চেকপোস্টে পুলিশ আমাদের যানবাহন থামিয়ে সাইড করতে বললেন প্রতি জেলাতেই। পুলিশের কাছে এগিয়ে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বলি, "আমার বাবা যশোরের জেল হাজতে, তাকে দেখে ঢাকায় বাড়িতে ফিরছি।"

বাবাকে ছাড়া ঈদ কি করে করা যেতে পারে এই বিষয়ে একটা ইন্সট্রাকশন মান্যুয়াল থাকলে আমার জন্য সুবিধার হতো। মনে করতে পারিনা বাবাকে ছাড়া এর আগে কখনো  ঈদ করেছি কিনা। এমন না যে বাবা নেই আমার আর, বাবা আছেন কয়েকশো কিলোমিটার দূরের এক জেলে। তার অপরাধ? উনি ফেইসবুকে কিছু পোষ্ট শেয়ার করেছেন! ৫৩ দিন নিখোঁজ থাকার পর হাত বাঁধা চোখ অবস্থায় পুলিশ পেলো তাকে তারপর তারাও পিছ মোড়া করে হ্যান্ডকাফে বাঁধলো বাবার দুটি হাত। জামিন পরপর খারিজ। একটার পর একটা মামলা দিয়ে শক্ত করে বাঁধা আমার বাবাকে।

কাউকে কিচ্ছু বলি নাই, কিন্তু ভেবেছিলাম বাবা ঈদের আগে মুক্তি পাবে। আমার পরিবার ফিরে পাবে আমাদের হারানো শান্তি। 

সবগুলো রোজা রাখি আমি। এইবারো রাখলাম। ভেবেছিলাম বাবাকে ছাড়া রোজা রাখতে আমাদের জীবন যাবে। যতটুকু গেলো তারপরও আছি জীবনের সঙ্গে ,আমাদের পুরো পরিবার "অপেক্ষা" নামক ঘড়িটির সামনে এক কাতারে দাঁড়িয়ে। টিক টিক করে সেই ঘড়িটা বোকার মতো সঠিক সময় দিয়ে যাচ্ছে।

কেউ যদি আগে কখনো জিজ্ঞেস করতো এই দুনিয়ায় সবচেয়ে কষ্টের কি আছে? আমার তখন অনেক কিছুই উত্তর দেওয়ার থাকতো। আপনাদের পৃথিবীতে আবার কষ্টের শেষ আছে নাকি। কিন্তু কে যেনো এখন কান ধরে টেনে খাতায় মোটা দাগে "অপেক্ষা" শব্দটা লিখে চোখের উপর চব্বিশটা ঘন্টা ঝুলিয়ে রেখেছেন। তাতে আমার দুটো চোখ লাল; আমার মায়ের দুটো চোখ ফোলা এবং আমার বোন পৌষীর দুটো চোখ বোবা হয়ে সদর দরজার দিকে আটকে আছে। আমরা যদি কদাচিৎ কোনোদিন ঘুমিয়ে পড়ি ক্লান্তিতে, তখন আমাদের কান দুটি সজাগ দাঁড়িয়ে থাকে। ফোনের রিংটোন আর আমাদের হৃদপিন্ড এক তারে বাধা। সর্বদা আমাদের নাক বাবার অস্তিত্বের অতি নিরাপদ, অতি পরিচিত গন্ধ সারা ঘরময় খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে হাঁপাইতে থাকে দিনরাত। 

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

অপেক্ষার মতো ভোঁতা এবং একইসঙ্গে, অপেক্ষার মতো ধারালো অন্য কিছু হতেই পারেনা। অন্য সব কষ্টরা যেখানে একদিকে কাটতে পারে, অপেক্ষা কাটে যত দিক দিয়ে পারে কাটতে। সোজা বুকের মাঝ বরাবর গিয়ে কাটে। আর সেটা যদি হয় নিজের বাবাকে ফেরত পাবার অপেক্ষা, তাহলে তো কথাই নেই। তখন শুধু কেটেই ক্ষ্যান্ত দেয় না, কামড়াতেও থাকে দয়া-মায়াহীনভাবে। অপেক্ষার মুখ আমাদের চারজনের আহত রক্তে রঞ্জিত। পারলে আপনারা একবার চিন্তা করেন "অপেক্ষা" নামক কিছু ঘাড়ের উপর প্রতিটা মুহূর্তে গরম নিঃশ্বাস ছাড়ছে। একদমই পারবেন না, যদি না আপনাদের বাবাকে এভাবে আমার বাবার মতো জেলে ধরে রাখে।

গতরাতে ঈদের  চাঁদ ওঠার পর পর অপেক্ষাকে ঈদের ছুটি দিলাম। বুঝতে পারলাম বাবা আজকে আর আসতে পারবেন না। পৌষীর চোখের বোবা প্রশ্ন থেকে যতক্ষণ পারি এড়িয়ে বাঁচি। আর না পারলে লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখি। মায়ের ফোলা চোখের দিকে চোখ পড়লে লজ্জা লাগে। মাটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মেঝের প্রতিটা ফাটলের সঙ্গে এতদিনে এক প্রকার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। কদাচিৎ চোখ পরে গেলে শিখে গেছি, মেঝের কোনো ফাটলে আমার চোখ দুটোর জন্য আশ্রয় চাইতে পারি।

আমাদের আজ একাই ঈদ করতে হবে। এটাই এখন একমাত্র সত্য কথা। আমরা শুধু বাবাকে সঙ্গে নিয়ে ঈদ করতে জানি, এর বাইরে ঈদ কি হতে পারে আমাদের কোনো আইডিয়া নেই। বাবার সেমাইয়ের বাটিটা খালি রেখে আমাদের গলা দিয়ে কিভাবে সেমাই নামবে, সেটা আজ শুধু আমরাই বুঝতে পারবো।  

আপনাদের রাষ্ট্র কি আমাদের একটু ঈদ আনন্দ সেলামি হিসাবে হলেও তো দিতে পারতেন না? রাষ্ট্র তো এখন ঘিঞ্জি কারাগার থেকে অনেক আসামিকেই ছেড়ে দিচ্ছেন। আমার বাবা তো কোনো অপরাধে এখনো সাজা প্রাপ্ত আসামী প্রমাণিত হন নাই। তাহলে আমার বাবার জামিন কেনো প্রতিবার খারিজ হচ্ছে? কার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর চাইবো বলতে পারেন? 

আমাদের আছে রাজ্যের প্রশ্ন, কিন্তু কোনোটারই উত্তর চাইতে পারবো না। উত্তরও চাইনা আমরা আসলে, আমরা শুধু আমাদের বাবাকে আমাদের মাঝে ফেরত চাই। আমি আমার নিজের জীবনটাকেও ফেরত চাই। আমি তো এমন জীবন চাইনি। আগের মতো জীবন আমাকে আপনারা কখনোই ফেরত দিতে পারবেন না। আমি ফেরতও চাচ্ছি না, হিসাবও চাচ্ছিনা। শুধু একটাই দাবি বাবাকে ফেরত দিন আমাদের কাছে।বাবাকে একটা দিন তার বিছানায় ঘুমুতে দিন। শুধু একটি দিন দান করুন, যাতে একটুখানি স্বস্তির নিঃশ্বাস আমরা ফেলতে পারি।

বাবা কাজলের সঙ্গে ছেলে পলক

গতকাল রাতে আমাদের প্রিয় শহর ঢাকায় অনেক বাতাস ছিলো, বাতাসের টানে "অপেক্ষাকে" ছুটি দিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসি। ঘরের দরজাটা খুলতেই  রমজানের ঈদের অতি চেনা সুগন্ধে ভেসে যাচ্ছে সবকিছু। করোনাও সেই সুগন্ধে স্পষ্টতই কোনো ভাগ বসাতে পারেনি। প্রতিবেশি মায়েরা-খালারা নিজেদের ঘরে রাত জেগে পরের দিনের জন্য পোলাও এবং রোস্ট রান্না করছিলেন। সেই সুগন্ধ তো আমাদেরকে আর বিশেষ ছাড় দিয়ে যাচ্ছেনা। প্রতিবেশিদের ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে দেখি পরিবারের সবাই একসাথে বসে গল্প করে। আর আমরা চারজন ঘরের চার কোনায় "অপেক্ষা" নামক সাদা দড়িতে ঝুলে আছি।

সময় জনাব গত আড়াইটা মাস আমাদের জীবন্ত লাশের উপর দিয়ে কচ্ছপের মতো খুব ধীরে ধীরে যাচ্ছে। তবে কোনো কিছুই মনে রাখবো না আমরা, আমাদের বাবাকে ফেরত দিন, এই এতটুকুই আমাদের চাওয়া। বাংলাদেশের সক্ষম পরিবারদের মতো যদি পারি সাদা ভাতে গরুর লাল ঝোল মাখাতে মাখাতে ভুলে যাবো আমাদের বিগত আড়াইটা মাসের ইতিহাস।  

বাবা আজ ঈদের দিনেও যশোর জেলে। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে ঘুরতে যেতাম ঈদের দিনে। জেল ঘুরতে যাবার জায়গা নয়। দ্বিতীয়বারের মত আমি করোনাকে অগ্রাহ্য করেই যশোর গিয়েছিলাম শুধুমাত্র বাবাকে ফিরে পাব ভেবে। তা হলোনা। ফেরার সময় বাবা বললো , "বাবা তোমাকে এইসব করতে হচ্ছে, এইভাবে তোমাকে দেখতে আমার আর ভালো লাগছে না।" 

সরকার করোনা থেকে জনগণকে বাঁচাতে সারা দেশ ২০ তারিখ লোকডাউন করে দিয়েছিল। প্রতিটা জেলা শহরে শহরে চেকপোস্ট। ভেবেছিলাম বাবা হয়তো আমার পাশে বসে ফিরবে আমাদের সঙ্গে। বাবার হাতটা কি করে ধরে রাখতে পারবো মুঠো করে সারাটা পথ- সেটা নিয়ে ঢাকা থেকে যশোর যাওয়ার সময় অনেক ভেবেছি। কিন্তু কল্পনাতেও বহুদিন পরে বাবার হাতের উষ্ণতা কেমন হবে অনুমান করতে পারছিলাম না।

আর ফেরার পথে আসলে হলোটা কি যদি জানতেন- কি আর বলবো, অন্ধকার মহাসড়কের আমাদের যানবাহনটির কাচের গ্লাসের দু পাশে "আমপান" চিরে ফিরে যাচ্ছিল। চেকপোস্টে পুলিশ আমাদের যানবাহন থামিয়ে সাইড করতে বললেন প্রতি জেলাতেই। পুলিশের কাছে এগিয়ে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বলি, "আমার বাবা যশোরের জেল হাজতে, তাকে দেখে ঢাকায় বাড়িতে ফিরছি।" 

গাজীপুরের চেকপোস্টে আমাদের তো আর ছাড়েনা। পুলিশ আমার কথা বিশ্বাস না করে বললো গাড়িটা সাইডে পার্ক করে রাখেন। আমার সাথে কোনো কাগজপত্র নেই যশোরের কোর্টের। থাকবেই বা কি করে? পেলে তো থাকবে নাকি। ১৫ দিন পার হয়ে যাওয়ার পরও ৫৪ ধারার অধীনে বাবা জেলে। যেখানে বাংলাদেশের আইনে স্পষ্ট করে বলা আছে, ১৫ দিনের বেশি কাউকে ৫৪ ধারার অধীনে জেল হাজতে রাখা যাবেনা। উত্তর নেই আমার কাছে অন্তত। আপনাদের কাছে আছে কি ? এখন পর্যন্ত নেই।

গাড়িটাকে মহাসড়কের পাশে সাইডে করে দাঁড়িয়ে আছি। মাথার উপর "আমপানের " তুখোর বৃষ্টি। পুলিশ মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখে। বৃষ্টিকে  অনেক ধন্যবাদ। অন্তত চোখের জল পুলিশকে দেখতে হচ্ছেনা। ভোররাতে কোনোভাবে বাড়ি ফিরি। কিন্তু কেনো যেনো মনে হচ্ছে আমি এখনো সেই মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে আছি একা। পুলিশ কিছুক্ষন পরপর আমাকে আড়চোখে দেখছে।   

আপনাদেরকে ঈদ মোবারক, পলক।

বাবা সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক হয়ে কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন, তার ছেলে মনোরম পলক ফেসবুকে লিখেছেন, তাদের অপেক্ষার যন্ত্রণায় ভরপুর এই ঈদের গল্পটা...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা