অথচ, কৈলাশ খের আত্মহত্যাই করতে চেয়েছিলেন...
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
কৈলাশ খের, যার কণ্ঠটাই মাদকতায় পরিপূর্ণ, যার গান আমাদের কানকে তৃপ্তি দেয়, মনকে শান্ত করে৷ অথচ এই মানুষটাই নিজের অশান্ত মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন...
"আজ যদি সেদিনের ছেলেটার সঙ্গে আমার দেখা হত, আমি ওকে আত্মহত্যা করতে যাওয়া থেকে আটকাতাম।" - কথাটা বলেছিলেন কৈলাশ খের। ভারতের গায়ক, যিনি সুফি/ফোক ঘরানার গান গেয়ে তুমুল জনপ্রিয়। তবে, এই আজকের এত পরিচিতি, প্রাপ্তি এতসব খুব সহজে আসেনি। সব সফল মানুষের জীবনের একটা অন্ধকার অধ্যায় থাকে। সেই অধ্যায়টুকু পার করা কঠিন, তবে দুঃসহ সেই অধ্যায়গুলোর শেষেই আলোর অপেক্ষা, কৈলাশ খেরের জীবনেও আছে এমনি এক অধ্যায়, যা পেরিয়ে আজকে তিনি কৈলাশ খের হয়ে উঠেছেন।
এখন তার উপলব্ধি হয়েছে। তাই এখন অল্পবয়সের সেই দিনের কথা, সেই মানসিক অবস্থার কথা বেশ ভাল মনে পড়ে। বয়স কত তখন, হবে সাতাশ হয়ত। সেই সময়ে ভয়ানক ডিপ্রেশন হলো একটা ছেলের। মরে যেতে ইচ্ছে হয় শুধু। কারণ, জীবনের সবচেয়ে বাজে সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো সে। গান, টান কিছু না কৈলাশ খের প্রাথমিক জীবনে ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। সেভাবে কখনো ভাবেননি, গানের দুনিয়ায় আসবেন।
কিন্তু, কপালের ফের। ব্যবসায়ে দারুণ লস হয়। এতটাই যে কৈলাশ খের দিশেহারা হয়ে যান, কিভাবে এই ক্ষতি সামাল দিবেন ভেবে। এই আর্থিক ক্ষতিটুকু তিনি নিতে পারেননি। তার মনে হলো, এই দুনিয়ায় তার জন্য ভাল কিছু নেই। বেঁচে থাকা অর্থহীন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, আত্মহত্যা করবেন। করেই ফেলেছিলেন বলতে গেলে, নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন। বেঁচে থাকার সব খড়কুটো, আশা, ভরসা ছেড়ে চেয়েছিলেন ডুবে মরে যেতে।
সেই কৈলাশ খের আজকের দিনে এত বিখ্যাত গায়ক! হয়ত পৃথিবী কৈলাশ খেরের গল্পটা এভাবেই সাজিয়ে রেখেছিল। সবার জন্যেই বোধহয় কিছু না কিছু গল্প পৃথিবী তৈরি করে রাখে, সবার জন্যই কিছু না কিছু ক্লাইম্যাক্স থাকে৷ কিন্তু, সবাই কি গল্পের শেষটা দেখার জন্য ধৈর্য রাখতে পারে? গল্পের শেষটা তো কৈলাশ খেরের মতোও হতে পারে, তাই না? গানের লাইনে আসার আগে এক্সপোর্টের ব্যবসা ছিল তার, দিল্লীতে। এর আগে ছোট খাটো খুচরা চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করত সে। তারপর অনেক স্বপ্ন নিয়েই আসা এই ব্যবসায়ের জগতে। কিন্তু সমস্যা কখনোই তাকে পিছু ছাড়েনি। প্রায়ই নানানরকম জটিলতায় পড়তে হতো তাকে। তবে, তখন খুব করে চেষ্টা করত সে, খারাপ সময়গুলো কাটিয়ে ওঠার জন্যে।
কিন্তু সাতাশ বছর বয়সটাই কাল হলো তার জন্যে। এই বছর জীবনের সবচেয়ে নির্মম রুপ দেখা হয়ে গেল তার। ব্যবসায়ে মারাত্মক লসের মুখে পড়তে হয় তাকে। অনেকগুলো টাকা হারান তিনি। যার জীবন কখনোই এত সহজ ছিল না, সবসময়ই লড়াই করে টিকে থাকতে হয়েছে, তার জন্যে এত বড় আঘাত জীবন সম্পর্কে বিতৃষ্ণা আনবার জন্য কি যথেষ্ট না? কৈলাশ খেরেরও সেটাই মনে হলো। সে টানা একটা বছর গভীর বিষাদে ভারাক্রান্ত। কিছুই ভাল লাগে না তার৷ এতগুলো টাকার চাপ, লড়াই করতে করতে নিজেকে তার ক্লান্ত যোদ্ধার মতো মনে হয়।
একসময় পারলেন না আর। সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন, অনাদর, অপ্রাপ্যতা, অমিলের, অবহেলার এই জীবন বিসর্জন দিয়ে দিবেন। কারণ, সেই সময়ে আবারো একটা বিজন্যাস ডিল হারিয়েছিলেন তিনি। কিছু জমির প্লট কিনেছিলেন। ভেবেছিলেন, এগুলো থেকে কিছু পয়শা উঠে আসবে। কৈলাশ খেরের নিজের বাবা মা থাকতেন ভাড়া করা বাড়িতে। যখন তিনি প্লট কিনলেন, নিজের প্রতি গর্ব অনুভব হলো তার। ভেবেছিলেন এই প্লট বিক্রির অর্থে বাবা মায়ের জন্য বাড়ি কিনবেন একটা। কিন্তু, সেই বিজন্যাস ডিলটায় লস হয় তার। ২.২ মিলিয়ন রুপি পরিমাণ অর্থ হারান তিনি এই ডিলে। তার শেষ অর্জিত অর্থগুলো এভাবে হারাতে দেখে তিনি শোকে স্তব্ধ হয়ে যান। সেইসময় নিজের প্রতি লজ্জায় কুকড়ে যেতেন তিনি।
তবুও যে চেষ্টা করেননি তা না। ব্যবসায়ে এত বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবার পর তিনি তার বাবার কর্মক্ষেত্রে সাহায্য করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাতেও তার মন ভাল হলো না। ডিপ্রেশন যেন আরো জেঁকে বসলো তার উপর। তার কাছে মনে হতো, আত্মহত্যাই একমাত্র অপশন বাকি আছে তার জন্যে। সবার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতেন তিনি। এড়িয়ে চলতেন সবাইকে। কারণ, মানুষের সঙ্গও তার ভাল লাগত না৷
একদিন তিনি গঙ্গার তীরে একটা ঘাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ভাবছেন, গত একটা বছর কি কি হয়ে গেল তার সাথে। তার মনে হলো, অনেক হয়েছে এবার পালাতে হবে। বেঁচে থাকা কঠিন। মরে গিয়ে বেঁচে যাওয়ার মতো বোকা চিন্তা আসলো তার মাথায়। দিলেন গঙ্গার জলে ঝাঁপ৷ তার বন্ধু আচমকাই এই কাণ্ড দেখে ভড়কে গেলেন। সেই বন্ধু আসলে ভেবেছিল, কৈলাশ বোধহয় পা পিঁচলে পড়ে গেছে জলে। সে ঝাঁপ দিয়ে নেমে ডুবন্ত কৈলাশকে ঘাটে ফেরায়৷
সেইদিনের সেই ঘটনার জন্য এখন উল্টো লজ্জা হয় কৈলাশের। এরপর কেটে গেল আরো ১৬/১৭ বছর। কৈলাশ গানের জগতে আসলেন। বাকিটা তো ইতিহাসই। শুরুতে তিনি পপ-রক ভোকাল হিসেবে গেয়েছিলেন কিছুদিন। পরে বোঝা গেল ঈশ্বরপ্রদত্ত কৈলাশের কণ্ঠে সুফি গান ভীষণ ভাল লাগে। এরপর তো সুফি গান দিয়েই মাত করলেন।
'আল্লাহকে বান্দে' সুফি গানটা গাওয়ার পর তাকে আর পেছনে ফিরে চাইতে হয়নি, জীবন একেবারে বদলে গেছে। তার কন্ঠ এত ইউনিক যে, তাকে আলাদা করে চেনানো লাগে না, সবাই তাকে আলাদাভাবেই চেনে। কি পরিমাণ ভালবাসা যে পরের একযুগ ধরে অর্জন করেছেন তিনি, সেটা নিজেও কি ভেবেছেন কখনো! আর যে অর্থের জন্য এতকিছু, এখন কি এই বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে অর্থপূর্ণ ঘটনা মনে হয় না তার কাছে? হয়, খুব হয়। আর এজন্যেই এখন তার উপলব্ধি হয়েছে। তার মনে হয়, এখন থেকে ১৬/১৭ বছর পেছনে ফিরে নিজের সঙ্গে যদি আবার দেখা হয়, আবার যদি সেই একই ডিপ্রেশনে পড়ে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয়, তাহলে আর কেউ না, তিনি নিজেই নিজেকে থামাবেন। বোঝাবেন। নিজেই আটকাবেন নিজেকে।
আজকের দুনিয়ায় ডিপ্রেশনটা বেশ ছড়িয়ে গেছে। পৃথিবীর জনসংখ্যা যত বাড়ছে, মানুষ যেন আরো বেশিরকম নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। একেকজনের অভিমানের পাহাড় হয়ে গেছে হিমালয়ের চেয়েও উঁচু। সেই হিমালয় সমান অভিমান জয়ের মানুষ কই! কোথাও কেউ নেই নেই, কোথাও ঠাই নেই এই একটা বোধে বিপর্যস্ত মানুষ। পৃথিবীর মানুষকে নিজের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য নিজেকেই সরিয়ে নিতে চায় মানুষ। তাতে লাভটা কোথায়?
এই যেমন একজন কৈলাশ খের ষোল বছর আগে মারা গেলে, তার জন্য বিবেকের দংশন হতো কার এত? হলেও কতটা স্থায়ী হত? তিনি আজ আছেন বলেই, তার গান আছে। তার গুরুত্ব আছে। তিনি এখন নিজেকে ভালবাসেন বলে, লোকে তারে ভালবাসে। এখন তার গুরুত্ব বোঝাতে হয় না কাউকে, লোকে বুঝে এমনিতেই।
শুধু বেঁচে থাকলে কত কি যে হয়ে যায়! কৈলাশ খের কখনো ভাবতেও পারেননি, এতকিছুর পরে এসে তিনি সুফি গানে ফিট করবেন। আপনিও হয়ত জানেন না, আজকে নিজেকে মেলাতে পারছেন না একটা সিচুয়েশনের সাথে, খুব খারাপ লাগছে? অপেক্ষা করুন। সামনে সুদিন আসছে। এমন কোথাও নিজেকে আপনি আবিষ্কার করবেন, লোকে আপনাকে আবিষ্কার করবে যে, নিজেও ভাবেননি আগে এই জায়গাটাই আপনার! জায়গাটুকু ছেড়ে না গেলেই জায়গাগুলো খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সম্ভাবনাগুলো টিকে থাকুক! প্রতিটি জীবন বেঁচে থাকুক...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন