছিলেন না সত্যি, কিন্ত তাকে আটকে রাখার চেষ্টাও বার্তোমেউ করেননি, কারণ পিসজি তখন উঠেপড়ে লেগেছে নেইমারকে দলে ভেড়াতে, ব্রাজিলিয়ান এই সেনসেশনকে ধরে রাখার পরিবর্তে বার্তোমেউর চোখে তখন মিলিয়ন ডলারের অঙ্কগুলোই ভাসছিল। রেকর্ড সাইনিংয়ে নেইমার গেলেন প্যারিসে, কিন্ত তার অভাব আজও পূরণ হয়নি, বার্তোমেউ নতুন সাইনিং করিয়েছেন শুধু, বেশি দামে বিশাল বেতনে দলে তারকা এনেছেন, তাতে ফল আসেনি, ইউরোপিয়ান প্রতিযোগীতায় বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে বার্সেলোনা।

ফিলিপ কৌতিনহো- বার্সেলোনার ইতিহাসের অন্যতম ব্যর্থ সাইনিং

গত ছয় বছরে এমন একজন ফুটবলার বার্সেলোনায় আসেননি, যাকে নিয়ে বার্তোমেউ গর্ব করে বলতে পারবেন যে, একে তো আমি এনেছিলাম! একশো আশি মিলিয়নের কৌতিনহোকে বায়ার্নে পাঠানো হয়েছে ধারে, তাদের হয়ে তিনি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে ফেলেছেন, অথচ বার্সেলোনা তাকে ব্যবহার করতে পারেনি, বার্সার খেলার ধরণের সঙ্গে কৌতিনহো মানিয়ে নিতে পারেননি। ১২০ মিলিয়ন ইউরোতে কেনা গ্রীজম্যানও ফ্লপ। ডেম্বেলে, গোমেজ, ভারমালেন, জেরোমি ম্যাথিউ, আরদা তুরান- কেউই নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। এদের সবাইকেই দলে ভিড়িয়েছিলেন বার্তোমেউ।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, খেলোয়াড় কেনার আগে বার্তোমেউ তার পরিসংখ্যান আর তারকাখ্যাতির দিকেই নজর দিয়েছেন বারবার। স্কাউটদের রিপোর্ট সম্ভবত পড়েও দেখেননি। সেই ফুটবলার স্পেনে মানিয়ে নিতে পারবে কিনা, বার্সেলোনার পাসিং ফুটবলের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে কিনা, মেসিকেন্দ্রিক ফুটবল ট্যাকটিকসের সঙ্গে সে কতটা মানানসই হবে- সেসব ভাবেনইনি তিনি। শুধু ভেবেছেন, নেইমারকে বিক্রির পর হাতে কাঁচা টাকা এসেছে, কৌতিনহোকে আনতে হবে, গ্রীজম্যানকে এনে কয়েক মিলিয়ন ডলারের জার্সি বিক্রি করতে হবে।

স্বাভাবিকভাবেই তারকা ফুটবলারেরা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি বেতন হাঁকিয়েছে, বার্তোমেউ পরোয়া করেননি, সাইন করে নিয়ে এসেছেন। সেটার মূল্য চুকাতে গিয়ে এখন বার্সেলোনা পড়েছে ঋণে, স্কাউট কার্যক্রম বন্ধ করে বেতন পরিশোধ করতে হচ্ছে খরচ বাঁচানোর জন্য! গত ছয় বছরে বার্সেলোনা ট্রান্সফার মার্কেটে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, ম্যানসিটি বা পিএসজিও এত টাকা খরচ করেনি এই সময়ের মধ্যে! পানির মতো টাকা ঢেলেও ফল আসেনি ন্যু ক্যাম্পে, কারণ বার্তোমেউ টাকা খরচ করেছেন অপাত্রে।

নিজের একক সিদ্ধান্তেই সেতিয়েনকে কোচ বানিয়েছিলেন বার্তোমেউ

কোচ নিয়োগেও বরাবরই নিজের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েছেন বার্তোমেউ, বোর্ড মিটিং ডেকেছেন আলোচনা করার জন্য নয়, নিজের সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য। ফুটবলারেরা কি চায়, কোচিং স্টাফরা কি বলছে, সেসবকে আমলে নেননি। কিকে সেতিয়েনকে কোচ বানানোর সিদ্ধান্তটা তো তার একার ছিল। সেতিয়েনেের অধীনে শিরোপাশূন্য একটা মৌসুম কাটিয়েছে বার্সেলোনা, বায়ার্নের কাছে হজম করেছে আট গোল। ইউরোপীয় পর্যায়ে কোন ধরনের সফলতা না থাকা একজনকে বার্সেলোনার মতো ক্লাবের কোচ বানানোর আগে একবারও ভাবেননি বার্তোমেউ।

মেসিকে বার্সেলোনাই বিশ্বের সেরা ফুটবলার বানিয়েছে, মেসিও বার্সেলোনাকে এনে দিয়েছেন অজস্র শিরোপা, সম্মান। সেই মেসি ক্লাব ছাড়তে চাইছেন, তাকে সসম্মানে বিদায় জানানোটা ছিল প্রেসিডেন্ট হিসেবে বার্তোমেউর দায়িত্ব। কিন্ত ঘাড়ত্যাড়া স্বভাবের এই লোক মেসিকে যেতে দিতে রাজী নন, তিনি পড়ে আছেন চুক্তির শর্ত নিয়ে, মেসিকে ধরে রাখার জন্য দরকার হলে আদালতে যেতেও তিনি প্রস্তত! বার্তোমেউ এটা বোঝার চেষ্টা করছেন না যে, বাবা-সন্তানের সম্পর্কটা আদালতে মিটমাট হবার নয়। সমস্যা থাকলে সেটা ঘরেই শেষ হওয়া ভালো। এই পরিস্থিতিতে বার্তোমেউর ডিক্টেটরশিপের বিপক্ষে প্রতিবাদ করে ক্লাবের সহ সভাপতি সহ ছয়জন বোর্ড পরিচালক পদত্যাগ করেছেন, তারা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগও এনেছেন বার্তোমেউর বিরুদ্ধে।

২০১৪ সালে যখন ক্লাবের দায়িত্ব নিচ্ছিলেন, তখন কেউ কল্পনাই করেনি যে জোসেপ মারিয়া বার্তোমেউ নামের মানুষটার জন্য বার্সেলোনা এমন পরিস্থিতিতে পড়বে একদিন। মেসি সংকট কেটে যাবে হয়তো, মেসি থাকবেন, অথবা চলে যাবেন। কিন্ত বার্সেলোনার ইতিহাসে সবচেয়ে অদক্ষ আর অযোগ্য প্রশাসক হিসেবে যে বার্তোমেউর নামটা লেখা থাকবে, সেটা মোটামুটি নিশ্চিত...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা